।।নবাবী বাংলায় টাকাকড়ির ইতিহাস।।
নমস্কার বন্ধুরা। আসুন আজ আপনাদের সঙ্গে এমন একটি তথ্য শেয়ার করব যা আপনাদের বেশ চমকপ্রদ লাগবে বলেই আশা রাখছি। বর্তমানে আমি কাজ করছি মুর্শিদাবাদ ও নবাবী ইতিহাসের ওপর। প্রায় লেগে পড়ে রয়েছি নবাবী মুর্শিদাবাদের অন্দরমহলে। বাংলার নবাবী আমল এমন এক সময়, যখন অর্থে, সম্পদে এবং ক্ষমতায় বাংলা অকূল ঐশ্বর্যের অধিকারী। প্রাচীন বাংলা বলতে আপনারা সকলেই বারো ভূঁইয়ার কথা জানেন। তাদের অপরিসীম যুদ্ধ দক্ষতা এবং সেনাদলের ক্ষমতার ওপর রীতিমতো ভয় করত মোগল সাম্রাজ্যের বাদশাহরাও। একটা সময় আমাদের বাংলা স্বাধীন ছিল মুঘলদের নাগালের বাইরে। যদিও পরবর্তী সময় আকবরের হাত ধরে বাংলা মুঘল সাম্রাজ্যতে অন্তর্ভুক্ত হয় এবং স্বতন্ত্র সুবায় পরিণত হয়। এরপর দীর্ঘ সময় বাংলা সুবা থেকে যে পরিমাণ আয় উপায় দিল্লির হত তা দেশের আর কোন সুবা থেকে কল্পনাই করা যেত না। একটা সময় শোনা যায় নবাব মুর্শিদকুলি খাঁ এই বাংলা থেকে প্রায় এক কোটি ত্রিশ লক্ষ সিক্কা গরুর গাড়িতে করে দিল্লিতে পাঠিয়েছিলেন বাদশাহের কাছে। সেই বাংলা আর আজকের বাংলার মধ্যে আকাশ পাতাল তফাৎ। আজ আমরা যে বাংলা দেখি তা ভিনদেশীদের হাতে বারবার লুন্ঠিত হওয়ার পর এক কঙ্কালসার ফলাফল।
এবার আমরা আসি আজকের গল্পে। তখন দিল্লীর বাদশা ঔরঙ্গজেব। বাংলার দেওয়ান হিসাবে সবে এখানে আগমন ঘটেছে মুর্শিদকুলী খাঁ'র। জন্মসূত্রে ব্রাহ্মণ সন্তান। কিন্তু ভাগ্যের ফেরে ছেলেধরার হাত ধরে পারস্যে ক্রীতদাস হয়ে মুসলিম ঘরে ঠাঁই আর তখনই ইসলাম ধর্ম গ্রহণ। ভাগ্য কবেই বা কার কথা শুনেছে! কিন্তু তার সামান্য ফেরেই মানুষ যে আবার কোথায় চলে যেতে পারে তার উপমাও সেই মুর্শিদকুলীই। জায়গীর থেকে পরে তিনিই হয়ে ওঠেন বাংলার স্বাধীন নবাব। ঢাকা থেকে রাজধানী সরিয়ে নতুন কেল্লা গড়েন মুকসুদাবাদে (এখন মুর্শিদাবাদ)।
যাই হোক, বাদশার সালতানতের দখলে থাকা দাক্ষিণাত্য ঘুরে জাইগীর মুর্শিদকুলী তখন বাংলায়। মোঘল দরবারের নিয়োগপত্র হাতে নিয়ে সেই সময় ঢাকা থেকে বাংলার নবাবি করছেন বাদশা ঔরঙ্গজেবের নাতি সুলতান আজীমুদ্দিন ওরফে নবাব আজীমউশ্বান। হুগলীতে আবার মুলত বিদেশী নাবিকদের ওপর নজরদারির জন্য মুঘল দরবার থেকে পুরোদস্তুর নিয়োজিত আছেন একজন ফৌজদার। নাকের ডগায় ইংরেজ এবং পর্তুগীজ কুঠি। সকলেই যে যার মত চেষ্টা করছে বাণিজ্যের দখল নিতে। এই রাজনৈতিক অবস্থায় বাদশার দক্ষ সিভিল অফিসার মুর্শিদকুলী শুরু করলেন নজরে পড়ার মত কাজ। স্থানীয় হিন্দু জমিদারদের থেকে অত্যাচার করে বাগাতে লাগলেন সীমাহীন কর। আর তার প্রায় সবটাই রূপোর টাকায় গরুর গাড়ি চাপিয়ে প্রতি বছর পাঠাতে থাকলেন দিল্লীতে বাদশার দরবারে। সেযুগের হিসাবে অংকটা এক কোটি পর্যন্তও পৌঁছেছিল। কিন্তু এদিকে হল মহা বিপদ। বাংলার সব রূপো টাকা চলে যেতে লাগলো বাদশার হাতে। আর শেষ বয়সের সত্তর পেরনো বাদশা তখন অসম্ভব ব্যস্ত দক্ষিণের যুদ্ধ নিয়ে। তাই যথারীতি মুর্শিদকুলী হয়ে উঠলো বাদশার প্রিয় অফিসার। যদিও সাহেনশা প্রথম থেকেই তাঁর কাজে যারপরনাই খুশি ছিলেন। আর সেই ভরসাতেই তাঁকে অনেক আশা নিয়ে বাংলায় পোস্টিং দেয়া। তবে বাংলার সাধারণ মানুষ আর জমিদারদের হাত প্রায় শূন্য। অগত্যা উপায় না থাকায় তখন বেশিরভাগ কেনাবেচাই হতে থাকলো কড়ির মাধ্যমে। রূপোর মুদ্রা ডুমুরের ফুলে পরিণত হল। আজকের অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে ব্যাখ্যা করলে মুদ্রার অবমূল্যায়ন বেশ চোখে পড়ার মতন। কিন্তু চাহিদা অনুযায়ী কড়ির মূল্যে বাজার নিয়ন্ত্রিত হওয়ায় জিনিসপত্রের দামও বেশ কমতে লাগলো পাল্লা দিয়ে। শোনা যায় নবাব ইব্রাহিম খাঁ'র সময়ে এক আনায় আটমণ চাল পাওয়া যেত এই বাংলায়। পরে নবাব সরফরাজ খাঁ'র (যিনি নবাব মুর্শিদকুলীর নাতি) আমলেও বাজারমূল্য ভীষণ কমে গেছিল। আর সেই থেকেই আমাদের মুখে মুখে টাকাকড়ি শব্দটা প্রচলিত হয়ে ওঠে।
আজ থাক এই পর্যন্তই। আবার নতুন কোন গল্প নিয়ে কোনোদিন আসবো ব্লগের পাতায়। আপনাদের ভালো লাগলে তবেই আমার কাজের সার্থকতা। আপাতত সকলে ভালো থাকবেন। ব্লগিংয়ে থাকবেন।
(তথ্যসূত্র - বাঙ্গালার ইতিহাস, কালীপ্রসন্ন বন্দ্যোপাধ্যায়,
মুর্শিদাবাদের ইতিহাস, নিখিলনাথ রায়)
(চিত্রগ্রহণ - রেডমি ৯ প্রো মোবাইলে গৃহীত)
--লেখক পরিচিতি--
কৌশিক চক্রবর্ত্তী। নিবাস পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলায়। পেশায় কারিগরি বিভাগের প্রশিক্ষক। নেশায় অক্ষরকর্মী। কলকাতায় লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলনের সাথে দীর্ঘদিন যুক্ত৷ কলকাতা থেকে প্রকাশিত কবিতার আলো পত্রিকার সহ সম্পাদক। দুই বাংলার বিভিন্ন প্রথম সারির পত্রিকা ও দৈনিকে নিয়মিত প্রকাশ হয় কবিতা ও প্রবন্ধ। প্রকাশিত বই সাতটি৷ তার মধ্যে গবেষণামূলক বই 'ফ্রেডরিক্স নগরের অলিতে গলিতে', 'সাহেবি কলকাতা ও তৎকালীন ছড়া' জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। সাহিত্যকর্মের জন্য আছে একাধিক পুরস্কার ও স্বীকৃতি। তার মধ্যে সুরজিত ও কবিতা ক্লাব সেরা কলমকার সম্মান,(২০১৮), কাব্যলোক ঋতুভিত্তিক কবিতায় প্রথম পুরস্কার (বাংলাদেশ), যুগসাগ্নিক সেরা কবি ১৪২৬, স্রোত তরুণ বঙ্গ প্রতিভা সম্মান (২০১৯), স্টোরিমিরর অথর অব দ্যা ইয়ার, ২০২১, কচিপাতা সাহিত্য সম্মান, ২০২১ তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য।
কমিউনিটি : আমার বাংলা ব্লগ
ধন্যবাদ জানাই আমার বাংলা ব্লগের সকল সদস্যবন্ধুদের৷ ভালো থাকুন, ভালো রাখুন।
Upvoted! Thank you for supporting witness @jswit.
Downvoting a post can decrease pending rewards and make it less visible. Common reasons:
Submit
বহুপ্রতীক্ষিত কাজ এই মুর্শিদাবাদ৷ লেখা আর ছবি দেখে মনে পড়ছে এই তো কদিন আগেই গিয়েছিলে, ছোটে বেগমের ছবি পাঠালে।
ঝরঝরে গদ্যে মনকাড়া লেখা৷ ইতিহাস তোমার জনরা। এতোদিন পর নিজের গ্রাউন্ড থেকে পোস্ট হল এখানে৷ ভালো লাগল লেখা৷ আগামি আরও ঐতিহাসিক গল্প শোনার অপেক্ষায় থাকব৷
Downvoting a post can decrease pending rewards and make it less visible. Common reasons:
Submit
হ্যাঁ। সত্যিই এই কাজ ভালোলাগার জায়গা। যেন টেনে রাখে চুম্বকের মত৷ মুর্শিদাবাদের বৈচিত্র্য, তার রাজনীতি, তার শাসনব্যবস্থা আমায় ভাবায়৷ এই কাজের মধ্যে দিয়ে যেন একটা সময়ে ভীষণ সহজে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়তে পারছি৷ তোর কমেন্ট ভালো লাগলো
Downvoting a post can decrease pending rewards and make it less visible. Common reasons:
Submit