সন্ধ্যা তখন ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়ছে। নীলার মনে হলো, আকাশ যেন তারই মনের ভেতরের অস্থিরতাকে মেলে ধরেছে। বৃষ্টির ফোঁটাগুলো তার বারান্দার রেলিংয়ে পড়ে সুর তুলে বাজছে। হাতে এক কাপ গরম চা নিয়ে, নীলা ভাবছে কত দিন হলো অনির সাথে তার দেখা নেই। সেই যে হঠাৎ একদিন ছুটির দিনে পাহাড়ে বেড়াতে গিয়েছিল, তারপর থেকেই যেন তার জীবনটা একটু অন্যরকম হয়ে গেছে।
সেই দিনে, নীলা আর তার বন্ধুরা গিয়েছিল সিলেটের জাফলং ঘুরতে। ঝর্ণার নিচে গিয়ে সবার সাথে নীলাও মনের আনন্দে ভিজেছিল। হঠাৎই পেছন থেকে কেউ ডেকে উঠলো, "নীলা?"। নীলা অবাক হয়ে ঘুরে দাঁড়ালো। চোখে পড়লো এক যুবক, যার চোখে এক অদ্ভুত প্রশান্তি। "অনিরুদ্ধ!" নীলা বিস্ময়ভরা কণ্ঠে বলল।
অনিরুদ্ধ, নীলার কলেজের সহপাঠী, যার সাথে সম্পর্কটা স্রেফ বন্ধুত্বে সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু সেদিন, ঝর্ণার স্রোতের শব্দের মাঝেও তাদের হৃদয়ের নিঃশব্দ কথোপকথন যেন প্রবল হয়ে উঠেছিল। একসাথে হাঁটতে হাঁটতে, তারা জীবনের নানা বিষয় নিয়ে কথা বলল। অনেক পুরনো স্মৃতি ঝেঁকে ধরেছিল নীলার মনে। আর তখনই বুঝেছিল, অনিরুদ্ধের প্রতি তার মনের গভীরে লুকানো যে অনুভূতি ছিল, তা শুধুই বন্ধুত্ব নয়।
সন্ধ্যার দিকে তারা জাফলং-এর একটি চায়ের দোকানে বসল। বৃষ্টির ফোঁটা আর কুয়াশার আড়ালে তখন প্রকৃতি যেন আরও রহস্যময় হয়ে উঠেছিল। তাদের কথোপকথন ধীরে ধীরে গভীর হতে লাগল। চায়ের ধোঁয়ার মধ্যে, অনিরুদ্ধের চোখে নীলা এমন কিছু দেখতে পেল যা আগে কখনও দেখেনি। তাদের হাসি, গল্প, আর ছোট ছোট খুনসুটি যেন এক অদৃশ্য সুরে বেঁধে দিল।
হঠাৎ, অনিরুদ্ধ বলল, "নীলা, তুমি কি কখনও ভেবেছো, আমরা দুজনেই যেন সব সময় কোথাও একসাথে ছিলাম, কিন্তু কখনও একে অপরকে পুরোপুরি বুঝতে পারিনি?" নীলা কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল। তারপর নরম গলায় বলল, "হয়তো সময়ের আগে আমরা সেটা বুঝতে পারিনি।"
অনিরুদ্ধের চোখে গভীর এক দৃষ্টি খেলে গেল। "আমি আর এই ভুলটা করতে চাই না। নীলা, তুমি কি আমার সাথে জীবনের বাকি পথটা হাঁটতে চাও?"
নীলার বুকের ভেতর ধুকপুকানি বেড়ে গেল। এই কথাটি সে বহুবার স্বপ্ন দেখেছিল, কিন্তু বাস্তবে এভাবে কখনও ভাবেনি। সে এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে হেসে বলল, "অনির, আমাদের পথটা তো অনেক আগেই শুরু হয়ে গেছে, শুধু আমরা দুজনেই হয়তো বুঝতে পারিনি।"
সেই রাতেই তারা নিজেদের ভেতরের অনুভূতিগুলোকে মেলে ধরল। ঝর্ণার স্রোতের মতোই তাদের সম্পর্ক প্রবাহিত হতে লাগল এক অন্য রূপে। পাহাড়ের চূড়ায় বসে তারা দেখেছিল সূর্যাস্তের আভা, যা তাদের ভালোবাসার প্রতীক হয়ে উঠেছিল।
আজ বারান্দায় দাঁড়িয়ে, নীলা সেই মুহূর্তগুলোর কথা ভাবছিল। অনিরুদ্ধ এখন তার জীবনসঙ্গী, এবং তাদের সম্পর্কের প্রতিটি দিন যেন নতুন গল্প হয়ে জ্বলজ্বল করছে। বৃষ্টির প্রতিটি ফোঁটার সাথে তার মনের কথাগুলো যেন আকাশের দিকে ছুটে যাচ্ছিল, অনিরুদ্ধকে মনে করিয়ে দিচ্ছিল—তাদের ভালোবাসা কোনো দিনই ম্লান হবে না।