একজন মা হিসেবে আমি জানি আমার সন্তানের কাছে আমি কত কিছু প্রত্যাশা করি। কিন্তু আমার সন্তান আমার সব আশা যে পূরণ করতে পারবে এমন না। কিন্তু এই কথাটি যদি আমি ভুলে যাই কিংবা তাকে আমার সব আশা পূর্ণ করার জন্য জোর জবরদস্তি করি তাহলে সেটার বিরূপ প্রভাব পরবেই।
হয় বাচ্চাটি খুব একসময় বিরক্ত হয়ে এগ্রেসিভ হয়ে যাবে কিংবা বাবা-মায়ের আশা পূরণ করতে না পারার জন্য হতাশায় ভোগা শুরু করবে। আর এই জিনিসটা শুরু হয় খুব ছোট বেলা থেকেই। আমি যখন বাচ্চাদের নিয়ে স্কুলে যেতাম তখন দেখতাম সবাই তাদের সন্তানের ভালো রেজাল্টের জন্য কি পরিমান দুঃশ্চিন্তাগ্রস্থ। অবশ্য দুই-চারজন ব্যাতিক্রম দেখি নাই এমন না।
আসলে ভালো ফলাফল সবারই কাম্য কিন্তু সব বাচ্চাই যে করতে পারবে এমনতো না। অথচ ভালো রেজাল্ট হলেই যে সন্তান তার জীবনে সফল হবে এছাড়া সে কিছু করতে পারবে না এমনও না।
এমনও দেখেছি যে বাচ্চার রেজাল্ট ভালো না হওয়ার জন্য মা কান্না করছে। আবার অনেক সময় সবার সামনে বকাবকি করতে দেখেছি।
আমি আমার দুই ছেলেকে বড়ো করতে গিয়ে একটা জিনিস বুঝতে পেরেছি যে ,ওদেরকে বাড়িতে হাজার কিছু বললেও তেমনভাবে গুরুত্ব দেয় না কিন্তু বাইরের মানুষের সামনে কিছু বললে খুব বেশি অপমানিত বোধ করে। এটা সব বাচ্চার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।
প্রায় প্রতিবছরই মাধ্যমিক কিংবা উচ্চমাধ্যমিকের ফলাফল বের হলে পরীক্ষায় আশানুরূপ রেজাল্ট না করার কারণে দুই /একটা আত্মহত্যার খবর চোখে পরে। এটা এই হেলিকপ্টার প্যারেন্টিংয়েরই ফল।
গবেষণায় এটাও দেখা গেছে যে ,যেসব বাবা -মা তাদের সন্তানকে নিয়ে অতি সচেতন তারা নিজেরাও অতিরিক্ত দুর্শ্চিন্তায় ভোগেন ও অনেকসময়ই হতাশাগ্রস্থ হয়ে থাকেন।
১৯১৬ সালের ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অফ সিঙ্গাপুরের একটি গবেষণা থেকে জানা যায় যে , যেসব শিশুদের উপর তাদের বাবা -মায়েরা খুব বেশি প্রত্যাশা করেন যে তারা পড়ালেখায় খুব ভালো করবে এবং যেসব শিশুদের সামান্য ভুলে তাদের পিতামাতা অনেক শাসন করে থাকেন সেই শিশুরা সাধারণত আত্মসমালোচনা ,দুঃশ্চিন্তা ও বিষন্নতায় ভোগে।
আমার মনে পরে যে আমার এক বন্ধু তার মায়ের সম্পর্কে প্রায়ই বলতো যে ,তার মা তার লেখা ডায়েরি পড়ে। যা সে একদমই পছন্দ করতো না। পরবর্তীতে সে ডায়েরি লেখায় ছেড়ে দেয় । কারণ আমার বন্ধুর মনে হতো যে তার মা তার উপর নজরদারি করছে।
এখনকার বেশিরভাগ ছেলে -মেয়েই শৈশবে স্বাধীনভাবে বেড়ে উঠতে পারে না। অভিভাবকরা ঠিক করে দেন সন্তান কোন পোশাক পড়বে কিংবা কোন বিষয়ে পড়াশুনা করবে। এমনকি তাদের স্কুলে বন্ধু কে হবে সেটাও অনেক সময় মা-বাবার পছন্দের হতে হয়।
এ ক্ষেত্রে তাদের যুক্তি হচ্ছে সন্তানের নিশ্চিত একটা ভবিষ্যতের জন্য এছাড়া কোন উপায় নেই । তাছাড়া সব মা-বাবাই তো সন্তানের মঙ্গল চান। তারা তাদের সন্তানকে ভুল থেকে বাঁচানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু এই অতিসচেতনতা অনেক সময় হিতে বিপরীত হতে পারে।
এর কারণে সন্তান বড় হয়ে দুঃশ্চিন্তাগ্রস্ত রোগ এ ভুগে।তাদের মাঝে আত্মবিশ্বাসের অভাব থাকে পরবর্তীতে যা তাদের ক্যারিয়ারকেও প্রভাবিত করে।তাদের মাঝে মানিয়ে নেয়ার দক্ষতা তেমনভাবে গড়ে উঠে না। এরফলে প্রতিকূল পরিস্থিতিতে তারা অল্পতেই মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়ে এবং জীবনে চলার পথে ব্যর্থতা এবং অনিশ্চয়তাকে যথাযথ ভাবে মোকাবেলা করতে পারে না।
শিশু -কিশোররা ভুল করবেই। ভুল করতে করতেই তারা শিখবে। কোনটা সঠিক সেটা তাদেরকে অবশ্যই বোঝাতে হবে কিন্তু সেটা সময় নিয়ে এবং বন্ধুর মতো করে। নাহলে কিশোর অথবা প্রাপ্তবয়স্ক সন্তান যখন বুঝতে পারে তার অভিভাবক তাকে নিয়ন্ত্রণ করছেন, তার সিদ্ধান্তে হস্তক্ষেপ করছেন, তখন সে পরিবারের সঙ্গে মন খুলে কথা বলা কমাতে থাকে। যার কারণে একটা সময় মা-বাবার সঙ্গে তার দূরত্বও বেড়ে যায়। এতে করে বাবা -মাও একধরনের বিষাদে ভোগা শুরু করে।
বাচ্চাদের ছোট থেকেই নিজেদের কাজ নিজে করতে দিন। ওরা না পারলে সাহায্যের হাত বাড়ান। ছোটবেলা থেকে খেলনা গোছানো, জামাকাপড় গুছিয়ে রাখা, নিজের জুতা–মোজা গুছিয়ে রাখার মতো কাজে করতে দিন এবং একটু বড় হলে বিছানা-ব্যাগ গোছানো, ঘর পরিষ্কার করা, বাজার করা, রান্না করতে সাহায্য করার মতো কাজ করতে দিন। এতে করে ওদের আত্মবিশ্বাস গড়ে উঠবে এবং মা-বাবার ওপর থেকে নির্ভরশীলতা কমবে।
ওদেরকে হারতে দিন , ওরা হারতে হারতেই একদিন জিততে শিখে যাবে। সেই সাথে ওদের সাথে কথা বলুন যত বেশি সম্ভব। মনোযোগ দিয়ে শুনেন ওরা কি ভাবছে ও করতে চায়। চিন্তায় ভুল থাকলে বন্ধুর মতো বোঝান। এমন কিছু দেবেন না বা এমন প্রতিশ্রুতি করবেন না, যা আপনি রাখতে পারবেন না।
ওরা বড়ো হয়ে ওঠার সময় ওদের ওপর নিয়ন্ত্রণ ধীরে ধীরে কমিয়ে দিন। আপনার সন্তানকে ভরসা আর বিশ্বাস করুন এবং নিজেও তার ভরসার জায়গা হয়ে উঠুন ।