অর্থ ভার বহন অতি কঠিন||

in hive-129948 •  2 years ago 

আমার বাংলা ব্লগের বন্ধুরা কেমন আছো, আশা করছি সবাই ভালো আছো, আমি তোমাদের ভালোবাসাতে বেশ ভালো আছি। আজ আবার চলে এলাম তোমাদের সামনে আমার নতুন লেখা নিয়ে। আজকে আমি তোমাদের সামনে শেয়ার করব অর্থ ভার বহন অতি কঠিন শিরোনামে বাস্তব অভিজ্ঞতার আলোকে একটি গল্প। গল্পটি আমার এক পরিচিত আত্মীয়র জীবনে ঘটে যাওয়া একটি ঘটনা যা আজ আমি আপনাদের সামনে উপস্থাপন করতে যাচ্ছি, আশা করি শিক্ষণীয় গল্পটি পড়ে আপনাদের কাছে ভালো লাগবে।
money-1604921_960_720.jpg
Source
আক্তার মিয়া গ্রামের অতি সাধারণ পরিবারে বেড়ে উঠা ২০ বছর বয়সী যুবক,পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে সবার ছোট সে। বেশ কয়েক বছর আগে বাবা মারা যাওয়ার পর মার সাথে থাকে। তিন ভাই বিয়ে করে আলাদা সংসার করছে এবং একমাত্র বোন বিয়ের পর শ্বশুর বাড়ি থাকে। পরিবারের একমাত্র অবহেলিত ব্যক্তি যে নিজের মায়ের সাথে থাকে অভাবের সংসারে, টুকটাক কৃষি কাজ করে মা ছেলের খাওয়া-দাওয়া মোটামুটিভাবে চলে যায়। আক্তার মিয়া গ্রামে ভদ্র এবং নম্র স্বভাবের মানুষ হিসাবে সবার কাছে পরিচিত।

যে ঘটনাগুলো উল্লেখ করছি সেগুলো আশির দশকের শেষের দিকের ঘটনা, সে সময় গ্রামে খুব বেশি টাকা উপার্জনের ক্ষেত্র না থাকায় কিছুটা অভাব-অনটনে দিন যাচ্ছে তাদের। ভাইদেরও তেমন বেশি ইনকাম না থাকায় তারাও সহযোগিতা করতে পারছে না। এমন পরিস্থিতিতে মা একদিন ছেলে আক্তার মিয়া কে পরামর্শ দিলেন গ্রামের ধনী ব্যক্তি সিরাজ সিকদারের ঢাকায় যে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান আছে সেখানে চাকরি নেয়ার জন্য। গ্রামের অনেক যুবকই তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে চাকরি করে ভালো দিন যাপন করছে, কিন্তু সিরাজ সিকদার সেভাবে আক্তার মিয়া কে চিনে না। মা সিরাজ সিকদারের একসময়কার বন্ধু আক্তার মিয়ার ছোট চাচাকে অনুরোধ জানালো তার ছেলেকে চাকরি দেয়ার ব্যাপারে তার বন্ধুর সাথে কথা বলতে। কিছুদিন পর সিরাজ সিকদার পরিবার নিয়ে গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিল সে সময় আক্তার মিয়ার ছোট চাচা সিরাজ সিকদারের বাড়িতে তাকে নিয়ে যায় চাকরির ব্যাপারে কথা বলতে। সিরাজ সিকদার বন্ধুর অনুরোধে সাড়া দিয়ে আক্তার মিয়া কে চাকরি দেয়ার আশ্বাস দেয় এবং পরবর্তী মাসে ঢাকা আসতে বলে।
cafe-1869656_960_720.jpg
Source
আক্তার মিয়া তার মালিক সিরাজ শিকদারের কথামতো তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে যোগদান করে, যেখানে মাসিক পারিশ্রমিক ছাড়াও এক্সট্রা ভালো টাকা ইনকাম করা যায়। এভাবে চাকরিতে যোগদানের পর তার মাকে নিয়ে খুব ভালোভাবে দিন যাপন করছে। চাকরিতে বেতন বাদেও যেহেতু অতিরিক্ত ইনকামের সুযোগ ছিল যেটা খুব ভাল অঙ্কের টাকা। প্রায় চার থেকে পাঁচ বছর পর তার কাছে অনেক পরিমাণে টাকা ইনকাম করার সুযোগ আসে এবং চাকরি থেকে ইনকাম করা অনেক ক্যাশ টাকা জমা হয়ে যায় তার কাছে। কিছুদিন বাদে ঢাকা শহরে থাকার জন্য মাকে নিয়ে এসেছে, ইতোমধ্যে গ্রামের বাড়িতে খুব ভালো করে ঘর তুলেছে, অন্য ভাই-বোনদের সহযোগিতা করছে টাকা দিয়ে। ঢাকার পাশাপাশি গ্রামের বাড়িতেও বেশ ভালো সম্পত্তি করে তুলেছে। পরিবারের সবাই একত্রিত হয়ে তার জন্য বিবাহ ঠিক করে গ্রামের বাড়িতে। সে দামি বাসা ভাড়া করে পরিবার নিয়ে ঢাকা থাকে মা সহ। দামি দামি রেস্তোরাঁতে খাবার খায়, দামি দামি পোশাক পরে একটা পর্যায়ে এমন হয় যে গ্রামে তাঁর পরিচিতি লাভ করে আখতার সাহেব নামে।

হঠাৎ করে কিছুদিন বাদে তার ভিতরে কিছু পরিবর্তন লক্ষ করা যায়, যেমন গরীব মানুষেরা তার কাছে সহযোগিতার জন্য আসলে তাদেরকে অবজ্ঞা করত, ভিক্ষুকদের ভিক্ষা দিতে চাইতো না, সহযোগিতার জন্য কেউ আসলে বলতো এটা টাকা ইনকামের ধান্দা, ধর্মীয় কোন অনুষ্ঠানের জন্য টাকা চাইতে আসলে তাদের সাথে দেখা করত না। এমনকি পরিবারের অন্য ভায়েরা যেহেতু কৃষি কাজ করতো সেজন্য তাদের কে ঢাকায় আসতে বলতো না এবং বাড়িতে গিয়ে তাদের বাসায় খাবার খেতো না। সবার সাথে মিশত না বিশেষ করে যাদের অর্থ কম ছিল। হঠাৎ তার এই পরিবর্তনে মানুষের কাছে সমালোচিত হতে লাগল, পরিবারের সদস্যরাও তার এ আচরণে খুশি ছিল না। তার কিছু বাজে লোকের সাথে পরিচয় হয় এবং তাদের সাথে বিভিন্ন বারে গিয়ে মদ খাওয়া এবং জুয়া খেলতে শুরু করে। বিভিন্ন খারাপ নেশার প্রতি প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ে অর্থাৎ অবৈধ পথে অর্থ ব্যয় করতে থাকে। তার এই এলোমেলো কর্মকাণ্ডের প্রভাব চাকরিতে পড়তে শুরু করে এবং বিরক্ত হয়ে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিক সিরাজ সিকদার তাকে চাকরি থেকে সরিয়ে দেয়।
man-937665_960_720.jpg
Source
তার স্ত্রী ও মা বিষয়টি বুঝতে পেরে অনেক বোঝানোর চেষ্টা করে কিন্তু তাদেরকে এখন আর সেভাবে দাম দেয় না উপরন্ত খারাপ ব্যবহার করে। পরিস্থিতি এখন এমন হয়ে পড়েছে যে সে এখন উপার্জিত অর্থ এবং সম্পত্তি নষ্ট করতে শুরু করেছে। মা একটা পর্যায়ে তার প্রতি বিরক্ত হয়ে গ্রামের বাড়িতে চলে আসে। ঢাকার সম্পত্তিগুলো বিক্রি করে দেয়ার পর গ্রামের সম্পত্তি বিক্রি করতে শুরু করে। গ্রামের সম্পত্তি বিক্রি করতে করতে শেষ পর্যন্ত মাকে নিয়ে থাকার শেষ অবলম্বন পৈত্রিক সূত্রে পাওয়া বসতভিটা বিক্রি করে দেয় সিদ্ধান্ত নেয়। উল্লেখ্য অন্য ভাইয়েরা যেহেতু কিছুটা সচ্ছলতা অর্জন করেছে সে জন্য খুশি হয়ে ছোট ভাইকে পত্রিক সূত্রে পাওয়া বসতভিটা লিখে দিয়েছিল বাড়ি বানানোর জন্য। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আক্তার মিয়া তাও বিক্রি করে দেয়।

মনের রাগে মা এবং অন্য ভাইয়েরা আক্তার মিয়ার সাথে বেশ কয়েকবছর যোগাযোগ রাখে না, সে পরিবার নিয়ে ঢাকায় থাকতো কি করত সে ব্যাপারে কেউ কিছু জানে না। হঠাৎ একদিন আক্তার মিয়া তার গ্রামের বাড়ি গিয়ে উপস্থিত। পরনে তার জীর্ণ-শীর্ণ কাপড়চোপড় ঠিকমত কথা বলতে পারেনা হাঁটতে পারে না। তাকে দেখে প্রথমে সবাই বিগত দিনের আচরণ নিয়ে তার প্রতি রাগ ছিল কিন্তু পরবর্তীতে জানতে পারে আক্তার মিয়া ব্রেন টিউমারে ভুগছে ডাক্তার তার আশা ছেড়ে দিয়েছে। ঢাকায় তার পরিবারের সাথে থাকার পরিস্থিতি নাই, তার পরিবার তাকে গ্রামের বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছে সেখানে থাকতে দেয়নি।
nature-2609726_960_720.jpg
Source
এমন পরিস্থিতি শোনার পর তার মা জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদছে আর বলছে প্রয়োজনে আমি তোকে ভিক্ষা করে চিকিৎসা করাবো মায়ের বয়স তখন ৮০ প্লাস। এভাবে মায়ের সাথে আক্তার মিয়ার তিন ভাইয়ের বাড়িতে থাকা খাওয়া চলতে থাকে। ব্রেন টিউমারের কারণে সে আস্তে আস্তে বেশি অসুস্থ হয়ে পড়লো, ডাক্তারের কাছে নেয়ার পর ডাক্তার বলেন অপারেশন ছাড়া বিকল্প কিছু নেই এবং সুস্থ হবে কিনা তাও নিশ্চিত না। সে চিকিৎসার জন্য যে পরিমাণ টাকার প্রয়োজন ছিল তার যোগান দেয়ার মত সামর্থ্য তার ভাইদের ছিল না সুতরাং বিনা চিকিৎসায় আস্তে আস্তে সে নিস্তেজ হয়ে পড়ল একটা পর্যায়। কিছুদিন পর প্যারালাইস হয়ে বিছানায় পড়ে গেল এবং তার পরিচর্যার দায়িত্ব দেয়া হল বৃদ্ধ মাকে, মা ছোট্ট বাচ্চাদের মত বৃদ্ধ বয়সে ছেলেকে পরিচর্যা করছে যা দেখে চোখের পানি ধরে রাখা মুশকিল। এভাবে কিছুদিন যাওয়ার পর হঠাৎ একদিন দুপুরের আগে সংবাদ পেলাম আক্তার মিয়া মারা গেছে। মারা যাওয়ার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত তার সন্তানেরা এবং স্ত্রী দেখা তো দূরের কথা খোঁজখবর রাখেনি। তাকে শেষ দেখা দেখার জন্য শেষ মুহূর্তে অর্থাৎ কবর দেয়ার আগে বাড়িতে গিয়ে পৌঁছায় স্ত্রী এবং সন্তানেরা, সেখানেও ঘটে এক হৃদয় বিদারক ঘটনা স্ত্রী অনুমতি দেয় না স্বামীকে কবরস্থ করার জন্য কারণ তার কাছে নাকি সে অনেক টাকা পায়।

বন্ধুরা আজ এখানেই শেষ করছি, পরবর্তী সময়ে আবার আপনাদের সামনে হাজির হব আমার নতুন লেখা নিয়ে। সে পর্যন্ত সবার সুস্বাস্থ্য ও দীর্ঘায়ু কামনা করছি, অসংখ্য ধন্যবাদ সবাইকে।

amarbanglablog.gif

Authors get paid when people like you upvote their post.
If you enjoyed what you read here, create your account today and start earning FREE STEEM!
Sort Order:  

আসলে দুনিয়াতে টাকাই সব। যে বাবা-মা একসময় অনেক কষ্ট করে সন্তান দেরকে লালন পালন করে, সে সন্তানরা একসময় বাবা মাকে ছুড়ে ফেলে দেয়। তখন তারা বউ সন্তান এবং অর্থ পয়সা নিয়ে ব্যস্ত থাকে। কিন্তু শেষে আক্তার মিয়াকে তার মা ই দেখা শুনা করেছে। সবশেষে খুব খারাপ লাগলো আক্তার মিয়ার মৃত্যুর খবর শুনে,এবং সবার শেষে সেই হৃদয় বিতরক ঘটনা শুনে।টাকা ছাড়া দুনিয়াতে কেউই আপন না।

মানুষ কিভাবে পারে বাবা মাকে এরকম কষ্ট দিতে। যে বাবা মা সন্তানদের ছোট থেকে অনেক কষ্ট করে বড় করে তাদেরকে তারা বড় হলে অনেক কষ্ট দেয়। সত্যি এরকম ঘটনাগুলো শুনলে আমার খুবই খারাপ লাগে আমার কাছে। খুবই খারাপ লাগলো আক্তার মিয়ার মৃত্যুর খবর শুনে। সত্যি ছেলেমেয়েরা কখনও বাবা মায়ের কষ্ট বোঝার চেষ্টা করেনা। সবশেষে তো ওনার মা ওনার দেখাশোনা করেছে। খুবই সুন্দর ভাবে এই গল্পটি লিখেছেন। এরকম গল্প গুলো অনেক কষ্টকর হয়ে থাকে যেগুলো করলে খুবই কষ্ট লাগে।