তারিখ - ১২.১০.২০২২
বন্ধুত্ব! আহা কি দারুণ একটা শব্দ! তাইনা? যার জীবনে বন্ধু নেই তার জীবনে আর কিইবা আছে? আর যদি তা হয় ফেলে আসা বন্ধুত্বের স্মৃতি‚ তাহলে তার থেকে নস্টালজিক আর কিইবা হতে পারে?
যদিও এখন আলাদা কর্মজগতের জন্যে আর বাড়ি অনেক দূরে হওয়ায় সেইভাবে বন্ধুত্ব নেই বললেই চলে‚ কিন্তু তাও এখনো পর্যন্ত বেস্টফ্রেন্ড বললে সবার আগে যার কথা আমার চোখে ভেসে ওঠে সে হল সাহিন জামান। আমার কলেজ জীবনের বন্ধু। কলেজে প্রথম দিন থেকে শেষ দিন পর্যন্ত আমার প্রতিটি মূহুর্তের সঙ্গী। এটা বলতেই পারি আমার কলেজ লাইফ হয়তো এতটা সুন্দর হতনা যদি না সাহিন থাকত।
আমাদের বন্ধুত্বের শুরুটাও খুব অদ্ভুতভাবে। প্রথম দিন কলেজে গেছি। নতুন নতুন ছেলেমেয়েদের সাথে আলাপ হচ্ছে। আড্ডা গল্প হচ্ছে। এমন সময় কথায় কথায় আমি কি একটা যেন চলতি গালাগালি দিয়ে দিয়েছি। কলেজে যেমন হয় আরকি বন্ধুদের মধ্যে। হঠাৎ শুনি পাশের থেকে কে যেন বলছে‚
এসব বলতে নেই। গুনাহ হয়।
এই কেরে তুই?
ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি ঠিক পরের বেঞ্চে একটা গোলগাল চেহারার ফর্সা মতো ছেলে‚ ভাজা মাছটি উল্টে খেতেও জানেনা এমন আহ্লাদী মুখভঙ্গী বানিয়ে বসে আছে।
সেই প্রথম দেখা ওর সাথে। তবে তখনো ভদ্রলোককে চিনতে ঢের বাকি ছিল।
আমাদের কলেজটা ছিলো পুরো রাজ্যের মধ্যে মার্কামারা। সংগত কারণেই নাম বলছিনা। দুটো পৌরসভার মাঝামাঝি অবস্থিত হওয়ায় দুই পৌরপিতা তথা রাজনৈতিক নেতার কাছেই এই কলেজটা ছিলো আধিপত্য আর দাপট দেখানোর কেন্দ্রবিন্দু! প্রতি সপ্তাহে একবার করে আমাদের কলেজে ঝামেলা হবেই হবে। আর মাসে একবার করে নিউজপেপারে নাম উঠবে। নিত্যনৈমিত্তিক বিষয় ছিলো এগুলো।
তা আমরা কলেজে যাওয়ার দ্বিতীয় সপ্তাহের ঘটনা। একদল ছেলে দেখলাম কোথা থেকে ঢুকল। হাতে লাঠি - উইকেট - হকিস্টিক। এসে আমাদের বলল তোরা বেরিয়ে যা‚ আমাদের কিছু কাজ আছে। হাবেভাবে বুঝলাম ওরা এখন ক্যাম্পাস ভাংচুর করবে। তাড়াতাড়ি সবাই বেরিয়ে গেলাম। এমন সময় সভয়ে আর সবিষ্ময়ে দেখলাম আমাদের জামান ভাই একজন উইকেটধারীর সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। তাকে বোঝাচ্ছে যে ওর এখন একটা খুব প্রয়োজনীয় অঙ্ক ক্লাস আছে। এখনো চোখ বন্ধ করলেই দেখতে পাই সেদিন উইকেটধারীটি যেভাবে উইকেটটাকে তুলেছিল‚ তা যদি সময়মতো থেমে না যেত তাহলে সেদিনই আমার বন্ধুটির ইহলীলা সাঙ্গ হয়ে যেত। আমি সামনে ছিলাম‚ খুব তাড়া ওকে টেনে হিঁচড়ে বাইরে নিয়ে আসি ওখান থেকে। মোটামুটি সেদিন থেকেই আমাদের বন্ধুত্ব হওয়া শুরু।
আমরা দুজন ছিলাম যাকে বলে একেবারে বিপরীত মেরুর বাসিন্দা। তবু যে কিভাবে বন্ধুত্ব হয়ে গেছিল সেটা এখনো মাঝেমধ্যে ভাবি। হয়তো প্রকৃতিতে ধনাত্মক চার্জ আর ঋণাত্মক চার্জের আকর্ষনের মতো এটাও ছিলো একটা স্বাভাবিক ঘটনা।
পুরো কলেজ জীবনেই সাহিন ছাড়া আমি ছিলাম অচল।
কোথাও ঘুরতে যাব‚ ডাক সাহিনকে। ক্লাসে বসে বিরক্ত হচ্ছি‚ বাইরে বেরোতে ইচ্ছা হচ্ছে‚ একবার শুধু ইঙ্গিত দে সাহিনকে। টাকা ধার লাগবে‚ সাহিনকে বল। কোনো টিচারের নোটস লাগবে‚ সাহিনকে সেখানে ভর্তি করিয়ে নোক্স এক্সচেঞ্জ করে নে‚ কোনো মেয়েকে পছন্দ হয়েছে‚ তার ফোন নাম্বার লাগবে‚ সাহিনকে পাঠিয়ে দাও কোনো ছুতোয় নাম্বার চাইতে‚ অনলাইন থেকে কিছু কিনতে হবে‚ সাহিনের ক্রেডিট কার্ড দিয়ে কেন - মোটামুটি সব বিষয়েই সাহিন ছিলো আমার সবথেকে বড় ভরসার স্থল।
হ্যাঁ শুধু যে সুবিধা নিয়েইছি তা না। আমিও যতটা সম্ভব করেছি ওর জন্যে। সাহিনের ব্যবসার ধারণা আর প্রাথমিক মূলধন আমারই দেওয়া। একদিন ওদের বাড়িতে গিয়ে দেখলাম বিশাল উঠোন ফাঁকা পড়ে আছে। দেশী মুরগি পুষতে বললাম। তখন ওর হাতে টাকা ছিলো না‚ কিছু টাকাও দিয়ে আসলাম মুরগি কেনার জন্যে। এখন ওর বাড়ির মুর্গি ফার্মের উপর আরো দুটো পরিবারের খরচ চলে। ওর বাড়িতে দুর্ঘটনা ঘটলে হাসপাতালে যাওয়া থেকে শুরু করে পরবর্তীতে শহর থেকে ওষুধ কিনে দেওয়া পর্যন্ত আমিই সব করেছি। ওর একটা দোকান দেওয়ার পরিকল্পনা ছিলো। আমি প্রয়োজনীয় সাহায্য দেব বলেছিলাম। যদিও শেষ পর্যন্ত তা আর হয়নি। এমনকি ওর যে একটা সুবোধ খোকা টাইপ মানসিকতা ছিলো‚ সেটাও আমারই ভাঙ্গা। ট্রেনের দরজায় দাঁড়ানোর মজা থেকে শুরু করে রাত জেগে বন্ধুদের সাথে ঠাকুর দেখার আনন্দ -.এসবই আমিই ওকে শিখিয়েছি।
তবে কিনা কলেজের পর যোগাযোগ অনেক কমে গেল। ওর বাড়ি আর আমার বাড়ির দূরত্ব অনেক। ওর আর আমার কাজের জগত আলাদা। কাজের সময়ও আলাদা। তাই অবসর সময়ও আলাদা। সেইজন্যে যোগাযোগটুকু আছে কিন্তু আগের মতো ঘনিষ্ঠতা আর নেই।
আশা রাখি জীবনের ব্যস্ততা ঝেড়ে ফেলে আবারও কোনোদিন ওর সাথে একইরকম সুন্দর সময় কাটানোর সুযোগ হবে।
যাকগে বেশি লম্বা করব না লেখাটা। ওকে নিয়ে যত স্মৃতি আছে যদি শুরু করি তাহলে শেষ হওয়া মুশকিল। তাই নিয়ন্ত্রণ রাখা ভালো। তবে এই কনটেন্ট লেখার সময়ই ইচ্ছা হল খুব তাড়াতাড়িই ওকে নিয়ে একটা সিরিজ লিখব। দেখি কেমন দাঁড়ায় সেটা।
আমি @bull1 পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায় থাকি। বয়স ২৮ বছর। ছাত্রজীবনে ইতিহাসে আর অঙ্কে গ্র্যাজুয়েট কমপ্লিট করেছি। এখন শিক্ষকতা করি। আর টুকটাক লেখালেখি করার অভ্যাস আছে।
প্রথমে এত সুন্দর কনটেস্ট অংশগ্রহণ করার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ জানাই। আপনার ফেলে আসা জীবনের বন্ধুত্বের স্মৃতি পড়ে সত্যি খুব ভালো লাগলো। আসলে কিছু কিছু স্মৃতি কখনো ভুলা যায় না। এত চমৎকার পোস্ট আমাদের মাঝে শেয়ার করার জন্য আপনাকে অনেক অনেক অভিনন্দন জানাই।
Downvoting a post can decrease pending rewards and make it less visible. Common reasons:
Submit
হ্যাঁ সত্যিই তাই। কিছু কিছু স্মৃতি সারা জীবনের জন্যে মনের মধ্যে গেঁথে যায়। ধন্যবাদ আপনাকে।
Downvoting a post can decrease pending rewards and make it less visible. Common reasons:
Submit