কলকাতা শহরের বুকে একখণ্ড ভয়াল ইতিহাস
আসুন ইতিহাস খুঁজি
আজকের পোস্টটি একটু ভিন্নভাবে নিয়ে এলাম আপনাদের কাছে। আমার প্রাণের শহর কলকাতা। এই শহরেই আমার বেড়ে ওঠা। তাই পৃথিবীর যে প্রান্তেই যাই, সব সময় সবকিছুর পরে মনে হয় আমার কলকাতায় ভালো। এ হয়তো আমার অন্ধ ভালবাসা। কিন্তু তবু এই পক্ষপাতীত্বের বাইরে আজ পর্যন্ত বেরোতে পারিনি আমি।
কলকাতা। আজকের তিলোত্তমা। সাজানো গোছানো ভিড়ে ঠাসা আমাদের শহর। কিন্তু একটু নাড়াচাড়া করে দেখলেই বর্ণময় ইতিহাস। আর সেই ইতিহাসের বহু রং। আদ্যোপান্ত ইংরেজ সাহেবদের হাতে তৈরি একটা শহর। ভারতবর্ষের অন্যান্য শহরের সমৃদ্ধ ইতিহাস থাকলেও একক ভাবে ব্রিটিশ কলোনিয়াল ধারা জুড়ে রয়েছে আমাদের এই শহরের আনাচেকানাচেই। আজও এই শহরে পাওয়া যায় ক্যানিং স্ট্রিট, ল্যান্সডাউন রোড, ডালহৌসি স্কোয়ার। সুতরাং ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক ছায়ায় মোড়া কলকাতায় আজও লেগে আছে লালমুখো সাহেব সাহেব গন্ধ। কিন্তু রোজকার ব্যস্ত হেঁটে চলা বাঙালি কি তাকিয়ে দেখছে সেই ইটগুলোর দিকে? ইতিহাস চাপা পড়বার জিনিস নয়। পড়েও না। তাকে সঙ্গে নিয়েই চলতে হয় আজকের প্রজন্মকে।
কিন্তু নতুন বিদেশী শাসকরা এদেশে আসবার পরে ঠিক কেমন ছিল এদেশের মানুষগুলোর দৈনন্দিন জীবনযাপন। তখন কথায় কথায় ফাঁসি দেওয়ায় তারা ছিল সিদ্ধহস্ত। সে যেকোনো অপরাধই হোক না কেন। এমনকি জনসমক্ষে ফাঁসি প্রদর্শনের জন্য রাস্তায় গাছের নীচে তৈরি থাকতো ফাঁসির মঞ্চ। অর্থাৎ প্রকাশ্য মৃত্যুদণ্ড। যাতে মানুষজনকে প্রকাশ্যে মৃত্যু দেখিয়ে ভয়ের সঞ্চার করা যায়। বর্তমানে রাজভবনের কাছে ফ্যান্সি লেন কলকাতার এক পরিচিত গলি। আজকের কলকাতাবাসী যতই এই নামটি অভিজাত ভঙ্গিতে উচ্চারণ করুন না কেন, আসলে এই নামের উৎস খুঁজতে গেলে চমকে উঠতে হয় বৈকি। সেই রাস্তাতেই নাকি ছিল এমন একটি ফাঁসির মঞ্চ। আর 'ফাঁসি'ই ইংরেজি অপভ্রংশে হল 'ফ্যান্সি'। যেখানে সামান্য ঘড়ি চুরির অপরাধে ফাঁসি দেওয়া হয় এক জনৈক দেশীয় কর্মচারীকে। কলকাতার মানুষের কাছে এই রাস্তা ছিল এক জ্বলন্ত বিভীষিকা। কেউ দিনের আলোতেও ঢুকতে চাইত না সে তল্লাটে। লম্বা রাস্তা। দুধারে সারবদ্ধ গাছ। আর তার মাঝেই গাছের ঢালে প্রকাশ্য ফাঁসির আয়োজন। শহরে আসার একদম প্রথম দিকে কোনো এক জনৈক দস্যুর বা ডাকাতের ফাঁসির মাধ্যমে আনুষ্ঠানিক ভাবে শুরু হয় এই রাস্তার পরিচিতি। বাকিটা রয়ে গেছে আতঙ্ক আর ভয়ার্ত ইতিহাসের গল্পে। যদিও আজ গল্প হলেও তা একেবারে জীবন্ত সত্য।
তখন কলকাতায় বিভিন্ন দিকে প্রকাশ্যেই চলত শাস্তিদানের ব্যবস্থা। প্রসঙ্গত বলি। মহারাজা নন্দকুমারের ফাঁসি মনে আছে নিশ্চয়? কলকাতার ইতিহাসে সে এক কালো অধ্যায়। চাকরিসূত্রে তিনি ছিলেন কোম্পানীর দেওয়ান। হুগলী, নদীয়া ও বর্ধমান অঞ্চলে দেওয়ানি সামলেছিলেন বহুদিন। তাও আবার স্বয়ং ওয়ারেন হেস্টিংসের বদলি হিসাবে। এই অপমান কখনোই ভুলতে পারেন নি হেস্টিংস সাহেব। এরপর থেকে কখনোই আর দুজনের সম্পর্কে শীতলতা ফিরে আসেনি কোনোভাবে। অভিযোগ, পাল্টা অভিযোগের লড়াই অব্যাহত রেখেই দুই প্রভাবসম্পন্ন ব্যক্তির দ্বন্দ্ব কলকাতাবাসী প্রত্যক্ষ করেছে সেইযুগে। নবাব মীরজাফরের মৃত্যুর পর তাঁর নাবালক পুত্র মোবারক-উদ-দৌলার অবিভাবকত্বের আর্জিতে মুন্নি বেগমের থেকে অর্থ আত্মসাৎ করার অভিযোগ ওঠে হেস্টিংসের বিরুদ্ধে। আর ঘটনাচক্রে অভিযোগটি আনেন মহারাজা নন্দকুমার। কিন্তু সুপ্রিম কোর্টের তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এলিজা ইম্পে (যাঁর কবর আজও সাউথ পার্ক স্ট্রিট সিমেট্রিতে দেখা যায়) তাঁর বাল্যবন্ধু হওয়ায় সবটাই যায় নন্দকুমারের বিপরীতে। আর ফল হয় মিথ্যে জালিয়াতির অভিযোগে প্রকাশ্যে ফাঁসি। বর্তমান খিদিরপুরে গঙ্গার ধারে নিজেই নিজের মৃত্যুর স্থান নির্বাচন করেন রাজা। গঙ্গাকে আর অসংখ্য দেশবাসীকে সাক্ষী রেখে ফাঁসির দড়ি গলায় বরণ করেন নন্দকুমার। ব্রাহ্মণের মৃত্যু চোখের সামনে দেখে ব্রহ্মহত্যার অভিশাপ থেকে বাঁচতে সেদিন দলে দলে গঙ্গাস্নান করে বাড়ি ফিরেছিল মানুষজন।
ঠিক তেমন ভাবেই ফ্যান্সি লেনও সাক্ষী এমন বহু রাজনৈতিক ও স্বার্থের সংঘাতের। যার ফলাফল প্রকাশ্য মৃত্যুদণ্ড। ফ্যান্সি অর্থে আধুনিক নয়, ফাঁসির অপভ্রংশ। ঠিক যেভাবে কাঁথি হল কন্টাই, অথবা চুঁচুড়া হল চিনসূড়া। গলির মুখটায় ঢুকলে আজ আর নেই ফাঁসিকাঠ, নেই মৃতদেহ ধারণ করে রাখা গাছের ডালে ঝোলানো দড়ি। কিন্তু রয়ে গেছে জীবন্ত ইতিহাস আর কলোনিয়াল চক্রান্তের শিকার হয়ে অকালে ঝরে যাওয়া বহু ভারতীয় মানুষের কান্না।
কী। একবার যাবেন নাকি ফ্যান্সি লেন? যদি যান, অবশ্যই জানাবেন। হয়তো আজও সেখানে গেলে শুনতে পাবেন সেইসব অভাগা আর্তদের কান্না। একটা শহর গড়ে ওঠে অনেক ঘাত প্রতিঘাতের উপরে। আর সেইসব হারানো দিনগুলোই নিরবে সাক্ষ্য দিয়ে যায় এক ফেলে আসা অধ্যায়ের।
আজ ইতিহাসের গল্প এই পর্যন্তই। আবার আসা যাবে নতুন কোনো পোস্টে নতুন গল্প নিয়ে। ধন্যবাদ সকলকে।
--লেখক পরিচিতি--
কৌশিক চক্রবর্ত্তী। নিবাস পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলায়। পেশায় কারিগরি বিভাগের প্রশিক্ষক। নেশায় অক্ষরকর্মী। কলকাতায় লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলনের সাথে দীর্ঘদিন যুক্ত৷ কলকাতা থেকে প্রকাশিত কবিতার আলো পত্রিকার প্রধান সম্পাদক। দুই বাংলার বিভিন্ন প্রথম সারির পত্রিকা ও দৈনিকে নিয়মিত প্রকাশ হয় কবিতা ও প্রবন্ধ। প্রকাশিত বই সাতটি৷ তার মধ্যে গবেষণামূলক বই 'ফ্রেডরিক্স নগরের অলিতে গলিতে', 'সাহেবি কলকাতা ও তৎকালীন ছড়া' জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। সাহিত্যকর্মের জন্য আছে একাধিক পুরস্কার ও স্বীকৃতি। তার মধ্যে সুরজিত ও কবিতা ক্লাব সেরা কলমকার সম্মান,(২০১৮), কাব্যলোক ঋতুভিত্তিক কবিতায় প্রথম পুরস্কার (বাংলাদেশ), যুগসাগ্নিক সেরা কবি ১৪২৬, স্রোত তরুণ বঙ্গ প্রতিভা সম্মান (২০১৯), স্টোরিমিরর অথর অব দ্যা ইয়ার, ২০২১, কচিপাতা সাহিত্য সম্মান, ২০২১ তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য।
কমিউনিটি : আমার বাংলা ব্লগ
ধন্যবাদ জানাই আমার বাংলা ব্লগের সকল সদস্যবন্ধুদের৷ ভালো থাকুন, ভালো রাখুন।
Upvoted! Thank you for supporting witness @jswit.
Downvoting a post can decrease pending rewards and make it less visible. Common reasons:
Submit