কলকাতার ঐতিহ্য ইন্ডিয়ান কফি হাউস
কলকাতা শহরের কথা হলেই যে জায়গার কথা প্রথমেই উঠে আসে তা হল কফি হাউস। আসলে বাঙালি আড্ডা দিতে বরাবরই ভালোবাসে। আর সেই আড্ডার তীর্থস্থান হল কলেজ স্ট্রিটে অবস্থিত ইন্ডিয়ান কফি হাউস। আপনারা সকলেই হয়তো এই কফি হাউজের নাম শুনেছেন। আসলে কলেজ স্ট্রিটের বুকে পড়াশুনা করবার সুবাদে এই কফি হাউসে কিশোর বয়স থেকে আড্ডা দিয়ে আসছি মাঝেমাঝেই।
এই সূত্র ধরে মনে পড়ে যায় স্কুল থেকে বেরিয়ে বন্ধুদের সাথে কফি হাউজ যাওয়ার গল্প। কিন্তু তখন যেন বিষয়টা অপরাধের মত ছিল। আসলে স্কুলের শিক্ষকদের চোখে ধুলা দিয়ে এবং বাবা মাকে লুকিয়ে কফি হাউসে গিয়ে এক ঘন্টা বসে থাকতে বেশ রোমাঞ্চ অনুভব হতো। কফি হাউজ তখন ছিল নিজেকে বড় প্রতিপন্ন করবার জায়গা। ছেলেবেলায় সেই তাগিদরা ভীষণভাবে জাঁকিয়ে বসেছিল মাথায়। আসলে কলকাতায় লেখাপড়া করা ছেলেরা সব সময়ই একটু বেশি পাকা হয় বলে শুনেছি। যদিও আমি নিজে বরাবর কলকাতায় পড়াশোনা করেছি বলে অন্য জায়গার সঙ্গে এর পার্থক্য নিরূপণ করতে পারিনি। তবে আমরা সমস্ত পড়াশোনা এবং স্কুল টাইমের বাইরেও বন্ধুদের সঙ্গে যে সময়টা কাটাতাম তা খুব ভালোলাগার একটা মুহূর্ত ছিল। অন্যায় যে একেবারে করিনি তা নয়। কিন্তু তার মধ্যেও ছিল যেন রহস্য-রোমাঞ্চের গন্ধ। কফি হাউসে বসে সব সময় আশপাশটা দেখতাম যে কোন টিচার আমাদের দেখে নিলো কিনা। আজ এই বয়সে বুক ফুলিয়ে কফি হাউজের আড্ডা মারি। কিন্তু সেই বয়সের সঙ্গে নস্টালজিয়ার লুকোচুরি খেলতেই যেন আজও ভালো লাগে।
আজও কলেজ স্ট্রিট গেলে একবার অন্তত বসে আসি ইন্ডিয়ান কফি হাউসে। কলকাতার ঐতিহ্যকে মেপে দেখতে হলে কফি হাউসের গন্ধ একবার নিতেই হবে। আড্ডা ছাড়া যেমন বাঙালি হয় না, ঠিক তেমন কফি হাউস ছাড়া আড্ডা হয় না। কফি হাউজের টেবিলে বসে এক কাপ ব্ল্যাক কফি নিয়ে কাগজে দুলাইন কবিতা লেখার যে কি সুখ তাই যে না করেছে তার পক্ষে জানা সম্ভব নয়। কে বসেননি এই কফি হাউসে? সত্যজিৎ রায় থেকে শুরু করে শক্তি চট্টোপাধ্যায় বা সুনীল গাঙ্গুলীর মত লেখকরা প্রতিনিয়ত আড্ডা দিতেন কফি হাউসে বসে। সারা বাংলার শিল্প-সংস্কৃতির মুক্তাঙ্গন এই ইন্ডিয়ান কফি হাউস।
জানেন ঠিক কত বছরের পুরনো আমাদের কফি হাউস? নয় নয় করে মাঝখানে পার হয়ে গেছে প্রায় ১৫০ বছর। ১৮৪১-৪২ সাল নাগাদ ইন্ডিয়ান কফি বোর্ড প্রথম সিদ্ধান্ত নেয় সেন্ট্রাল এভিনিউতে কফি হাউস করবার। তারপর ১৮৭৬ সালে কলেজ স্ট্রিটে অ্যালবার্ট হলে খোলা হয় কফি হাউজ। সেই থেকেই শুরু হয় বাঙালির আড্ডা মারা। সেই প্রথা আজও চলে আসছে সমানে। চিত্র পরিচালক থেকে শুরু করে কবি সাহিত্যিক বা চিত্রশিল্পীরাও প্রতিদিন এখানে বসে পড়েন সৃষ্টির আনন্দে। আড্ডা মারতে মারতে তাঁদের সৃষ্টিশীলতায় একটু শান দিয়ে নেওয়াই আসলে প্রধান কাজ।
আমি সুযোগ পেলে মাঝে মাঝেই যাই কফি হাউসে। কোন একটি টেবিলে বসে অর্ডার করি গরম কফির। যদিও ব্ল্যাক কফি আমার পছন্দ নয়। তাই গ্রীষ্মকালে কোল্ড কফি আর শীতকালে মিল্ক কফি নিয়ে বসে পড়লেই কেল্লা ফতে। সাথে বড় বড় সিঙ্গারা বা স্যান্ডউইচ তো আছি। যদিও ব্যক্তিগতভাবে আমি কফি হাউসে গেলে শুধু কফিটাই খেতে পছন্দ করি। বাকি সমস্ত কিছু তো সর্বত্রই পাওয়া যায়। কিন্তু এমন সুন্দর কফি আপনি কলকাতায় হাতেগোনা জায়গায় পাবেন। বর্তমানে কফি হাউসের অনেকগুলি শাখা রয়েছে। কলেজটির ছাড়াও যাদবপুর বা চাঁদনী চকে এর শাখা রয়েছে। সবকটি শাখাতেই সব সময় লেগে থাকে মানুষের ভিড়। আড্ডামুখী বাঙালি কফি হাউজে বসে আড্ডা দেওয়ার সুযোগ ছাড়তে পারে না কখনো। তাই মিটিং প্লেস হিসেবে কফি হাউজের জুড়ি মেলা ভার। আর দেশ-বিদেশ থেকে আসা অতিথিরাও সুযোগ করে দুদন্ড বসে স্বাদ নিয়ে যান কলকাতার বিখ্যাত আড্ডা সংস্কৃতির।
আজ কলকাতার আড্ডার ঐতিহ্য ইন্ডিয়ান কফি হাউস নিয়ে একটু লিখতে ইচ্ছে করলো। কয়েকবার যাওয়ার সুবাদে কিছু ছবি তুলে রেখেছিলাম নিজের কাছে। সেগুলি আপনাদের সঙ্গে শেয়ার করলাম। যদি আমার পোস্ট আপনাদের কাছে তথ্যবহুল মনে হয়, তবে অবশ্যই মন্তব্যের মাধ্যমে আমাকে জানাবেন। আর কলকাতায় এলে অবশ্যই ইন্ডিয়ান কফি হাউসে কিছুটা সময় কাটিয়ে যাবেন। না না, ভাববেন না আমি কফি হাউসের বিজ্ঞাপন করছি। আসলে নিজের ভালোলাগাটুকুই আপনাদের কাছে ব্যক্ত করছি। ব্যাস এইটুকুই আমার উদ্দেশ্য। ভালো থাকুন সকলে।
🙏 ধন্যবাদ 🙏
(১০% বেনিফিশিয়ারি প্রিয় লাজুক খ্যাঁককে)
--লেখক পরিচিতি--
কৌশিক চক্রবর্ত্তী। নিবাস পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলায়। পেশায় কারিগরি বিভাগের প্রশিক্ষক। নেশায় অক্ষরকর্মী। কলকাতায় লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলনের সাথে দীর্ঘদিন যুক্ত৷ কলকাতা থেকে প্রকাশিত কবিতার আলো পত্রিকার প্রধান সম্পাদক। দুই বাংলার বিভিন্ন প্রথম সারির পত্রিকা ও দৈনিকে নিয়মিত প্রকাশ হয় কবিতা ও প্রবন্ধ। প্রকাশিত বই সাতটি৷ তার মধ্যে গবেষণামূলক বই 'ফ্রেডরিক্স নগরের অলিতে গলিতে', 'সাহেবি কলকাতা ও তৎকালীন ছড়া' জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। সাহিত্যকর্মের জন্য আছে একাধিক পুরস্কার ও স্বীকৃতি। তার মধ্যে সুরজিত ও কবিতা ক্লাব সেরা কলমকার সম্মান,(২০১৮), কাব্যলোক ঋতুভিত্তিক কবিতায় প্রথম পুরস্কার (বাংলাদেশ), যুগসাগ্নিক সেরা কবি ১৪২৬, স্রোত তরুণ বঙ্গ প্রতিভা সম্মান (২০১৯), স্টোরিমিরর অথর অব দ্যা ইয়ার, ২০২১, কচিপাতা সাহিত্য সম্মান, ২০২১ তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য।
কমিউনিটি : আমার বাংলা ব্লগ
ধন্যবাদ জানাই আমার বাংলা ব্লগের সকল সদস্যবন্ধুদের৷ ভালো থাকুন, ভালো রাখুন।
https://x.com/KausikChak1234/status/1850640814285750516?t=Fc-5cnoWFEoL3dP5Q7qiNg&s=19
Downvoting a post can decrease pending rewards and make it less visible. Common reasons:
Submit
Upvoted! Thank you for supporting witness @jswit.
Downvoting a post can decrease pending rewards and make it less visible. Common reasons:
Submit
সবই তো বুঝলাম সবই জানলাম কিন্তু ওই কফির প্লেট হাতে নিয়ে ছবিটবি তুললে কবে? মানে আমাকে বাদ রেখে ভালোই কফি হাউসে যাচ্ছো! আমায় তো নিয়ে গেলে না একবারও! এবারে আমি কফি হাউসে আড্ডার কল দেব৷ তোমায় ছবি পাঠাব, বুঝবে ঠেলা। 😂😂
Downvoting a post can decrease pending rewards and make it less visible. Common reasons:
Submit
তুই কফি হাউসে আড্ডার কল দিলে আমি আপনা থেকেই পৌঁছে যাব। এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। হাহাহাহা।
Downvoting a post can decrease pending rewards and make it less visible. Common reasons:
Submit
আড্ডা ছাড়া যেন বাঙালির ভাত হজম একেবারেই হয় না ভাই হা হা। এই কফি হাউজ সম্পর্কে মোটামুটি জানি। কলকাতার বেশ জনপ্রিয় একটা জায়গা। এবং এই কফি হাউজের বেয়ারা রা নাকি এখনও ঐতিহ্যবাহী পোষাক পরিধান করে। চমৎকার লাগল আপনার টা। ধন্যবাদ আপনাকে।।
Downvoting a post can decrease pending rewards and make it less visible. Common reasons:
Submit
আমার তোলা একটি ছবির সামনেই দেখুন সাদা পোশাক পরিহিত পাগড়ী পরা বেয়ারাকে দেখা যাচ্ছে। তারা এখনো প্রাচীন পোশাক পরিধান করেই থাকে।
Downvoting a post can decrease pending rewards and make it less visible. Common reasons:
Submit