অনেকটা বছর হয়ে গেছে তাকে ছাড়া। এই অনেক বছরের সংখ্যা তো হয়ত হাতে গোনা তবে সেটা পার করাটা মোটেও সহজ ছিলো না। একটা সময় মনে হয় এই মানুষটাকে ছাড়া কিভাবে থাকবো। তবে এখনতো দিব্যি তাকে ছাড়া ৮ বছর পার করে ফেলেছি।
না! আমি আমার কোনো প্রেমিকার কথা বলছি না। বরং সেই মানুষটার কথা বলছি যার ছত্রছায়ায় এত বড় হয়েছি।যার আদর্শ এখনও মেনে চলে আমার পরিবারের প্রতিটা মানুষ। আমি বলছি আমার দাদুর কথা।
এতই গত সপ্তাহে দাদুর ৮ম মৃত্যু বার্ষিকী ছিলো। প্রতি বছরই দাদুর মৃত্যুর বার্ষিকী পালন করা হয় তবে ইচ্ছা থাকার শর্তেও কিছু কারন বশত এবার করা হয়নি। তবে ছোট আকারে বাড়িতে অনুষ্ঠান করা হয়েছিলো।
কিভাবে যে এই আট বছর পার হয়ে গেলো বুঝতেই পারি নি। সেদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে পড়তে গিয়েছিলাম বাড়ি থেকে অনেকটা দুরে। প্রতিদিন সাইকেলে চড়ে পড়তে যেতাম তবে সেদিন রাস্তায় নতুন করে কাজ শুরু হয়েছিলো এজন্য সাইকেল নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি। হেঁটেই পড়তে গিয়েছিলাম।
সকাল ৭-৮ টা পর্যন্ত অংক করতাম তারপর সেখান থেকে বেরিয়ে অন্য স্যারের কাছে ৮-৯ টা পর্যন্ত ইংরেজি পড়তাম। ৯টায় পড়া ছুটি হলে সেখান থেকে বাড়িতে এসে স্নান করে খেয়ে আমার স্কুলে চলে যেতে হতো কারন ১০ টা থেকে ক্লাস শুরু হতো। ৪ টার সময় স্কুল ছুটি হলে ৫.৩০/৬ পর্যন্ত গ্রুপ সাবজেক্টের প্রাইভেট পড়ে বাড়ি আসতে আসতে সন্ধ্যা হয়ে যেত। একমাত্র শুক্রবার বাদে সপ্তাহের অন্য দিন এভাবেই চলতো।
যাই হোক সেদিন ইংরেজি প্রাইভেট পড়ছিলাম, পড়া প্রায় শেষের দিকে ছিলো।সেসময় আমি বাটন মোবাইল ব্যবহার করতাম শুধুমাত্র প্রয়োজনে সকলের যোগাযোগ রাখার জন্য। হঠাৎ বাবা ফোন করে বললো যে দাদুর অবস্থা খুবই খারাপ।
একথা শুনেই আমি পড়া শেষ না করে স্যারের কাছ থেকে ছুটি নিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে ছুটলাম। যেহেতু অনেকটা দুর বাড়ি থেকে এদিকে সাইকেলও সাথে নেই তাই আমি কাঁদতে কাঁদতে দৌড়ে বাড়ি আসছিলাম। সেদিন দৌড়েও পথ শেষ করতে পারছিলাম না।
রাস্তার যার সাথে দেখা হচ্ছে সে জিজ্ঞেস করছে যে কি হয়েছে কিন্তু সেদিন কারো কথার কোনো উওর দিতে পারে নি।
বাড়িতে এসে দেখলাম দাদু অবলীল দৃষ্টিতে সবার দিকে তাকাচ্ছে কিন্তু কারো কথার কোনো সাড়া দিচ্ছে না। এতদিন আমি না নিজেকে খুব শক্ত মনে করতাম। কিন্তু সেদিন যখন আমি এসে দাদুর পাশে বসলাম তখন আমার অজান্তেই চোখ দিয়ে যেন জল বেয়ে পড়তে লাগলো কোনো ভাবেই নিজেকে আটকে রাখতে পারছি না যেন!
তখন দাদুকে হারিয়ে ফেলার ভয় তো বটেই, সেই সাথে চোখের সামনে স্মৃতিগুলো যেন জ্বল জ্বল করে উঠতে লাগলো।
দাদু তখন কোনো ভাবেই কথা বলতে পারছিলো না। তখন ইশারায় খাতা-কলম চাইলো। মৃত্যুর আগমুহূর্তে যে কেউ কলম হাতে নিয়ে মনের কথা লিখতে পারে এমন আশ্চর্যজনক ঘটনা আমি আজ পর্যন্ত দেখিনি। দাদু খাতায় তার মনের কথাটা লিখলো। লেখাটা ঠিক এমন ছিলো -
সবাই মিলেমিশে থাকবা। আমার সময় হয়ে এসেছে।
এটাই ছিলো তার শেষ কথা। এই লেখাটা লিখতে গিয়ে দাদুর হাত তো কাপছিলো তার সাথে চোখ দিয়ে অশ্রু বয়ে যাচ্ছিলো। তার ঠিক কিছুক্ষণ পরই সব কিছু স্তব্ধত হয়ে গেলো।
কিছুই বাড়িয়ে আমি বলছি না, ঐ দিনটার কথা আমি কখনও ভুলবো না, ভুলে যাওয়া সম্ভব না।
দাদু ১০৬ বছর বয়স পর্যন্ত ছিলো আমাদের মাঝে। আমার দাদুর মতো অদ্ভুত মানুষ আমি দেখিনি আজ পর্যন্ত। যত দিন বেঁচে ছিলো একদিনও কাজ করা বন্দ দেয় নি। বাবা এত করে বারন দিত তবুও নিজের মতো করে সারাদিন এটা ওটা করতেই থাকতো। দাদু বলতো - আমি যদি কাজ করা ছেড়ে দেই তাহলে তাড়াতাড়ি আরও দুর্বল হয়ে পড়বো।
দাদুর সব কিছু হতো সময় মতো। সকালে ঘড়ি দেখে খাওয়া, দুপুরে স্নান ও খাওয়া প্রতিদিন সবই হতো একই সময়ে। দুপুর থেকে প্রতিদিন ধর্মীয় গ্রন্থ পড়তো বিকাল পর্যন্ত। রাতেও সময় মতো খেয়ে তারপর কিছুসময় বারান্দায় হাঁটাহাটি করে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে ঘুমাতে যেত।
যত দিন দাদু ছিলো ততদিন ঘড়িটা সচল ছিলো। আজও সেই দেয়াল ঘড়িটা আছে তবে অচল অবস্থায় পড়ে আছে ঘরের এককোণায়। কারন এখন তো মোবাইলের মাধ্যমে সময় দেখি আমরা। তাই ঘড়িটা অপ্রয়োজনীয় হয়ে গেছে।
ঘড়িটা যার প্রয়োজন ছিলো তার জীবনের সময় ফুরিয়ে গেছে ৮ বছর আগে!
আমাদের মাঝ থেকে অনেক মানুষ এই পৃথিবী থেকে চলে গেছে তাদের স্মৃতি আমাদের মনের কোণে সব সময় ভেসে ওঠ, অনেক আপনজন আছে যাদের স্মৃতি মনে উঠলে মনটা কেঁদে ওঠে, আপনার দাদুর চলে যাওয়ার গল্প শুনে খুব খারাপ লাগলো, ধন্যবাদ সুন্দরভাবে গুছিয়ে পোস্টটি আমাদের সাথে শেয়ার করার জন্য।
Downvoting a post can decrease pending rewards and make it less visible. Common reasons:
Submit
আপনার লেখা টাইটেল ও শেষের এই দুই লাইন হৃদয় ছুঁয়ে গেলো। আপনার দাদুর গল্প পড়তে পড়তে মনের মধ্যে নিজের ঠাকুমার সাথে কাটানো ছোটবেলার বহু স্মৃতি ভেসে উঠলো। এই মানুষগুলো আমাদের সকলের জীবনে বটগাছের ছায়ার মতো ছিলো। বেঁচে থাকতে কতখানি মূল্য দিয়েছে সত্যিই জানিনা, তবে তাদের মৃত্যু আমাদের জীবনে তাদের কতখানি গুরুত্ব ছিল তা খুব ভালোভাবে বুঝিয়েছে।
আমার ঠাকুরমা ঘড়ি দেখতে পারত না তবে সূর্যের আলো দেখে যখন সময় বলতো,তখনই ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখতাম সঠিক সময় বলছে। বিষয়টা নিয়ে বেশ অবাক হয়েছি অনেকবার। আপনার দাদুকে ব্যক্তিগতভাবে দেখার সুযোগ না হলেও, তার সাহচার্য্যে বেড়ে ওঠা আপনাকে যতটুকু চিনেছি, তাতে এ কথা বলতে পারি মানুষ হিসেবে তিনি সকলের অনেক প্রিয় ছিলেন। তার থেকে শেখা প্রতিটি জিনিস নিজের জীবনে সঠিকভাবে কাজে লাগান, তাহলে মানুষ হিসেবে আপনার জীবন সার্থক হবে। দাদুকে যে শেষ পর্যন্ত দেখতে পেয়েছিলেন, জেনে ভালো লাগলো। আমি আমার ঠাকুরমাকে শেষ দেখা দেখতে পাইনি। আর এই কষ্ট ঠিক কতখানি তা বলে বোঝানো সম্ভব নয়। নিজের দাদুর প্রতি আপনার অনুভূতি এতো সুন্দর ভাবে ব্যক্ত করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। ভালো থাকবেন।
Downvoting a post can decrease pending rewards and make it less visible. Common reasons:
Submit
স্মৃতি সত্যি অমরত্ব হয়ে থাকে।। আপনার দাদুর মৃত্যুর ঘটনা শুনে একটু আশ্চর্য হয়ে গেলাম শেষ পর্যায়ে এসে খাতা কলমে খুবই মূল্যবান কথা লিখে গেছেন।। দেখতে দেখতে আটটি বছর পার করে ফেললাম তবুও দাদুর খেতে ভুলতে পারছেন না এটাই স্বাভাবিক ভাই।।
Downvoting a post can decrease pending rewards and make it less visible. Common reasons:
Submit
"আপনার মনের সাথে দুঃখ ও বিনোদন জড়িয়ে ফেলা কষ্টের কাছে যাচ্ছেন? আপনি এতে সহমর্মার্থিক!
দুঃখ ও বিনোদনগুলো থেকে অভিজ্ঞতা পেয়েছি এই আমাদের সংলাপ চোখে ফিরে নিন...
Downvoting a post can decrease pending rewards and make it less visible. Common reasons:
Submit