আমরা যখন কোন কিছু উৎপাদন করতে যাই তখন আমাদের যে চারটি মূল উপাদান প্রয়োজন হয় তার মধ্যে অন্যতম হলো শ্রম অর্থাৎ শ্রম ছাড়া উৎপাদন কখনোই সম্ভব নয়। আর সেই জন্য শ্রম এর মর্যাদা ছাড়া কখনোই গণতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। শ্রমিকদের যদি মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত না করা যায় তাহলে আমাদের সমাজে এক ধরনের বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়। সেই অষ্টাদশ শতকে শ্রমিকদের ওপর নির্যাতন করা হতো অমানবিকভাবে। তাদের সাথে আচরণ করা হতো ক্রিতদাসের মতো। কর্ম ক্ষেত্রে শ্রমিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত না হলে কখনো উৎপাদনের সর্বোচ্চ চূড়ায় পৌঁছানো সম্ভব নয়। সাম্যের সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে হলে শ্রমিকদের অবশ্যই নায্য পাওনা দিতে হবে। আমরা সাধারণত জানি শ্রম এবং মেধা দিয়ে যে উৎপাদন হয় তা দিয়েই সমাজ বিকশিত হয় বা পুঁজি বিকশিত হয়। কিন্তু অষ্টাদশ শতকে মানুষ কৃষি থেকে ধীরে ধীরে শিল্পের দিকে অগ্রসর হওয়া শুরু করল। আর সেইসাথে পুঁজিপতিরা ক্ষুদ্র থেকে দ্রুতই বড় হওয়া শুরু করল। আর সেই সময় যারা কৃষক ছিল তারা শ্রমিক এ পরিণত হল। আর শ্রমিক এ পরিণত হয়ে তারা সর্বহারা শ্রেনীতে রূপান্তরিত হল। তাদেরকে পুঁজি দিয়ে এমন এক জালের মধ্যে আটকা হলো যা থেকে তাদের পক্ষে বের হওয়া অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। এমন একটা অবস্থা দাঁড়িয়ে গেল যে পুঁজিপতিরা শ্রমিকদের সাথে ক্রীতদাসের থেকেও চরম ব্যবহার শুরু করে দিল। প্রতিদিন ১০ ঘন্টা ১৬ ঘণ্টা ২০ ঘণ্টা পর্যন্ত কাজ করে দিত শ্রমিকদের থেকে। একজন শ্রমিক তার পরিবারের কথা চিন্তা করতে পারতো না, তার সুন্দর ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করতে পারত না। কিন্তু এই অবস্থা কতদিন চলতে পারে? তাই তো শ্রমিকদের মধ্যে এক বিপ্লবী চেতনা জাগ্রত হল। তারা এই অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে চায়, তারা স্বাধীনভাবে কাজ করতে চাই। তারই পরিপ্রেক্ষিতে ১৮৭৯ ঐতিহাসিক বিপ্লব সৃষ্টি হয়। ওইদিনই শ্রমিকেরা ৮ ঘণ্টা কাজের দাবিতে রাস্তায় নেমে আসে। আমেরিকার শিকাগো শহরে প্রায় ৪০০০০ কারখানার শ্রমিকদের নিয়ে ৮ ঘন্টা কাজের দাবিতে এক সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। সে সময় শ্রমিকরা শান্তিপূর্ণভাবেই আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছিল কিন্তু পুঁজিপতিরা ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকে নস্যাৎ করে দেওয়ার জন্য অপপ্রচার চালানো চালানো শুরু করে। কিন্তু এর পরবর্তীতে ১৮৮৬ সালে শান্তিপূর্ণ এক সমাবেশে পুলিশ হামলা করে এবং সেই সময় অনেক শ্রমিক মারা যায়। এই সংঘর্ষের পর মালিকপক্ষ ৮ ঘন্টা কাজের দাবি মেনে নিতে বাধ্য হয় ।পরবর্তীতে এই দিনটি মে দিবস হিসেবে পালন হতে থাকে এবং শোষণ বঞ্চনার উত্তরণের দিন হিসেবে।
শিকাগো শহরে সেই আন্দোলনের ফলে অনেক শ্রমিক কে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে। অনেকে শ্রমিককে তাদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে আজ এই মহান মে দিবস প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বঞ্চিতদের অধিকার আদায়ের হিসেবে। কিন্তু সেদিনকে আমরা আজ নানাভাবে কলঙ্কিত করছি, যে দিনটি ছিল এক শোকাবহ দিন। সেইদিনে আমরা গান-বাজনা মিষ্টি বিতরণ করছি যা সেই শহীদদের সাথে বা তাদের আত্মত্যাগের সাথে বেমানান। দুনিয়ার মজলুম এক হও এক হও স্লোগানে মুখরিত হয়েছিল রাজপথ। আজ মে দিবস উপলক্ষে সারা পৃথিবীর প্রতিটা দেশের ঐতিহাসিক দিবস পালন হচ্ছে সকলের শ্রমিক সমাজের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে। কিন্তু আমরা কতটা পূরণ করতে পারছি তাদের অধিকার। আজ মালিক সমিতির কাছে শ্রমিকরা জিম্মি হয়ে আছে তাদের ন্যায্য দাবি এখনো পূরণ করা হচ্ছে না। কর্ম ক্ষেত্রে তাদের কোন প্রকার নিরাপত্তা নেই। বিশেষ করে বাংলাদেশের শ্রমিকদের কর্ম ক্ষেত্রে কোন প্রকারে নিরাপত্তা দেখা যায় না। যদিও সাম্প্রতিক কয়েকটি বড় বিপর্যয়ের ফলে কিছু কিছু কলকারখানায় নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে তাও বৈদেশিক চাপের কারণে। আমরা সবাই রানা প্লাজার কথা জানি ,তাজিং ফ্যাশনের কথাও জানি । সেখানে কোন প্রকার শ্রমিকদের নিরাপত্তার বিষয় ছিল না বরং তাদেরকে কাজের প্রতি এতটাই জিম্মি করে রাখা হয়েছিল বিভিন্ন দুর্ঘটনার সময় যাতে তারা বের হতে পারত না এবং কাজ চলাকালীন সময়ে মেইন দরজা লাগিয়ে দেওয়া ছিল যা মানবিকতায় চরম বিপর্যয় । মহান মে দিবসের প্রায় ১৫০ বছর হতে চলেছে তবুও আমরা শ্রমিকদের নিরাপত্তা বিষয়ে উদাসীন। শ্রমিক নিরাপত্তা ইস্যু আমাদের সব সময় জোরদার করতে হবে। তাদের নিরাপত্তার বিষয়ে উদাসীন হলে আমাদের শিল্প সমাজ ধ্বংস হবে। আমাদের উন্নয়ন ব্যাহত হবে। আমাদের দেশে আর বড় বড় শ্রমিক নেতা দেখা যায়না যারা শ্রমিকদের নিয়ে কথা বলবে শ্রমিকের অধিকার নিয়ে কথা বলতে। শুধু কিছু স্বার্থবাদী শ্রমিক নেতা দেখা যায়।আমাদের দেশের সাংবাদিকদের দেখতে পাই না যে তারা শ্রমিকদের নিয়ে কথা বলবে। আজ সুকান্ত ভট্টাচার্যের মত কবিরা শ্রমিকদের নিয়ে লেখে না।
আমাদের দেশে এখনো বিভিন্ন সময়ে শ্রমিকদের রাস্তায় নেমে যেতে দেখা যায় বেতন-ভাতার দাবিতে। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে উৎসব উপলক্ষে তাদের উৎসব ভাতা দেওয়া হয় না। সঠিক মজুরি দেওয়া হয় না। বিশেষ করে ঈদের সময় দেখা যায় শ্রমিকদের ঈদের ছুটি দিতেও কার্পন্য করা হয়। আবার তাদের ঈদের বোনাস সহ বিভিন্ন ভাতা সঠিকভাবে প্রদান করা হয় না।এটি আমাদের জন্য লজ্জার । আশা করছি অদূর ভবিষ্যতে সব ধরনের সংকট কেটে যাবে অন্ধকার কেটে যে আলো আসবে। শ্রমিকরা আর বঞ্চিত হবে না। তারা কর্ম ক্ষেত্রে সমান সুযোগ পাবে। তাদের ন্যায্য অধিকার ফিরিয়ে দেওয়া হবে।
মে দিবসের গুরুত্ব ও তাৎপর্য এখন আমরা ভুলতে বসেছি। সম্ভবত এখনকার তরুণ প্রজন্মের অনেকেই এই ইতিহাস জানে না। আমাদের কাছে মে দিবস হল সরকারি ছুটির দিন, আনন্দের দিন কিন্তু এর পেছনে যে শ্রমিকদের একটি সংগ্রামী আত্মত্যাগের ইতিহাস আছে সেটা কজন জানে। যাই হোক সংক্ষেপে খুবই ভাল লিখেছেন আপনার পোস্টটি। একেবারে ঐতিহাসিক দিন তারিখ সহ। শুভকামনা রইল আপনার জন্য
Downvoting a post can decrease pending rewards and make it less visible. Common reasons:
Submit
আপনি একদম ঠিক বলেছেন ভাইয়া। আমরা সরকারি ছুটি ছাড়া আর কিছুই ভাবি না।যাইহোক আপনার মন্তব্য পড়ে অনেক ভালো লাগল।
Downvoting a post can decrease pending rewards and make it less visible. Common reasons:
Submit
আপনার পোস্টটি পড়ে খুবই ভালো লাগলো আপনি খুব সুন্দর করে মে দিবস সম্পর্কে আপনার মনের অনুভূতি প্রকাশ করেছেন। আসল শমিকদের ন্যায্য অধিকার দেয়া উচিত তাদের কাজের ধরন অনুযায়ী আর্থিক প্রণোদনা বাড়িয়ে দেওয়া উচিত। এবং তাদের নিরাপদ কর্মক্ষেত্র তৈরি করার অঙ্গীকার ব্যক্ত করি। এত সুন্দর পোস্ট শেয়ার করার জন্য আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ জানাই।
Downvoting a post can decrease pending rewards and make it less visible. Common reasons:
Submit
আপনিও অনেক সুন্দর মন্তব্য করেছেন ভাইয়া। এত সুন্দর মন্তব্য করার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।
Downvoting a post can decrease pending rewards and make it less visible. Common reasons:
Submit
মে দিবসকে ঘিরে খুব সুন্দর একটি আলোচনা আমাদের মাঝে তুলে ধরেছেন পড়ে খুবই ভালো লাগলো আসলে শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকার তাদের প্রাপ্য মালিক পক্ষ থেকে সব সময়ই সঠিকভাবে আদায় করা উচিত কারণ শ্রমিক না থাকলে তো আর কল-কারখানা চলবে না ধন্যবাদ আপু সুন্দর একটি বিষয় নিয়ে আলোচনা করার জন্য
Downvoting a post can decrease pending rewards and make it less visible. Common reasons:
Submit
আপনিও অনেক সুন্দর মন্তব্য করেছেন।আপনার মন্তব্য পড়ে ভালো লাগল।
Downvoting a post can decrease pending rewards and make it less visible. Common reasons:
Submit