আসসালামু আলাইকুম। কেমন আছেন সবাই। আশা করি সবাই ভালভাবেই দিনাতিপাত করছেন। "চেম্বার কথন" সিরিজের আরেকটি পোস্ট নিয়ে আপনাদের সামনে হাজির হলাম আবার। এখানে আমি আমার চেম্বারে পরামর্শ দেয়া কোন একটা রুগীর রোগ সম্পর্কিত একটা ছোট গল্প বলি। গল্পের শেষে এর আলোকে শিক্ষণীয় বিষয়গুলো পয়েন্ট আকারে উল্ল্যেখ করি। চলুন শুরু করা যাক।
দুর্ভাগা এবং মারাত্মক ঝুকিপূর্ণ একটা রুগীর গল্প যিনি গ্যাংগ্রীনে ভুগছেন!!
গ্যাংগ্রীন একটা ভীতিকর শব্দ। সাধারণ মানুষও এটা শুনে আঁতকে ওঠে। শরীরের কোথাও গ্যাংগ্রীন হওয়া মানে সহজ বাংলায় পঁচে যাওয়া। গ্যাংগ্রীন হয়ে পঁচে যাওয়ায় পা কেটে ফেলতে হয়েছে এমন অনেক ঘটনা আছে আমাদের আশেপাশে। আজকের গল্পের রুগীর গ্যাংগ্রীন একটু ভিন্ন যায়গায়। আরো বিপদজনক!
৫৫ বছর বয়স্ক একজন রুগী। এখানে একটা কোম্পানীতে চাকুরিরত। যেদিন আমার কাছে এসেছিলেন তার ২-৩ দিন আগ থেকে উনার প্রাইভেট এরিয়াতে ব্যথা এবং কিছুটা ফোলা আরম্ভ হয়েছিল। নাভির নিচ থেকে শুরু করে অন্ডকোষ পর্যন্ত ফোলা, ব্যথা এবং কিছুটা শক্ত হয়ে গিয়েছিল । এমনকি উনার পুরুষাংগও কিছুটা ফোলা আরম্ভ হয়েছিল। তখনও জ্বর শুরু হয় নাই। পেশাব-পায়খানা করতে কোন সমস্যা নাই। কোন আঘাতও লাগে নাই ঐ জায়গাগুলোতে।
আমি পরীক্ষা করে দেখলাম। পুরা এরিয়া কিছুটা শক্ত এবং গরম। কিন্তু তখনও কোন পুজ জমে নাই চামড়ার নিচে । অন্ডকোষ দুইটাই ফোলা। ইনফেকশান এর নমুনা!! মেডিকেলের ভাষায় এই স্টেইজ কে বলে সেলুলাইটিস (Cellulitis) । সেনসেটিভ লোকেশান! অবস্থা খুব একটা সুবিধার মনে হলো না।
তার সাথে কোম্পানির আরেকজন লোক ছিলেন। বিষয়টা তাদেরকে ব্যাখ্যা করলাম। শিরাতে আন্টিবায়োটিক ইঞ্জেকশান দিলাম, সাথে একটা ব্যথার ইনজেকশন । মুখে খাওয়ার ডাবল আন্টিবায়োটিক দিলাম। বলে দিলাম ২-৩ দিন অবজারভ করার জন্যে। উন্নতির দিকে যাওয়ার শুরু করলে ওষুধগুলোর কোর্স সম্পূর্ণ করবে। কিন্তু আরো খারাপের দিকে যাচ্ছে মনে হলে আবার আসতে হবে, দেরী করা যাবে না।
প্রথম ভিজিটের ২ দিন পর উনি আবার এসে হাজির। আগের দুই জনের সাথে তৃতীয় আরেকজন, কোম্পানির ম্যানেজার ।
কি অবস্থা? আরো অবনতি হয়েছে??
আবার দেখলাম। নাভির নিচ থেকে শুরু করা পুরা এরিয়া ফুলে ঢোল!! অন্ডকোষ ফুলেছে কয়েকগুণ! বিভিন্ন জায়গায় ছোট ছোট ক্ষত হয়েছে যেখান দিয়ে হলুদ রঙের পুঁজ উকি মারছে! পূর্ববর্তী শক্ত এলাকা নরম হয়েছে বেশ কিছুটা (মানে চামড়ার নিচে পুঁজ জমেছে)।
ফরনিয়ার গ্যাংগ্রীন !! অনেকদিন পর এমন একটা কেস পেলাম। ডাক্তারী পাশের পর ইন্টার্নিশিপ এ সার্জারী ডিপার্টমেন্টে প্লেসমেন্ট এর সময় বেশ কিছু রুগী পেয়েছিলাম। প্রতিদিন ড্রেসিং করা লাগত প্রচন্ড দুর্গন্ধ যুক্ত এই ক্ষত গুলো।
ফরনিয়ার গ্যাংগ্রীন ঐ গ্যাংগ্রীনকেই বলা হয় যেটা আক্রান্ত করে গোপনাংগের আশেপাশের এলাকাকে। নাভির নিচ থেকে শুরু হতে পারে। পায়ুপথের চারপাশেও ছড়িয়ে পড়তে পারে।
যাহোক! রুগীর গল্পে ফিরে আসি। প্রশ্ন করে জানতে পারলাম উনার সিস্টেমিক সিম্পটমও (systemic symptoms) শুরু হয়েছে, যেমন খেতে পারছে না, বমি বমি লাগছে, জ্বর আছে ইত্যাদি। সবমিলিয়ে "বাসায় রেখে মুখে খাওয়া ঔষধ" দিয়ে চিকিৎসা করার পর্যায় পার হয়ে গেছে উনার। তাকে বাঁচাতে হলে জরুরী ভিত্তিতে হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে, পঁচা অংশগুলো অপারেশন করে ক্লিন করতে হবে, পাওয়ারফুল এন্টিবায়োটিক দিতে হবে শিরায়, প্রাথমিক অপারেশন শেষে ইনফেকশন নিয়ন্ত্রণে আসার পর নিয়মিত ড্রেসিং করতে হবে- মাল্টিডিসিপ্লিনারি ম্যানেজমেন্ট লাগবে।
রুগীসহ সবাইকে পুরো বিষয়টা এক্সপ্লেইন করলাম। একটা জরুরি রেফারেল লেটার লিখে দিলাম। আর কালবিলম্ব না করে ঐ রাতেই টারশিয়ারি হাসপাতালে ভর্তি করার জন্য সেই কোম্পানি-ম্যানেজারকে তাগাদা দিলাম। তারা রাজি হল এবং বিদায় নিল।
ততক্ষণে মাগরিবের আযান হয়ে গেছে। শরবতের বোতল খুলে কয়েক ঢোক শরবত খেয়ে রোজা ভাংগলাম। শুকরিয়া আদায় করলাম আল্লাহর কাছে, আমাকে ঐ রুগীর মত অবস্থায় পতিত হওয়া থেকে হেফাজত করার জন্যে!
এই গল্পের আলোচ্য রোগ সম্পর্কিত কিছু উল্লেখযোগ্য পয়েন্ট যা আমাদের কাজে লাগতে পারে।
- ফরনিয়ার গ্যাংগ্রীনে আক্রান্ত রুগীর মৃত্যু হার অনেক বেশী। একটা স্ট্যাডি মোতাবেক দেখা গেছে যে ১০০ জন আক্রান্ত রুগীর মধ্যে ৭৫ জনই মারা গেছে!
- সর্বপ্রথম ১৮৮৩ সালে ফ্রান্সের ভেনেরিওলজিস্ট জিন আলফ্রেড ফরনিয়ার এই ধরণের ৫ টা রুগীর ইতিহাস বর্ণনা করেন। তার নামানুসারেই এই রোগের নাম রাখা হয় ফরনিয়ার গ্যাংগ্রীন।
- ফরনিয়ার সাহেব প্রথমে মনে করেছিলেন যে এটা শুধু যুবক বয়সের রুগীদেরই হয় যারা আনসেফ (Unsafe) সেক্সসুয়াল কর্মকান্ডের সাথে নিয়োজিত। কিন্তু পরবর্তীতে দেখা গেছে যে এটা যেকোন বয়সের লোকেরই হতে পারে। আনসেফ সেক্সসুয়াল প্র্যাকটিসের ইতিহাস না থাকলেও হতে পারেন।
- পরীক্ষা করে দেখা গেছে যে, ফরনিয়ার গ্যাংগ্রীনে কালপ্রিট অনেক গুলো জীবানু একসাথে আক্রমণ করে। ব্যক্টেরিয়া এবং ফাঙ্গাস উভয় জীবানুই পাওয়া গেছে যেগুলো বিভিন্ন ড্যামেজিং কেমিক্যাল নিঃসরণ করে। ফলে এটা অতি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। আশেপাশে যেমন ছড়ায়, তেমনি গভীরে চলে যায়। ফলে চামড়া, মাংশ সব পঁচতে আরম্ভ করে দ্রুত।
- এই ক্ষতগুলো থেকে প্রচন্ড রকমের দুর্গন্ধ বের হয়। সরকারী মেডিক্যালগুলোতে দেখেছি এধরণের রুগীদেরকে বাইরে বারান্দায় ফেলে রাখে। কি যে দুর্ভোগ! প্রতিদিন ড্রেসিং করাও ডাক্তারদের জন্যে কম ভোগান্তির নয়। দুর্গন্ধের পাশাপাশি অনেক সময় লাগে এক একটা ফরনিয়ার গ্যাংগ্রীন পেশেন্টের ড্রেসিং সম্পুর্ণ করতে।
- ফরনিয়ার গ্যাংগ্রীনের আগের এবং পরের জীবন (সেরে উঠলেও) কখনই সমান হয় না। প্রাইভেট কাজে বিভিন্ন জটিলতা দেখা দেয়।
- দ্রুত রোগ ধরা, শুরু থেকেই ভিগরাস (vigorous) ম্যানেজমেন্ট (সার্জারী এবং এন্টিবায়োটিক) করা অত্যন্ত গুরুত্ব পূর্ণ। একটুখানি অবহেলা হলেও রুগীর জীবন বিপন্ন হয়ে উঠতে পারে!
ওকে। আজকে এ পর্যন্তই। আশা করি কিছু নতুন তথ্য পেয়েছেন আমার পোস্ট থেকে। কোন পরামর্শ বা প্রশ্ন থাকলে কমেন্ট এর মাধ্যমে জানাবেন। ভাল থাকুন।
আল্লাহ হাফেজ
ডা. হাফিজ
ওমান
ফরনিয়ার গ্যাংগ্রীনের ছবি দেখতে চাইলে গুগল সার্চ দিন fournier gangrene লিখে। এই ছবিগুলো এতো ডিসর্টাবিং যে, By deault গুগল এগুলোকে ব্লার করে দেয়।
চেম্বার কথন সিরিজের পূর্ববর্তী পোস্টঃ
পেশাব এবং তলপেটের ব্যথা নিয়ে আসা এক রুগীর গল্প
আমি ডা. হাফিজ। ঢাকার একটা মেডিকেল থেকে ডাক্তারী পাশ করেছি। ২০১৪ সাল থেকেই দেশের বাইরে আছি। শুরুতে ২ দুই বছর ছিলাম মালদ্বীপে। তারপর থেকে ওমানে আছি গত ৭ বছর ধরে। এখানে একটা পলিক্লিনিক এ জি.পি. ডাক্তার হিসাবে কর্মরত আছি বর্তমানে।
My Discord ID: hafiz34#3722
বহু আগে যখন, পার্ট টাইম জেনারেল সার্জারি অ্যাসিস্ট করতে যেতাম, তখন একবার এরকম কেসের রোগী পেয়েছিলাম। কমপক্ষে ১৫ দিন এর মতো আমি ড্রেসিং করেছিলাম। সেকি অবস্থা বাপ রে বাপ, এখনো মনে হলে শরীর গুলিয়ে যায়।
নিজের অভিজ্ঞতার আলোকে, দারুণ লিখেছেন ভাই।
Downvoting a post can decrease pending rewards and make it less visible. Common reasons:
Submit
হুম। ফরনিয়ার গ্যাংগ্রীনের ড্রেসিং করা খুবই কষ্ট, রুগীর জন্য এবং ডাক্তারের জন্যেও।
আমাদের অনেক কলিগ বিরিয়ানী অফার করতো কেউ যদি ড্রেসিং টা করে দিত তার জন্য। 😜
ধন্যবাদ ভাই, আমার পোস্ট ভিজিট করার এবং কমেন্ট করার জন্যে।
Downvoting a post can decrease pending rewards and make it less visible. Common reasons:
Submit
অনেক ধন্যবাদ, এই রোগটির সম্পর্কে আজই প্রথম জানলাম আপনার লেখার মাধ্যমে, খুব সুন্দরভাবে বিষয়টি উপস্থাপন করেছেন এবং প্রয়োজনীয় দিক নির্দেশনা শেয়ার করেছেন। তবে একটু মার্ক ডাউন ব্যবহার করলে লেখাগুলো আরো কিছুটা সুন্দর হতো।
Downvoting a post can decrease pending rewards and make it less visible. Common reasons:
Submit
ধন্যবাদ ভাই।
মার্ক ডাউন ব্যবহার করেই তো লিখলাম।
আর একটু যদি স্পেসিফিক করে বলতেন তা হলে নেক্সট পোস্ট এ ব্যবহার করতে পারতাম।
Downvoting a post can decrease pending rewards and make it less visible. Common reasons:
Submit
text-justify এর মার্কডাউন ব্যবহার করলে প্যারাগ্রাফগুলো দেখতে আরো কিছুটা সুন্দর লাগতো।
Downvoting a post can decrease pending rewards and make it less visible. Common reasons:
Submit