কলকাতার প্রথম মেডিসিন মার্চেন্ট বি কে পাল ও তাঁর বাড়ি। ইতিহাসের গল্প।

in hive-129948 •  3 months ago 

কলকাতার প্রথম মেডিসিন মার্চেন্ট বি কে পাল

🌱🌱🌱🌱🌱🌱🌱🌱🌱


☘️আসুন ইতিহাসের গল্প বলি☘️


Onulipi_08_17_10_37_43.jpg

🙏🙏সকলকে স্বাগত জানাই🙏🙏

আসুন আজ আবার একটু কলকাতার ইতিহাস অন্বেষণ করা যাক। ব্রিটিশদের শহর কলকাতা। এক সময় বলা হত ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অন্তর্গত সব শহরের মধ্যে লন্ডনের পরেই কলকাতার স্থান। আর একটি অজ পাড়াগাঁ থেকে ধীরে ধীরে মহানগরীতে রূপান্তরিত হওয়া কলকাতা শহরের অনেক উত্থান পতনের ইতিহাস। তার মধ্যেই আজ আপনাদের শোনাবো এক ওষুধ বিক্রেতার গল্প। যার হাত ধরে কলকাতা শহর ব্যবসা শিখেছিল এক সময়।

উত্তর কলকাতার বিকে পাল এভিনিউ দিয়ে হাঁটেননি এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া দুরস্ত। কে এই বিকে পাল? অর্থাৎ বটকৃষ্ণ পাল। শোভাবাজার স্ট্রিটে বনেদি বাড়ির গা ঘেসে তাঁর বিশাল প্রাসাদ ও ওষুধের দোকান আজও জাজ্বল্যমান। আসুন জেনে নিই তাঁর ইতিহাস। চিৎপুর রোডে ছোট্ট একফালি আফিমের দোকান থেকে শোভাবাজার স্ট্রিটে বিশাল অট্টালিকা- বটকৃষ্ণের এই পথ খুব উজ্জ্বল। উনিশ শতকের শেষার্ধে সাহেব কোম্পানিগুকে পিছনে ফেলে বটকৃষ্ণ রমরম করে চালান তাঁর ওষুধের দোকান, শুধু তাই নয়, সম্পূর্ণ দেশজ উপায়ে তৈরী করেন ম্যালেরিয়ার এলোপ্যাথি ওষুধ। এমনকি ১৯০৯ সালে লন্ডনের 'কেমিস্ট আন্ড ড্রাগিস্ট পত্রিকা' তাঁর দোকানের পসরা সম্বন্ধে আর্টিকেল পর্যন্ত করে।

IMG_20240722_153518_783.jpg

কলকাতা শোভাবাজারে বি কে পালের ঐতিহাসিক বাড়ি

১৮৩৫ সালে হাওড়ার শিবপুরে জন্ম নেন তিনি। বাবা লক্ষীনারায়ণ পালের অবস্থা ভালো ছিল না। মাত্র ১২ বছর বয়সে হাওড়া থেকে বটকৃষ্ণ চলে আসেন শোভাবাজারে মামাবাড়িতে। নতুনবাজারে মামা রামকুমারের ছিল মসলার দোকান। সেখানেই বটকৃষ্ণ কাজে লেগে যান। ১৬ বছর বয়সে মামার দোকান ছেড়ে আফিমের দোকান খোলেন চিৎপুরে। হ্যাঁ, ঠিকই পড়েছেন, মাত্র ১৬ বছর বয়সেই। ভাবা যায়? কিন্তু বটকৃষ্ণের ব্যবসায়িক বুদ্ধি সেখানেই থেমে থাকলে আজ আমরা তাঁকে নিয়ে চর্চা করতাম না। মানুষকে আফিম খাইয়ে তিনি সবসময়ই একটা অপরাধবোধে ভুগতেন। তাই হটাৎ আফিমের ব্যবসায় ইতি দিয়ে চলে যান বৈদ্যবাটির হাটে, আর শুরু করেন পাটের ব্যবসা। শেষ পর্যন্ত খোঙড়াপট্টি স্ট্রিটে তৈরী করেন নিজের দোকান। ব্যবসায়িক মগজের তাৎক্ষণিক প্রয়োগে তিনি বুঝতে শুরু করেন যে আয়ুর্বেদিক ওষুধের চেয়ে বিদেশী এলোপ্যাথি ওষুধের চাহিদা কিভাবে হুহু করে বাড়ছিল। কলকাতার বিদেশী ওষুধ এজেন্টদের সাথে যোগসূত্র করে তিনি লন্ডন থেকে আনতে শুরু করেন এলোপ্যাথি ওষুধ। তারপর খোলেন 'বটকৃষ্ণ পাল আন্ড কোম্পানি'। কলকাতার ওষুধ ব্যবসায় এ এক মাইলফলক। সস্তায় নির্ভেজাল ওষুধ বিক্রি করে তিনি ধীরে ধীরে হয়ে ওঠেন সাহেবদের ব্যবসায়িক প্রতিযোগী।

IMG_20240722_153506_422.jpg

কলকাতা শোভাবাজারে বি কে পালের বাড়ি

১৬ বছর বয়সেই ছেলে ভুতনাথকে লাগিয়ে দেন ব্যবসায়। এই ভূতনাথ পালই কলকাতার রাস্তায় ইংরেজদের টক্কর দিয়ে প্রথম বাঙালি ব্যবসার বিজ্ঞাপনের প্রথা চালু করেন। খবরের কাগজ, পঞ্জিকা এমনকি বড়বড় রাস্তাতেও তিনি ভরিয়ে দেন তাঁদের দোকানের বিজ্ঞাপন। বর্তমান বিশ্বায়নের যুগে বিষয়টি খুব মামুলি মনে হলেও সেযুগে এটি বেশ শোরগোল তুলেছিল কলকাতার বাঙালি সমাজে। এরপর ১৯০৪ সালে বেশ কয়েকটি বাড়ি হাতবদলের পর ৩০ নং, শোভাবাজার স্ট্রিটে বটকৃষ্ণ গড়ে তোলেন তাঁর অট্টালিকা। এটিই তাঁর বসতবাড়ি। পরে ১৯১২ সালে শশিভূষণ সুর লেনে তৈরী করেন রিসার্চ ল্যাবরেটরি। সেইযুগে তাঁর মালিকানায় চিকিৎসাশাস্ত্রের সব শাখাগুলির জন্য তৈরী হয়েছিল আলাদা আলাদা ১৬ টি বিভাগ। এমনকি পশুচিকিৎসার জন্যও একটা আলাদা বিভাগ। এর পরও কে বলবে বাঙালি ব্যবসা করে না?

IMG_20240722_153501_880.jpg

পরবর্তী সময়ে ব্যবসার বিশাল পরিসর দেখাশোনার জন্য বটকৃষ্ণ তাঁর আরো দুই পুত্র হরিশংকর ও হরিমোহনকেও নিয়োগ করেন। হরিশংকর কলকাতার ওষুধ ব্যাবসায়ের আর এক পাইওনিয়ার। তিনি বাবার ব্যবসাকে এক সুবিশাল বটবৃক্ষে পরিণত করেন। এমনকি বিদেশি কোম্পানিগুলি কিভাবে ওষুধ ব্যবসা করেন তা দেখার জন্য তিনি বিলেত পারিও দেন। ১৯৩০ সালে তিনি 'নাইট' উপাধি লাভ করেন। শুধু ব্যবসায়ী হিসাবেই নন, সমাজসেবী হিসাবেও তিনি প্রসিদ্ধ ছিলেন। হরিশংকরই প্রতিষ্ঠা করেন 'Bengal Chemists and Druggists Association' ।

আজও অত্যাধুনিক শীততাপনিয়ন্ত্রিত ওষুধ ব্যাবসায়ীদের সাথে পাল্লা দিয়েও বিকে পালের ওষুধের দোকান রমরম করে ব্যবসা করে চলেছে শোভাবাজারের বুকে। পারলে কেউ কখনো একবার অন্তত কিছু ওষুধ কেনার উদ্দেশ্যে সেখানে যাবেন। দোকানের গঠনশৈলীই মনে করিয়ে দেবে ঊনবিংশ শতকের বিত্ত ও বৈভবের দিনগুলোর কথা। দোকানের পাশে এখনো রাখা আছে ব্যবসায়ী বটকৃষ্ণ পালের ব্যবহৃত গাড়িটি।

এই হল কলকাতার মেডিসিন মার্চেন্ট বিকে পালের গল্প। চেষ্টা করলাম ইতিহাসটাকে সম্পূর্ণরূপে আপনাদের সামনে নিয়ে আসার। ভালো লাগলে নিশ্চয়ই জানাবেন। আরো নতুন নতুন ইতিহাসের গল্প নিয়ে নিশ্চয়ই আসব আমার বাংলা ব্লগের পাতায়।


Onulipi_08_07_01_37_53-removebg-preview.png

চিত্রগ্রহণ
ইনফিনিক্স হট ৩০
ক্যামেরা স্পেশিফিকেশন
৫০ মেগাপিক্সেল
চিত্রগ্রাহক
কৌশিক চক্রবর্ত্তী
লোকেশন
শোভাবাজার, কলকাতা
ছবি এডিটিং সৌজন্য
ক্যানভা ও অণুলিপি


(৫% বেনিফিশিয়ারি এবিবি স্কুলকে এবং ১০% বেনিফিশিয়ারি প্রিয় লাজুক খ্যাঁককে)



1720541518267-removebg-preview.png

Onulipi_07_27_10_21_22.jpg


new.gif

1720541518267-removebg-preview.png


--লেখক পরিচিতি--

IMG_20240303_181107_644.jpg

কৌশিক চক্রবর্ত্তী। নিবাস পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলায়। পেশায় কারিগরি বিভাগের প্রশিক্ষক। নেশায় অক্ষরকর্মী। কলকাতায় লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলনের সাথে দীর্ঘদিন যুক্ত৷ কলকাতা থেকে প্রকাশিত কবিতার আলো পত্রিকার প্রধান সম্পাদক। দুই বাংলার বিভিন্ন প্রথম সারির পত্রিকা ও দৈনিকে নিয়মিত প্রকাশ হয় কবিতা ও প্রবন্ধ। প্রকাশিত বই সাতটি৷ তার মধ্যে গবেষণামূলক বই 'ফ্রেডরিক্স নগরের অলিতে গলিতে', 'সাহেবি কলকাতা ও তৎকালীন ছড়া' জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। সাহিত্যকর্মের জন্য আছে একাধিক পুরস্কার ও স্বীকৃতি। তার মধ্যে সুরজিত ও কবিতা ক্লাব সেরা কলমকার সম্মান,(২০১৮), কাব্যলোক ঋতুভিত্তিক কবিতায় প্রথম পুরস্কার (বাংলাদেশ), যুগসাগ্নিক সেরা কবি ১৪২৬, স্রোত তরুণ বঙ্গ প্রতিভা সম্মান (২০১৯), স্টোরিমিরর অথর অব দ্যা ইয়ার, ২০২১, কচিপাতা সাহিত্য সম্মান, ২০২১ তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য।



কমিউনিটি : আমার বাংলা ব্লগ

ধন্যবাদ জানাই আমার বাংলা ব্লগের সকল সদস্যবন্ধুদের৷ ভালো থাকুন, ভালো রাখুন।

44902cc6212c4d5b.png


Authors get paid when people like you upvote their post.
If you enjoyed what you read here, create your account today and start earning FREE STEEM!
Sort Order:  

Upvoted! Thank you for supporting witness @jswit.

আরে বাহ! আমি অবশ্য আগে চিনতাম না উনাকে, নামও শুনি নি কখনো। তবে আপনার পোষ্ট টি পড়ে অনেক কিছুই জানলাম। আসলে বর্তমানে যা যা খুবই " নরমাল"- তা যখন শুরু হয়, তখন অভাবনীয় ই ছিলো! যেমনটি বিজ্ঞাপন দিয়ে মার্কেটিং এর বিষয়টি! আবার বিলেত গিয়ে শিখে এসেছেন! পাশাপাশি যোগ্য উত্তরসূরীও তৈরি করে যেতে পেরেছেন। নইলে সে দোকান আজও এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতো না, হয়তো কালের সাথে হারিয়ে যেতো!

একদম ঠিক বলেছেন। যারা কৃতী, তাদের আটকে রাখা যায় না। আমার লেখা আপনার ভালো লাগায় আমি আপ্লুত।

অনেকদিন আপনার লেখা পড়িনা। খুজছিলাম আজ। হেডিং দেখেই মনেহলো এটা কৌশক'দার লেখা। পরে দেখলাম আসলেই তাই। 😅✌️

বরাবরের মতই দারুণ ইতিহাস নির্ভর লেখা৷ উনার সম্পর্কে জানতাম না। জেনে খুবই ভালো লাগলো। মনেহল আমাদের টমাস এডিসন। একটা বিষয় খেয়াল করেছি, মেধাবী মানুষগুলোর বাল্যকালেই তারা স্বাক্ষর রেখে আসে।

ভাই আপনি পড়লেন বলে ভালো লাগলো। চেষ্টা করি আঞ্চলিক ইতিহাস গুলো আপনাদের সামনে তুলে আনতে। আপনারা পড়েন বলেই আমার কাজ করতে আরো সুবিধা হয়। ভালো থাকুন এবং সঙ্গে থাকুন।