'বর্তমান/বিলুপ্তপ্রায় স্থানীয় লোকসংস্কৃতির ঐতিহ্য'-মৃৎশিল্প ||১০% বেনিফিট @shy-fox এর জন্য

in hive-129948 •  3 years ago 

বর্তমানে বিজ্ঞান ও উন্নত প্রযুক্তির চাদরে ঢেকে গেছে বহু স্থানীয় লোকসংস্কৃতির ধারাবাহিকতা এবং সেই সংস্কৃতির ঐতিহ্যের মূলধারা। বর্তমানের বহু পিছনে ফেলে আসা এই ইতিহাস, যা উৎস ,তার সংরক্ষণের দায়িত্ব আমাদের প্রত্যেক জেনারেশনের। কিন্তু নিজের শহর /নিজের জায়গার ঐতিহ্য সংরক্ষণের দায়িত্ব নেওয়াও বড় জটিল এই কর্মব্যস্ত জীবনে। তাই বহু বিখ্যাত এবং গুরুত্বপূর্ণ মূল্যবান সংস্কৃতি বিলুপ্ত হয়ে যেতে ধরেছে।

আমার বাবার সো রুম থেকে তোলা ছবি

IMG_20210904_194754.JPG

আজ আমি আপনাদের সকলের সাথে শেয়ার করতে চলেছি আমার শহর কৃষ্ণনগরের প্রায় বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া এক গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহ্যের কথা। আমার শহর ' কৃষ্ণনগর 'জলঙ্গী নদীর তীরে অবস্থিত , পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলার সদর শহর। এই শহরের সংস্কৃতি ও ঐতহ্য হল হস্তশিল্প পোড়া মাটির পুতুল। যার প্রধান ঘাঁটি এই শহরের ' ঘূর্ণী 'নামক জায়গা। এই প্রাচীন শিল্প শত শত বছর ধরে সফলভাবে এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মে র দ্বারা বয়ে চলেছে। এই এলাকায় প্রায় ৬০০ মৃৎশিল্পী পরিবার আছে।

ঘূর্ণী ( পুতুল পট্টি)

IMG-20210905-WA0016.jpg
মানচিত্র সহযোগে অবস্থান -
https://w3w.co/minority.fights.chimp

IMG-20210905-WA0019.jpg

শোনা যায় কৃষ্ণনগরের রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের সময়ে ,১৭৫৭ সালেরও আগে, নাটোর থেকে বহু শিল্পীরা তার রাজ সভায় যাতায়াত করতো।এরপর ধীরে ধীরে তারা এখানে বসবাস করতে শুরু করে। রাজা কৃষ্ণচন্দ্র ছিলেন শিল্প প্রেমিক। তার অনুপ্রেরণার দ্বারা শিল্পীদের হাতে তৈরি হয় মা কালীর মূর্তি । আর তারপর থেকেই এই শিল্প কৃষ্ণনগর এর প্রাণ হয়ে ওঠে।

আমার পাড়ার কাকুর বাড়ির ছবি,কাকু কাজ করছেন

IMG_20210904_200811.JPG

কৃষ্ণনগর এই মৃৎশিল্পের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো শিল্পীরা তাদের শিল্পকলার মাধ্যমে যুগ যুগ ধরে তুলে ধরেছেন, গ্রামবাংলার প্রাত্যহিক জীবিকার প্রতিচ্ছবি - চাষী ,কুমোর,কামার ,বৈষ্ণব ,সাধু,পথিক ,ভিখারিনী ,পূজারী,সবজি বিক্রেতা ইত্যাদি। এইভাবে বাঙালির সমাজ এর চরিত্রগুলি ছোট ছোট আকারে ফুটিয়ে তুলেছেন এই অঞ্চলের শিল্পীরা ।ইংরেজিতে যেটাকে বলে হিউম্যান ফিগার ।

IMG_20210904_194832.JPG

এই ছোট ছোট মাটির পুতুলের সাইজ কোনটা 6 ইঞ্চি। কোনটা 4 ইঞ্চি। কোনটা আবার 9 ইঞ্চি ।নিখুঁত কাজের মাধ্যমে শিল্পীর শিল্প পৃথিবীর বহু মানুষকে এই অঞ্চলে বারেবারে টেনে এনেছে ।কৃষ্ণনগরের গর্ব এই মাটির পুতুল। এর সাথেই আরো বিভিন্ন ধরনের মাটির জিনিস এখানে শিল্পীরা বানিয়ে থাকেন- বিভিন্ন ধরনের ঠাকুরের মূর্তি থেকে শুরু করে ফল ,পাখি, পশু, মহাপুরুষ।

IMG_20210904_194857.JPG

কিন্তু বর্তমানে এই সংস্কৃতির অবস্থা খুবই শোচনীয়। বিভিন্ন ধরনের ঠাকুর পুজোর আগে মূর্তি তৈরি করার একটি বিরাট পর্ব ঘূর্ণী তে দেখতে পাওয়া যায়। কিন্তু এই ঠাকুরের মূর্তি তৈরি আসল সংস্কৃতি নয়। সংস্কৃতি হলো ওই ছোট ছোট চরিত্র গুলি ,যেগুলি শিল্পীরা মাটি দিয়ে তাদের নিপুণ দক্ষতায় মাধ্যমে আকার দিয়েছেন এতদিন।

আমার পাশের বাড়ির কাকু কাজ করছেন

IMG_20210904_200954.JPG

কিন্তু যেহেতু শিল্পের সাথে এই অঞ্চলের জীবিকাও জর্জরিত ।এই অঞ্চলের প্রত্যেক পরিবার মাটির কাজের মাধ্যমেই তাদের জীবিকা নির্বাহ করেন ।তাই সংস্কৃতির ওপর একটা কালো অন্ধকারের ছাপ আমরা বর্তমানে লক্ষ্য করছি ।ছোট ছোট হিউম্যান ফিগার গুলো থেকে বেশি লাভ এনারা করতে পারেন না ।বড় মূর্তির বিক্রি করে যতটা লাভবান হওয়া যায় সেই তুলনায় এই ছোট মূর্তির থেকে লাভ অনেকটা কম। এর পাশাপাশি খাটনি বেশি, অত ছোট কাজ করতে গেলে ধৈর্য দরকার, আর এত কিছুর পরও যখন হাতে এসে পৌঁছয় না স্বাভাবিক এবং ইচ্ছা পূর্ণ রোজগার ।তখন মানুষ হারিয়ে ফেলে তার মনের জোর। ঘূর্ণির এখন বেশিরভাগ শিল্পীরায় দেশে-বিদেশে অথবা নিজস্ব বড় বড় কারখানাতে বড় মূর্তির কাজ করে থাকেন। এখানে এখন ফাইবার গ্লাস, সিমেন্ট ,পিতল ও পাথরের বড় বড় মূর্তির কারখানা দেখতে পাওয়া যায় ।

IMG_20210904_200655.JPG

এখানে রয়েছে প্রচুর দোকান। দোকান ভর্তি ছোট পুতুলের সাজে হারিয়ে যাওয়া সেই গ্রাম বাংলার চরিত্রগুলোকে আমরা মাঝে মাঝে খুঁজে পাই। যে সব শিল্পীরা এইসব বানান তাদের অবস্থা অর্থনৈতিক ভাবে জটিল। তাই তাদের পরবর্তী প্রজন্ম এই কাজের সাথে যুক্ত হতে চান না। বর্তমান পরিস্থিতিতে তাই এই শিল্পকে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে রাখা বড়ই মুশকিল হয়ে দাঁড়াচ্ছে।

IMG_20210904_194914.JPG

আমি নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলছি ,আমার বাবা কৃষ্ণনগরের একজন জ্ঞানী মানি মৃৎশিল্পী ।বাবা যদিও জাতিতে কুমোর নন ।কিন্তু ছোট থেকেই এই শিল্পের প্রতি তাঁর প্রবল ভালোবাসা ছিল ।ছোটবেলায় শহরের মৃৎশিল্প ,গ্রাম বাংলার চরিত্রগুলোকে নিয়ে বাবা অনেক কাজ করেছেন । আর বাকি শিল্পীদের মতো যখন রোজগারের দিকে টান পড়ে, তখন বাবাকেও বাধ্য হয়ে এই ছোট হিউম্যান ফিগার এর কাজ ছাড়তে হয় ।বাবা শুরু করেন বড় মূর্তি তৈরি ।সে কাজে রয়েছে রোজগারের এক বড় রাস্তা ।আর সেখান থেকেই আমার বাবার ছোট মূর্তি তৈরি অবসান ঘটে ।তাই বলে এমন নয় যে তিনি বানাতে পারবেন না ।কিন্তু জীবিকার দিকে তাকিয়ে, পরিবারের দিকে তাকিয়ে এই রাস্তা বাবাকে বেছে নিতে হয় ।

আমার বাবার স্টুডিও/কারখানা, বাবা বড় মূর্তির কাজ করছেন।সাথে আরো কিছু দাদা কাজে মগ্ন

IMG-20210904-WA0055.jpg

আমি খুব যুক্তিপূর্ণভাবে আমাদের প্রযুক্তির বিলুপ্তির রাস্তা তুলে ধরছি ।তাই আমি এটাও বলতে দ্বিধা করবো না যে, আমার ছোটবেলা এবং আমার ভাইয়ের ছোটবেলা যেভাবে কাটছে ।তাতে আমরা বুঝতে পারছি যে আমরাও হয়তো বাবার এই শিল্পকে ধরে রাখতে পারবো না। বাবার নিজস্ব দুটো শোরুম রয়েছে কৃষ্ণনগরের বুকে ।নিজস্ব কারখানা রয়েছে। যেখানে প্রতিদিন প্রায় ১৫ টি ছেলে কাজ করে। তারসত্ত্বেও আমার এবং আমার ভাইয়ের লক্ষ্য যেখানে কিনা এই শিল্পকে বাঁচিয়ে এই শিল্পের দিকে এগোনো উচিত ছিল, আমরা এগিয়ে চলেছি পড়াশোনার পথে।

IMG_20210904_194735.JPG

ঠিক এই ভাবেই এই অঞ্চলের প্রত্যেকটা পরিবার অসহায় তাই তারা এই শিল্পের দিকে চোখ কম দিচ্ছেন। কৃষ্ণনগরের সেই ছোট্ট মাটির পুতুল লুপ্ত হয়ে যাচ্ছে ।শিল্পীরা কমে যাচ্ছে ।বড় বড় শিল্পীদের হাত ধরে যে পথ চলা শুরু হয়েছিল তা আজ জীবিকার এবং রোজগারের টানাপোড়নে হারিয়ে যাচ্ছে কোন গভীর অন্ধকারে তাই আমরা
সরকারের দিকে অপেক্ষারত। সরকার এই ছোটো মাটির পুতুল তৈরির শিল্পীদের দিকে না তাকালে কৃষ্ণনগরের এই অতি প্রাচীন ঐতিহ্য অর্থাৎ গ্রাম বাংলার চরিত্রগুলোকে মূর্তি তে রূপ দেওয়া - তার বিলুপ্তির পথ ঠেকানো মুশকিল হয়ে যাবে।

সকলকে অনেক ধন্যবাদ আমার পোস্টটি ধৈর্য্য ধরে পড়ার জন্য। সংস্কৃতির বিলুপ্তির কারণ গুলো হয়তো আমি আপনাদের সকলকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছি। আশা করছি আমার এই লেখা আপনাদের মনে জায়গা করে নেবে।
আমার শ্রদ্ধেয় @moh.arif দাদাকে অনেক ধন্যবাদ ,এমন একটি প্রতিযোগিতার আয়োজন করার জন্য। এই প্রতিযোগিতার জন্য লিখতে গিয়ে আমি অনেক কিছু বুঝতে পারলাম ,জানতে পারলাম ।নিজের চোখের সামনে নিজের ঐতিহ্যের অবসান ঘটে চলেছে -এটা এই লেখার সময় বুঝতে পেরে আমি খুবই দুঃখিত ।

নমস্কার।
@isha.ish

Authors get paid when people like you upvote their post.
If you enjoyed what you read here, create your account today and start earning FREE STEEM!
Sort Order:  

বর্তমান বিলুপ্তপ্রায় স্থানীয় লোকসংস্কৃতির ঐতিহ্য মৃৎশিল্প নিয়ে আপনি অনেক সুন্দর ভাবে বর্ণনা উপস্থাপন করেছেন।অনেক সুন্দর হয়েছে আপনার বর্ণনা।খুব ভালো লাগছে আমার কাছে।বিশেষ করে হিউম্যান ফিগার এর ছোট ছোট মূর্তি গুলো খুব সুন্দর দেখা যাচ্ছে।

আপনাকে অনেক ধন্যবাদ সুন্দর পোস্টটি আমাদের সাথে শেয়ার করার জন্য।শুভ কামনা রইলো আপনার জন্য।

অনেক ধন্যবাদ দাদা আপনার সুন্দর মন্তব্যের জন্য।

অতি চমৎকার উপস্থাপনা। লেখাটা শুরু থেকে যখন পড়তে শুরু করলাম একবার ও থামতে ইচ্ছে হয়নি। কালের বিবর্তনে আমরা আমাদের চিরচেনা সংস্কৃতিগুলো আজ হারিয়ে ফেলতে বসেছি । আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম হয়তো শুধু গল্পই শুনবে এসবের। চোখে আর দেখতে পারবে না।
প্রতিদিন অনেক পোস্টই পড়ি কিন্তু তৃপ্তি খুজে পাইনা। সত্যি আজ খুব আগ্রহ সহকারে এই পুরো লেখাটা পড়লাম। ভালোবাসা নিও। ❤️

  ·  3 years ago (edited)

আপনার যে ভালো লেগেছে। আর এটা আপনি উপস্থাপন করলেন। এই আমার অনেক বড় পাওনা।
লিখতে ইচ্ছে হলে তো ভালই লিখতে পারি। কিন্তু ওই যে মুড।
আপনার ভালোবাসা তো আমারই।

খুব সুন্দর ভাবে দারুন উপস্থাপনার সমস্ত বিষয়টি তুলে ধরে ছেন দিদি। বর্তমানে কালের বিবর্তনে এই গুলি হারিয়ে যেতে বসেছে ।কাকুর সাথে পরিচয় হয়ে ভালো লাগলো। আপনার কন্টেন্ট টা আমার কাছে বেস্ট লেগেছে। শুভেচ্ছা অবিরাম দিদি।

আপনার মন্তব্য আমাকে আরো একবার অনুপ্রেরণা দিল।অনেক ধন্যবাদ দাদা আপনার সুন্দর মন্তব্যের জন্য। ভালো থাকবেন দাদা।

বর্তমান স্থানীয় লোকসংস্কৃতির সূত্র গুলো খুব অসাধারণ ভাবে তুলে ধরেছেন। বিশেষ করে মাটির কারুকার্য গুলো খুব সুন্দর ছিল।

অসংখ্য ধন্যবাদ এমন ঐতিহ্য মাঝে মাঝে তুলে ধরার জন্য এবং খুব কষ্ট করে ছবিগুলো সংগ্রহ করার জন্য

অনেক ধন্যবাদ আপনাকে এতো ভালো মন্তব্যের জন্য।

শুভকামনা

হ্যা, এটা একদম সত্যি কথা বলেছেন, কালের বিবর্তন এবং আধুনিক প্রযুক্তির ভিড়ে এগুলো প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছে।

আমার এখনো মনে আছে, ছোট বেলায় যখন মেলায় যেতাম, তখন এই রকম নানা ধরনের পুতুলের প্রতি বেশ আকর্ষণবোধ করতাম। বাবা বকা দিতো তবুও কিনে নিয়ে আসতাম। খুব সুন্দর উপস্থাপন করেছেন। শুভ কামনা রইল আপনার জন্য।

অনেক ধন্যবাদ আপনাকে আপনার গল্প ভাগ করে নেওয়ার জন্য।

বিজ্ঞান প্রযুক্তির কারণে দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে লোকসংস্কৃতির অনেক পণ্য। তাই আপনার কথার সাথে সহমত, আর আপনার জন্য রইল প্রাণঢালা শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন। ধন্যবাদ আপনাকে।

ধন্যবাদ আপনাকে।

কালের বিবর্তনে দিন দিন এগুলো সব নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে আমাদের পৃথিবী থেকে। আপনার ছবিগুলো দেখে আমার ছোটবেলার কথা মনে পড়ে গেল। ঈদে যখন আব্বুর সাথে ঈদের নামাজ পড়তে যাইতাম ছোটবেলায়। তখন এসব জিনিসপত্র কেনার জন্য আব্বুর কাছে বায়না ধরতাম। তখন আব্বু সবগুলো আমাকে কিনে দিতেন। কিন্তু সময়ের ব্যবধানে এগুলো কেউ হারিয়েছি এমনকি জীবনের আগের অনুভূতিগুলো কেউ হারিয়েছি। শুভকামনা রইল আপনার জন্য।

অনেক সুন্দর মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ আপনাকে।

কৃষ্ণনগরের মাটির পুতুল অনেক জনপ্রিয় এটা অনেক আগেই শুনেছিলাম। এবং আজ আপনার পোস্ট থেকে অনেক তথ‍্য জানতে পারলাম। এটা ওখানকার ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতি। কে জানে কালের বিবর্তনে হয়ত এগুলো বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে। ভালো লিখেছেন দিদি।

বিলুপ্ত হওয়ার মুখেই বলতে পারেন। ধন্যবাদ পোস্টটি পড়ার জন্য।

🙂🙂🙂

বাহ!
দারুণ লাগলো আপনার পোস্ট টি দেখে
অনেক ধন্যবাদ আপনাকে এত সুন্দর করে উপস্থাপন করার জন্য

আপনাকেও ধন্যবাদ আমার পোস্টটি পড়ার জন্য।