রাজা রামমোহন রায় এবং তাঁর গ্রাম রাধানগর
সুরাই মেলের কুল,
বেটার বাড়ি খানাকুল,
বেটা সর্বনাশের মূল,
ওঁ তৎসৎ বলে বেটা বানিয়েছে ইস্কুল;
ও সে জেতের দফা করলে রফা
মজালে তিন কুল।
কলকাতায় শিক্ষিত সমাজের নেতৃত্বে ততদিনে গড়ে উঠেছে জনমত। নিরীহ মেয়েদের জোর করে পুড়িয়ে মারার প্রতিবাদে জনমত সংগ্রহ করতে ছুটে বেড়াচ্ছেন খানাকুলের ব্রাহ্মণ রামমোহন। কলকাতার মানুষ মুখে মুখে এমন ছড়া কাটছে তাঁকে ও তাঁর কাজকর্ম নিয়ে কটাক্ষ করে।
হুগলি জেলার এক বর্ধিষ্ণু গ্রাম রাধানগর৷ খানাকুলের সেই গ্রামে পৌঁছে আজও যেন টের পেলাম ইতিহাসের অমোঘ টান। দুপাশে আলু চাষ আর ধান চাষের জমি, মাঝেমাঝে রাঙালু চাষও দেখতে দেখতে এগিয়ে গেলাম গন্তব্যে। একমাত্র গন্তব্য বাঙালীর আসল রাজাকে খুঁজে বের করা। আর যা কখনোই রাধানগরকে ছাড়া সম্ভব না। কলকাতার আমহার্স্ট স্ট্রিটে দীর্ঘদিন থাকলেও রামমোহন রায়ের পৈত্রিক ভিটে রাধানগর গ্রামেই। ডানকুনি থেকে সড়কপথে অহল্যাবাঈ হোলকার রোড ধরে সোজা ঘন্টা দেড়েক এগিয়ে গেলে মায়াপুর গ্রাম। সেখান থেকে বাঁয়ে আধঘন্টা গেলেই পৌঁছে যাওয়া যায় রাধানগরে। পাশেই গ্রাম কৃষ্ণনগর, পাতুল, রঘুনাথপুর। সবকটি জায়গারই ঐতিহাসিক গুরুত্ব অপরিসীম। বলে শেষ করবার মত নয়৷ অসংখ্য ঐতিহাসিক নিদর্শন, স্থাপত্য, অভিরাম গোস্বামীর শ্রীপাট, টেরাকোটার গোপীনাথ মন্দির, ঘন্টেশ্বর শিব মন্দির। পর্যটন স্থান হিসাবে যা যা প্রয়োজন, তার অনেক বেশি রসদ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে খানাকুল৷ তারকেশ্বর রেলওয়ে স্টেশন থেকে গেলে বাসে ৩২ কিলোমিটার রাস্তা। কলকাতার অদূরেই এমন যে এক ঐতিহাসিক পর্যটন স্থান লুকিয়ে রয়েছে লোকে চক্ষুর আড়ালে , তা ক'জন কলকাতাবাসীই বা জানেন?
রাজা রামমোহন রায়ের পরিবার একসময় এসেছিলেন কনৌজ থেকে। পদবীতে মুখোপাধ্যায় হলেও রায় উপাধি পেয়েছিলেন নবাবের থেকে। শোনা যায় তার প্রপিতামহ কাজ করতেন নবাব অজিমুশ্বানের দপ্তরে। রামমোহনের বাবা রামকান্ত রায় ছিলেন গোঁড়া ব্রাহ্মণ। ছেলের একেশ্বরবাদ এবং পৌত্তলিকতার বিরুদ্ধে লড়াই মেনে নিতে না পেরে একসময় ত্যাজ্য পুত্র করেন এবং তাড়িয়ে দেন ঘর থেকে। এ গল্প কে না জানে? কিন্তু তাঁকে চিনতে হলে যেতে হবে রাধানগর। ছুঁয়ে আসতে হবে তার বসত ভিটের মাটি। পৌঁছে প্রথমেই গেলাম নাঙ্গুলপাড়া গ্রামে রাজা রামমোহন রায় বসদভিটে পর্যটন কেন্দ্রে। আমার এবারের সফর সঙ্গী ওই গ্রামেরই বাসিন্দা ও আমার সাহিত্য সংস্কৃতির পথ চলার সহযাত্রী অগ্রজ ও বন্ধু মাণিক পণ্ডিত। তাঁর মুখে গল্প শুনতে শুনতেই সরু পথ ধরে এগিয়ে চলা। দুজনে যখন এসে দাঁড়ালাম রামমোহন রায় বসতভিটে পর্যটন কেন্দ্রে, দেখলাম বাড়ির ভগ্নপ্রায় কিছু অবশিষ্টাংশ নিয়ে পড়ে থাকা একটা স্থাপত্যের আশপাশে সুন্দর বাগান করে তৈরি করা হয়েছে এই পার্ক। পার্ক বলছি বটে, কিন্তু জায়গাটি আদ্যোপান্ত ঐতিহাসিক। বাড়িটির কিছু দেয়াল আর কয়েকটি দরজার অংশ ছাড়া কিছুই আর নেই। কিন্তু এই তাঁর পৈত্রিক ভিটে নয়। ওইখান থেকে দেড় কিলোমিটার দূরে রাধানগরে রয়েছে তাঁর বাবার বসত ভিটে। যদিও সেই বাড়ির সিকিভাগও আজ আর অবশিষ্ট নেই। হাজার খুঁজেও তার ভাঙা ইটের কোন টুকরোও খুঁজে পাইনি আশপাশ থেকে। কিন্তু সেই জায়গায় সুসজ্জিত ইমারত হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে রাজা রামমোহন রায় স্মৃতি মন্দির। ১৯১৬ সালে যা নির্মাণ করা হয় এবং বাড়িটির সম্পূর্ণ স্থাপত্যশৈলী নিজের হাতে এঁকে দেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। এই পৈত্রিক ভিটেতে রবীন্দ্রনাথ তৈরি করিয়েছিলেন মন্দির মসজিদ এবং গির্জার আদল। যদিও মন্দিরও মসজিদের স্পষ্টচিহ্ন থাকলেও গির্জার চিহ্ন চোখে পরলো না। রাজা রামমোহন রায়ের দৌহিত্র বংশের বর্তমান পুরুষের সাথে কথা বলে জানতে পারলাম স্মৃতি মন্দিরের পেছনে গির্জার ভিত তৈরি হয়ে গেলেও অর্থ সংকটের কারণে তা আর তৈরি করা হয়ে ওঠেনি। বাড়িটির মুখ্য দরজা দিয়ে ঢুকে বাঁদিকে একটি ছোট মন্দির। তাঁর কাছেই জানলাম সেখানেই জন্মেছিলেন রাজা। যদিও এসবই প্রমাণসাপেক্ষ। ভূমি বা ভগ্নাবশেষ থেকে যত সহজে নমুনা সংগ্রহ করা যায়, পুনর্নির্মাণের ক্ষেত্রে ঐতিহাসিক মূল্য কেবল অনুমান নির্ভর। পুরনোকে বুকে করে বয়ে নিয়ে যাওয়ার গুরুত্বই আলাদা। তবু নিজেদের মত করে রাজার স্মৃতি বাঁচিয়ে রেখেছে আজকের রাধানগর ও সেখানকার স্থানীয় অধিবাসীগণ৷ আন্তরিকতায় খামতি নেই।
ইতিহাসের ঘটনাপ্রবাহ বলে রামমোহনকে ত্যজ্যপুত্র করার পর তিনি নিজের বাড়ি তৈরি করেন নাঙ্গুলপাড়ায়। পাশের গ্রাম রঘুনাথপুর। সেখানেও ছড়িয়ে ছিটিয়ে তাঁর বিভিন্ন স্মৃতিচিহ্ন। তাঁর খনন করা তালপুকুর হোক অথবা নিজস্ব ঘাট, সব জায়গাতেই আজও তিনি। ভগ্নপ্রায় বাড়িটির রক্ষণাবেক্ষণের একটা চেষ্টা সরকারের তরফে করা হয় ঠিকই, কিন্তু তাতেও আটকানো যাচ্ছে না ক্ষয়। বিশেষ করে এমন ঐতিহাসিক জায়গা যদি বনভোজন আর চড়ুইভাতি কেন্দ্রে পরিণত হয়, তবে অবক্ষয়ের কী আর বাকি থাকে? আশপাশটা ঘুরতে ঘুরতে আশাহত হলাম বেশ কিছু পারিপার্শ্বিক দৃশ্যে। রামমোহনের স্মৃতিবিজড়িত মন্দিরের গা ঘেঁষে এমন কিছু দৃশ্য চোখে পড়ে, যা সেই স্থানের ঐতিহাসিক মূল্যের পরিপন্থী নয়। এই বিষয়টিতে সংশ্লিষ্ট কতৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। ইতিহাসকে ধরে রাখতে হলে প্রয়োজন আকর্ষণ। যে অমোঘ টানে মানুষ ডুবে যায় হাজার বছর পিছনেও। আর তার জন্য সবার আগে দরকার পরিবেশ।
যাই হোক। সেই পার্কের মধ্যেই আর একটি ঐতিহাসিক স্মৃতিচিহ্ন চোখে পড়ল। সতীদাহ বেদী। এ উপলক্ষে প্রথমেই একটা ঘটনা বলি। ১৮১১ সালে রামমোহন তাঁর বড়বৌঠান অলক মঞ্জরী দেবীর সতী হবার ঘটনাকে মেনে নিতে পারেননি জীবনেও। চোখের সামনে দেখেছেন নিজের মানুষটাকে মৃত বড়দাদার সাথে জ্বলে পুড়ে শেষ হয়ে যেতে। সহ্য করতে না পেরে বৌঠানের কাছে পুত্রস্নেহে মানুষ রামমোহন সেই জায়গাতেই দাঁড়িয়ে প্রতিজ্ঞা করেন সতীদাহ প্রথার মত নারকীয় প্রথা উচ্ছেদের। বাংলার বুকে যারই ফল প্রকাশ হয় ১৮৩১ সালের ৪ই মে। উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক সাহেব সহমত হয়ে আইন করে নিষিদ্ধ করেন হিন্দু সমাজে সতী হবার কুপ্রথা। সেই ঐতিহাসিক স্থানটি আজ সতীদাহ বেদী বলে পরিচিত৷ সামনেই রাজার আবক্ষ মূর্তি। পরে ১৮১৭ সালে এর পাশেই বসতবাড়ি নির্মাণ করে উঠে এসেছিলেন তিনি। দীর্ঘদিন কলকাতায় থাকাকালীন তাঁর স্ত্রী উমা দেবী এই বাড়িতেই থাকতেন। আজও এই ভাঙাচোরা ইটগুলোর ঐতিহাসিক মূল্য অপরিসীম। কিন্তু এই মহান সম্পদ রক্ষায় আরও কিছুটা যত্নশীল হবার জন্য আবেদন রেখে গেলাম কতৃপক্ষের কাছে৷
রাধানগর গ্রামে আর একটি সৌধের কথা না বললেই নয়। রামমোহন রায়ের সমাধি স্মৃতি মন্দির। রাজার পৈত্রিক ভিটের ঠিক বিপরীতে। ইংল্যন্ডের বৃষ্টলে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছিলেন বাংলার নবজাগরণের অন্যতম শ্রেষ্ঠ পথিকৃৎ। সেখান থেকেই সমাধির মাটি এনে রাধানগর গ্রামে তৈরি করা হয়েছে সেই সমাধি সৌধের রেপ্লিকা। বৃষ্টলের সমাধির আদলেই। অসাধারণ তাঁর স্থাপথ্যশৈলী। বিপরীতেই রামমোহন লাইব্রেরী। এমনকি অদূরেই রয়েছে রামমোহন ডিগ্রী কলেজ। এককথায় সম্পূর্ণ খানাকুলই রামমোহন ময়। সবদিকে ছড়িয়ে আছে তাঁর ছায়া আর সুগন্ধ। তবু পর্যটকহীন। হুগলী ও পশ্চিম মেদিনীপুর সীমানা লাগোয়া এই জায়গার মধ্যে অসামান্য রসদ আছে বড় পর্যটনকেন্দ্র হয়ে ওঠার। কিন্তু হয়ে ওঠেনি। কেন? সেই প্রশ্ন তোলা থাক প্রশাসন ও কতৃপক্ষের জন্য। বিকেলেই মিঠে রোদ হেলে পড়তে পড়তে আমি রওনা দিলাম গৃহ অভিমুখে। অনেকটা রাস্তা ফিরতে হবে যে। রাতের অন্ধকার নেমে এলে গাড়ি চালানো মুশকিল। আপাতত ভালো থেকো রাধানগর। জয়তু রাজা রামমোহন রায়।
🙏 ধন্যবাদ 🙏
(১০% বেনিফিশিয়ারি প্রিয় লাজুক খ্যাঁককে)
--লেখক পরিচিতি--
কৌশিক চক্রবর্ত্তী। নিবাস পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলায়। পেশায় কারিগরি বিভাগের প্রশিক্ষক। নেশায় অক্ষরকর্মী। কলকাতায় লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলনের সাথে দীর্ঘদিন যুক্ত৷ কলকাতা থেকে প্রকাশিত কবিতার আলো পত্রিকার প্রধান সম্পাদক। দুই বাংলার বিভিন্ন প্রথম সারির পত্রিকা ও দৈনিকে নিয়মিত প্রকাশ হয় কবিতা ও প্রবন্ধ। প্রকাশিত বই সাতটি৷ তার মধ্যে গবেষণামূলক বই 'ফ্রেডরিক্স নগরের অলিতে গলিতে', 'সাহেবি কলকাতা ও তৎকালীন ছড়া' জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। সাহিত্যকর্মের জন্য আছে একাধিক পুরস্কার ও স্বীকৃতি। তার মধ্যে সুরজিত ও কবিতা ক্লাব সেরা কলমকার সম্মান,(২০১৮), কাব্যলোক ঋতুভিত্তিক কবিতায় প্রথম পুরস্কার (বাংলাদেশ), যুগসাগ্নিক সেরা কবি ১৪২৬, স্রোত তরুণ বঙ্গ প্রতিভা সম্মান (২০১৯), স্টোরিমিরর অথর অব দ্যা ইয়ার, ২০২১, কচিপাতা সাহিত্য সম্মান, ২০২১ তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য।
কমিউনিটি : আমার বাংলা ব্লগ
ধন্যবাদ জানাই আমার বাংলা ব্লগের সকল সদস্যবন্ধুদের৷ ভালো থাকুন, ভালো রাখুন।
https://x.com/KausikChak1234/status/1884323973074411903?t=OCFNjaF7xXNoqOYPUnqPKQ&s=19
Downvoting a post can decrease pending rewards and make it less visible. Common reasons:
Submit
Daily tasks-
Downvoting a post can decrease pending rewards and make it less visible. Common reasons:
Submit
Upvoted! Thank you for supporting witness @jswit.
Downvoting a post can decrease pending rewards and make it less visible. Common reasons:
Submit
অনেক সুন্দর একটি ঐতিহ্যবাহী স্থান ভ্রমণ করে আপনি আমাদের মাঝে শেয়ার করেছেন দাদা। খুবই ভালো লাগলো আপনার লেখাগুলো পড়ে। বিশেষ করে রাজা রামমোহন রায়ের পৈত্রিক ভিটে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আপনি আমাদের মাঝে শেয়ার করেছেন। যেগুলো এর আগে আমার কাছে সম্পূর্ণ অজানা ছিল। যাহোক অনেক সুন্দর একটি পোস্ট আমাদের মাঝে শেয়ার করার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।
Downvoting a post can decrease pending rewards and make it less visible. Common reasons:
Submit
চেষ্টা করেছি ভাই ঐতিহাসিক জায়গাটি ঘুরে তার নিদর্শন আপনাদের সামনে তুলে আনতে। আপনার ভালো লেগেছে জেনে খুব আনন্দ হল।
Downvoting a post can decrease pending rewards and make it less visible. Common reasons:
Submit
এই জাতীয় পোস্টগুলো অতীতকে ভাবতে শেখায় এবং অতীতের ইতিহাস গুলো পুনরায় পড়ার উৎসাহ জাগায়। অনেক ভালো লাগলো দাদা আপনার ভ্রমণ এই পোস্ট এবং অসাধারণভাবে উপস্থাপন করেছেন বেশ কিছু তথ্য। আপনার এই পোস্ট আমাদের মাঝে উপস্থাপন করার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ দাদা।
Downvoting a post can decrease pending rewards and make it less visible. Common reasons:
Submit
একদম ঠিক বলেছেন ভাই। অতীত হলো এমন একটি বস্তু যা ভবিষ্যতের জমিকে শক্ত করে। এমন সুন্দর একটি মন্তব্য করলেন বলে খুব ভালো লাগলো।
Downvoting a post can decrease pending rewards and make it less visible. Common reasons:
Submit