ঊনবিংশ শতাব্দীর সমাজ সংস্কারক রাজা রামমোহন রায়ের পৈত্রিক বাড়ি
চলুন আজ আপনাদের একটু ইতিহাসের দোরগোড়ায় নিয়ে যাই। এ ইতিহাস বাঙালির ইতিহাস। এই ইতিহাস বাঙালি জীবনের ইতিহাস। আমরা জানি এক সময় বাংলার সামাজিক ও দৈনন্দিন জীবনের অঙ্গ ছিল বিভিন্ন ধরনের কুসংস্কার এবং কু-প্রথা। এরমধ্যে অন্যতম একটি প্রথা ছিল সতীদাহ। সতীদাহ এমন একটি কুপ্রথা যেখানে জীবন্ত নারীকে স্বামীর মৃত্যু হবার পর বিধবা নাম করে জীবন্ত পুড়িয়ে হত্যা করা হতো চিতার গনগনে চিতায়। এর আর এক নাম ছিল সহমরণ। এই নারকীয় প্রথা বাংলার একসময়ের কলঙ্ক। এমন আরো কুপ্রথা এক সময় মিশে ছিল বাঙালি জীবনের আনাচে-কানাচে। কিন্তু যুগে যুগে এই বাংলাতেই জন্মগ্রহণ করেছিলেন এমন কিছু মনীষী, যাঁরা হাল ধরেছিলেন এইসব কুসংস্কারাচ্ছন্ন প্রথার বিরুদ্ধে। এই লড়াই কখনোই সহজ ছিল না। এর জন্যে বিভিন্ন হামলা এবং হুমকির সামনে বারবার পড়তে হয়েছিল তাঁদের। যেমন সতীদাহ প্রথা রদ করবার জন্য যখন বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে ঘুরে বেড়াচ্ছেন রাজা রামমোহন রায়, তখন বারবার গোঁড়া মানুষদের জনরোষের সামনে পড়তে হয়েছিল তাঁকে। কিন্তু তিনি ছিলেন অটল। কেউ তাঁর সংকল্পকে টলাতে পারেনি একটুও।
☘️রাজা রামমোহন রায়ের বাড়ি☘️
আজ এমন একটি জায়গার ছবি দেখাবো যেখানে জড়িয়ে আছে সেই রাজা রামমোহন রায়ের পায়ের ধুলো। তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন হুগলি জেলার খানাকুলে রাধানগর গ্রামে। সেই গ্রাম আজও তাঁর স্মৃতিচিহ্ন বুকে নিয়ে রয়ে গেছে লোকচক্ষুর আড়ালে। আমি একদিন নিজের খেয়ালে বাইকে চড়ে ৭৫ কিলোমিটার ড্রাইভিং করে পৌঁছে গিয়েছিলাম সেই রাধানগর গ্রামে। শুধুমাত্র রাজা রামমোহন রায়ের বসত ভিটে এবং তাঁর স্মৃতিধন্য বিভিন্ন জায়গা দেখবার লোভে। এই একটি দিন আমার জীবনে একটি উল্লেখযোগ্য দিন হয়ে রয়েছে। তাঁর বসতভিটের আজ ভগ্নাংশ টুকুই পড়ে আছে রাধানগর গ্রামে। সেখানে শুধুমাত্র সরকারি হেরিটেজের একটি বোর্ড ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়লো না। এমনকি সেই জায়গা কিছুটা অবহেলিত বলেই মনে হলো। যার সঙ্গে মিশে রয়েছে কিংবদন্তী এবং প্রাতঃস্মরণীয় বাঙালি রাজা রামমোহন রায়ের ইতিহাস, সেখানে এই অবহেলা আমার একেবারেই ভালো লাগেনি। কিন্তু জায়গাটিকে একটি পার্কের রূপ দিয়ে পর্যটন স্থলে পরিণত করা হয়েছে। কিন্তু সেখানে ঐতিহ্য কই? সেই অঞ্চলটিতে রয়েছে রাজা রামমোহন রায়ের বাড়ির কিছু অংশ। গোঁড়া ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্ম হলেও তিনি ধর্মের গোঁড়ামী মানতেন না বলে বাড়ি থেকে তাঁকে ত্যাজ্যপুত্র করেছিলেন তাঁর পিতা। আর তারপর তিনি নিজে বানিয়েছিলেন এই বাড়ি। বর্তমানে এই বাড়ির প্রতিটি ইট তাঁর পূণ্য ছোঁয়াটুকু নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে নীরবে। আমি কিছুক্ষণ এই বাড়ির সামনে থমকে দাঁড়িয়ে গেছিলাম। হাঁটতে হাঁটতে মনে হচ্ছিল না জানি কত দিন সেই মানুষটির চরণস্পর্শে এই জায়গা ধন্য হয়েছে। বাঙালির উত্তরণে তাঁর ভূমিকা অনস্বীকার্য। আর তাঁর নিজস্ব এই কুটিরে আমি যে কোনদিন পৌঁছে যাব তা যেন স্বপ্নেও ভাবিনি।
☘️রাজা রামমোহন রায়ের বাড়ি☘️
বাড়িটির বর্তমান অবস্থা খুবই করুণ। ছাদ নেই বললেই চলে। বাড়িটিকে যদি একটু যত্ন করে পরিচর্যা করা হতো এবং অক্ষত রাখার চেষ্টা করা হতো, তবে হয়তো আজ এই অবস্থা চোখের সামনে দেখতে হতো না। বাংলার বুকে রাজা রামমোহন রায়ের বাড়ি থাকবে না, এমন হতে দেওয়া যায় না। কলকাতায় আমহার্স্ট স্ট্রিটে তার বসবাসের বাড়ি আজও অক্ষত আছে। সেটি তাঁর কর্মস্থল। আর তাঁর জন্মভিটের ইতিহাসটুকু টিকিয়ে রাখা আমাদেরই একান্ত কর্তব্য। ওই দেওয়ালগুলি যদি অচিরেই ভেঙে পড়ে, তবে হয়তো রাধানগর গ্রাম থেকে চিরতরে হারিয়ে যাবে রাজা রামমোহন রায়ের মূল্যবান স্মৃতিচিহ্নগুলো। তাই সব সময়ই চাই, পরিচর্যা হোক বাঙালির মূল উৎসপথগুলোর। আমরা যদি রামমোহন, বিদ্যাসাগরকে ভুলে যাই, তবে হয়তো বাঙালি সত্তাটুকুই একদিন ভুলে যাব। পড়ে থাকবে রাধানগর গ্রাম, পড়ে থাকবে হুগলি জেলার খানাকুল ব্লক, শুধু তার মধ্যে আর থাকবেন না বাঙালির অন্যতম সমাজ সংস্কারক এবং শিক্ষাব্রতী রাজা রামমোহন রায়।
☘️দেয়ালে অসাধারণ নকশা☘️
--লেখক পরিচিতি--
কৌশিক চক্রবর্ত্তী। নিবাস পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলায়। পেশায় কারিগরি বিভাগের প্রশিক্ষক। নেশায় অক্ষরকর্মী। কলকাতায় লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলনের সাথে দীর্ঘদিন যুক্ত৷ কলকাতা থেকে প্রকাশিত কবিতার আলো পত্রিকার প্রধান সম্পাদক। দুই বাংলার বিভিন্ন প্রথম সারির পত্রিকা ও দৈনিকে নিয়মিত প্রকাশ হয় কবিতা ও প্রবন্ধ। প্রকাশিত বই সাতটি৷ তার মধ্যে গবেষণামূলক বই 'ফ্রেডরিক্স নগরের অলিতে গলিতে', 'সাহেবি কলকাতা ও তৎকালীন ছড়া' জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। সাহিত্যকর্মের জন্য আছে একাধিক পুরস্কার ও স্বীকৃতি। তার মধ্যে সুরজিত ও কবিতা ক্লাব সেরা কলমকার সম্মান,(২০১৮), কাব্যলোক ঋতুভিত্তিক কবিতায় প্রথম পুরস্কার (বাংলাদেশ), যুগসাগ্নিক সেরা কবি ১৪২৬, স্রোত তরুণ বঙ্গ প্রতিভা সম্মান (২০১৯), স্টোরিমিরর অথর অব দ্যা ইয়ার, ২০২১, কচিপাতা সাহিত্য সম্মান, ২০২১ তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য।
কমিউনিটি : আমার বাংলা ব্লগ
ধন্যবাদ জানাই আমার বাংলা ব্লগের সকল সদস্যবন্ধুদের৷ ভালো থাকুন, ভালো রাখুন।
Upvoted! Thank you for supporting witness @jswit.
Downvoting a post can decrease pending rewards and make it less visible. Common reasons:
Submit
প্রিয় কৌশিক'দার (বানান ভুল করলে অপরাধ মার্জনীয়) আরেকটি ইতিহাস আশ্রিত পোস্ট পেলাম। ভালো লাগলো। বিদ্যাসাগরের বাড়ি দেখতে পারলাম।
খারাপ লাগলো দুটি কারনে। এমন একটি স্থানের সংস্কারের উদ্যোগ নেয়া হলোনা। আর, কৌশিক'দার পোস্টে ইতিহাস সম্পর্কে তেমন নতুম কিছু জানলাম না এবার। তবুও ধন্যবাদ, ভালো কিছু শেয়ার করার জন্য। অব্যাহত রাখুন।
Downvoting a post can decrease pending rewards and make it less visible. Common reasons:
Submit
অনেক ধন্যবাদ ভাই। আচ্ছা ঠিক আছে, এই বাড়ির ইতিহাস এবং সেখানে জড়িত রামমোহনের স্মৃতি নিয়েও আর একটি পোস্টে লিখব। কথা দিলাম। আর আমার নামের বানান একদম ঠিক লিখেছেন।
Downvoting a post can decrease pending rewards and make it less visible. Common reasons:
Submit