কলকাতার গণমাধ্যমের ঐতিহ্য - মেটকাফে হল
কলকাতায় হেয়ার স্ট্রিট আর স্ট্র্যান্ড রোডের সংযোগস্থলে কোরিন্থিয়ান থামের ওপরে দাঁড়িয়ে থাকা বাড়িটার সামনে ওপরের দিকে মস্ত বড় করে লেখা 'মেটকাফে হল'। সে আজও কলকাতার বুকে দাঁড়িয়ে থাকা এক মস্ত মধ্যযুগীয় প্রাসাদ। এই গ্রীক কোরিন্থিয়ান স্থাপত্যের প্রতি ইংরেজদের ছিল এক তীব্র টান। আজও শহর কলকাতার বহু শতবর্ষ প্রাচীন বাড়িগুলো অনায়াসে দাঁড়িয়ে রয়েছে শুধুমাত্র চওড়া চওড়া থামের ওপরে নির্ভর করে। মেটকাফে হলও ঠিক তেমনই একটি স্থাপত্য। কিন্তু কে এই মেটকাফে সাহেব? কেন তাঁর নামে আস্ত একখানা বিশাল ভবন, যা কলকাতায় হেস্টিংস বা কার্জন সাহেবের মতো নামী ও দোর্দণ্ডপ্রতাপ শাসকদের নামেও নেই। ১৮৩৫ সাল থেকে মাত্র এক বছরেরও কম সময়ে থাকা ভারতের গভর্নর জেনারেলকে মনে রাখতে কলকাতাবাসীর এ এক ঋণশোধের ইমারত। স্যার চার্লস থিওফিলাস মেটকাফে। উইলিয়াম বেন্টিংক সাহেবের অবসর গ্রহণ এবং বিলেত থেকে গভর্নর জেনারেল হিসাবে পদাধিকারী কারও কলকাতায় আসা, এই সামান্য সময়টুকুর মধ্যে ভারপ্রাপ্ত গভর্নর জেনারেল হলেন মেটকাফে সাহেব। না তিনি স্থায়ী প্রশাসন ছিলেন না, কিন্তু ভারতীয় সংবাদমাধ্যমের ইতিহাসে তিনি আজও কিংবদন্তি পুরুষ। কলকাতার মানুষ আজও তাঁর ওই ছোট্ট সময়কালকে জীবন্ত ধরে রেখেছে মেটকাফে হলের প্রত্যেকটি ইটে। চিরকালই স্বাধীন গণমাধ্যমের ওপর ইচ্ছেমতো আঘাত করে এসেছে ব্রিটিশ সরকার বাহাদুর। ওয়ারেন হেস্টিংসের সময়ে তো সরকার ও ব্রিটিশ রাজপুরুষদের সমালোচনা করে ঘোরতর নির্মম শাস্তিরও মুখে পড়তে হয় সংবাদপত্রকারদের।
সাহেব হোক বা বাঙালি, সবসময় তুষ্ট করতে হবে শাসককে। এই যেন চিরায়ত রীতি। দীনবন্ধু মিত্রের নীলদর্পণ ইংরাজিতে অনুবাদের পর পাদ্রী জেমস লং সাহেবকে পর্যন্ত ছেড়ে কথা বলেনি ব্রিটিশরা। কিন্তু সেক্ষেত্রে এগিয়ে এসেছিলেন এদেশেরই যোগ্য সন্তান প্রখ্যাত লেখক ও ঔপন্যাসিক কালীপ্রসন্ন সিংহ। জরিমানার এক হাজার টাকা তিনি জমা দিয়ে সম্মান বাঁচান জনদরদী লং সাহেবের। এটাই হল চিরাচরিত শাসকের চরিত্র। কিন্তু ব্যতিক্রম কি নেই? অবশ্যই আছে। তখনও ছিল। আর তেমনই একটি নাম চার্লস মেটকাফে। সংবাদপত্রের ইতিহাস আজও বিখ্যাত করে রেখেছে এই ইংরেজ শাসকের নাম। ১৯৩৬ সালে বিলেত থেকে গভর্নর জেনারেল হয়ে আসেন লর্ড অকল্যান্ড বা বিখ্যাত ইডেন সাহেব। আর তখনই মেয়াদ শেষ হয় অস্থায়ী শাসক লর্ড মেটকাফের। কিন্তু এই স্বল্পমেয়াদেই তিনি হয়ে ওঠেন ভারতীয় গণমাধ্যমের মুক্তিদাতা পুরুষ। সে এক আশ্চর্য গল্প।
গভর্নর জেনারেল হিসাবে অভিষেকের পর থেকেই বিভিন্ন গণমাধ্যম তাদের উপর এযাবৎ চাপিয়া দেওয়া বিভিন্ন সরকারি নিয়ম ও বিধিনিষেধের বিরুদ্ধে চিঠি লিখতে থাকে তাঁর দপ্তরে। নড়েচড়ে বসেন মেটকাফে সাহেবও। গণমাধ্যমের স্বাধীনতা না থাকলে যে কোনো দেশই উন্নতির পথে মসৃণ পায়ে হাঁটতে পারবে না, তা প্রথম উপলব্ধি করেন তিনিই। ততদিনে ভারতীয় গণমাধ্যম কোম্পানি বাহাদুরের আইন-কানুনের গেরোয় একেবারে বিপর্যস্ত। গভর্নর জেনারেলের দপ্তরে জমা হওয়া একাধিক চিঠির ওপর ভিত্তি করে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা বিষয়ক আইনে আমূল পরিবর্তন আনেন তিনি। তাঁর হাত ধরেই নতুন করে জেগে ওঠে ভারতীয় গণমাধ্যম। এদেশে আসা থেকেই ব্রিটিশদের কেবল দমননীতিই দেখেছে ভারতীয়রা। সামান্য দোষে ফাঁসির মত শাস্তি থেকে শুরু করে নিজেদের পছন্দমতো খবর পরিবেশন না করলে রেজিস্ট্রেশন বাতিল, সবই প্রত্যক্ষ করেছে পরাধীন ভারত। কিন্তু তার মধ্যেও এসেছেন মেটকাফে সাহেবরাও। কলকাতাবাসীও ভোলেনি তাঁদের।
ঠিক তেমন ভাবেই গড়ে ওঠে মেটকাফে হলও। কিন্তু ইতিমধ্যে কলকাতায় প্রয়োজন একটি পাবলিক লাইব্রেরী। বলাই বাহুল্য, ইংরেজদের উদ্যোগে কলকাতা শহরে তৈরি হয়েছে সবই। স্কুল, কলেজ, কোর্ট, উপাসনাস্থল থাকলেও নেই কোনো সমৃদ্ধ লাইব্রেরী। ব্যক্তিগত মালিকানায় কয়েকটি থাকলেও তা আমজনতার সাধ্যের মধ্যে নয়। সুতরাং খোঁজ পড়লো জমির। স্ট্র্যান্ড রোডের ধারে পাওয়াও গেল জমি। ১৮৪০ সালে সেই জমিতেই শুরু হয়ে গেল বিশাল ভবন তৈরির কাজ। কলকাতাবাসীর চাঁদার টাকায় তৈরি এই বাড়ির নাম রাখা হল মেটক্যাফে হল। অর্থাৎ উদার ইংরেজ শাসক পুরুষ মেটক্যাফে সাহেবকে চিরস্মরণীয় করে রাখবার জন্যই শহরবাসীর এক প্রচেষ্টা। হলও তাই। ১৮০ বছর পেরিয়েও যেন নব্যযুবক এই ভবন। স্যার চার্লস রবিনসনের ডিজাইনে ও গ্রীক স্থাপত্যে নির্মিত এই প্রাসাদই হয়ে উঠলো সেই সময় কলকাতার বই সাম্রাজ্যের নিয়ামক। দীর্ঘ ৪ বছর পর ১৮৪৪ খ্রিষ্টাব্দে সম্পূর্ণ হল মেটক্যাফে হলের নির্মাণকাজ। মাটি থেকে প্রায় ৫০ ফুট উঁচু এই মেটক্যাফে হল গড়ে উঠল ১০ ফুট উঁচু এক ভিতের উপর। যার উপরে প্রায় ৩৬ ফুট উচ্চতার ৩০ টি বিশাল স্তম্ভ ধরে রইল সমস্ত বাড়িটিকে। প্রায় ২৫০০ বছর আগের গ্রীক স্থাপত্যের প্রধান বৈশিষ্ট্যই ছিল কোরিন্থিয়ান স্তম্ভ। গ্রীসে টেম্পল ওফ অলিম্পিয়ান জিউসের স্থাপত্যে যে নির্মাণশৈলী দেখা যায়, তার সাথে বহু মিল আছে আমাদের মেটক্যাফে হলের। কোরিস্থিয়ান স্থাপত্যের মূল নকশাই হল স্তম্ভগুলোর উপরের নিখুঁত কারুকার্য। কলকাতার মেটক্যাফে হল তেমনই একটি ব্যতিক্রমী নির্মাণশৈলীর জলজ্যান্ত উপমা। নীচের তলায় এগ্রি-হর্টিকালচার সোসাইটি ও উপরে ক্যালকাটা পাবলিক লাইব্রেরী নিয়ে শুরু হল এই প্রাসাদের যাত্রা। তারপর কে আসেননি এই ভবনে। প্রিন্স দ্বারকানাথ থেকে শুরু করে জানবাজারের জমিদার বাবু রাজচন্দ্র দাস, সকলের স্মৃতিধন্য এই বাড়ি আজও দাঁড়িয়ে সাক্ষী দিয়ে চলেছে ঊনবিংশ শতকের কলোনিয়াল কলকাতার।
জন্মের প্রায় ৫০ বছর পরে ক্যালকাটা পাবলিক লাইব্রেরী পরিণত হল ইম্পিরিয়াল লাইব্রেরীতে। ১৯০৩ সালের ৩০শে জানুয়ারি ইম্পিরিয়াল লাইব্রেরীর পথ চলা শুরু হবার মুহূর্তে এই লাইব্রেরীর উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করলেন স্বয়ং বড়লাট লর্ড কার্জন। দীর্ঘদিন ধরে চলতে থাকা পাবলিক লাইব্রেরী জীর্ণদশা লাভ করলে সরকারি ইম্পিরিয়াল লাইব্রেরীকে মেটক্যাফে হলে তুলে আনেন তিনি। এমনকি এককালীন ২৮০০০ টাকা ও বছরে ৬০০০ টাকা অনুদানের বিনিময়ে এগ্রি-হর্টিকালচার সোসাইটির শেয়ার কিনে নেয় সরকার৷ অর্থাৎ তখন থেকেই এই ভবন ব্যবহৃত হয় কেবলমাত্র পাবলিক লাইব্রেরী হিসাবে৷ ইম্পিরিয়াল লাইব্রেরীর জন্য লন্ডন থেকে আসেন ইংরেজ অধ্যক্ষ। ১৯০৫ সালের লাইব্রেরী রেজিস্টার বলছে, তখনই ইম্পিরিয়াল লাইব্রেরীর পাঠক ও সদস্য সংখ্যা ৩০২৬৯। প্রতিদিন অসংখ্য বাড়তে থাকে গ্রাহক ও পাঠক সংখ্যা। ধীরে ধীরে মেটক্যাফে হল হয়ে ওঠে সম্পূর্ণ ইংরেজ সরকারের শাসনাধীন একটি সুবিশাল গ্রন্থ সংগ্রহশালা।
কিন্তু পরে আবার বদলে যায় এই ভবনের কার্যধারা। স্বাধীনতার পর এটিই প্রথম ন্যাশনাল লাইব্রেরী। যদিও পরে তা স্থানান্তরিত হয় আলিপুরে নবাব মীরজাফর আলি খাঁর বেলভেদিয়া প্যালেসে। আজও চিড়িয়াখানার উল্টোদিকে সেখানেই রয়েছে কলকাতার গর্ব ন্যাশনাল লাইব্রেরী। কিন্তু এতটুকুও বদলে যায়নি মেটক্যাফে হল৷ আজও ধারে ভারে সে স্বমহিমায় বিরাজমান। ২০১৯ সালে এটি আবার পরিবর্তিত হয়ে গেছে। প্রাচীন মোড়ক থেকে আত্মপ্রকাশ করেছে নতুন রূপে৷ সংস্কার হলেও মূল ভবনের চেহারা ও স্থাপত্য আজও একই। আজ সেখানে গড়ে উঠেছে 'আমি কলকাতা' নামক আধুনিক মিউজিয়াম। বিভিন্ন পুরনো ছবির প্রদর্শনী থেকে হাতে টানা রিক্সা, সবই যত্ন করে রাখা আছে এই সংগ্রহশালায়৷ সময় করে আপনিও একবার টিকিট কেটে সাক্ষী হতে পারেন মেটক্যাফে সাহেবের স্মৃতিবিজড়িত এই ঐতিহাসিক প্রাসাদে। ছুঁয়ে দেখতে পারেন গড়ে উঠতে থাকা নতুন কলকাতার একটি আবহমান কালকথাকে। বাকিটা আর আমাকে বলে দিতে হবে না।
🙏 ধন্যবাদ 🙏
(১০% বেনিফিশিয়ারি প্রিয় লাজুক খ্যাঁককে)
--লেখক পরিচিতি--
কৌশিক চক্রবর্ত্তী। নিবাস পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলায়। পেশায় কারিগরি বিভাগের প্রশিক্ষক। নেশায় অক্ষরকর্মী। কলকাতায় লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলনের সাথে দীর্ঘদিন যুক্ত৷ কলকাতা থেকে প্রকাশিত কবিতার আলো পত্রিকার প্রধান সম্পাদক। দুই বাংলার বিভিন্ন প্রথম সারির পত্রিকা ও দৈনিকে নিয়মিত প্রকাশ হয় কবিতা ও প্রবন্ধ। প্রকাশিত বই সাতটি৷ তার মধ্যে গবেষণামূলক বই 'ফ্রেডরিক্স নগরের অলিতে গলিতে', 'সাহেবি কলকাতা ও তৎকালীন ছড়া' জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। সাহিত্যকর্মের জন্য আছে একাধিক পুরস্কার ও স্বীকৃতি। তার মধ্যে সুরজিত ও কবিতা ক্লাব সেরা কলমকার সম্মান,(২০১৮), কাব্যলোক ঋতুভিত্তিক কবিতায় প্রথম পুরস্কার (বাংলাদেশ), যুগসাগ্নিক সেরা কবি ১৪২৬, স্রোত তরুণ বঙ্গ প্রতিভা সম্মান (২০১৯), স্টোরিমিরর অথর অব দ্যা ইয়ার, ২০২১, কচিপাতা সাহিত্য সম্মান, ২০২১ তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য।
কমিউনিটি : আমার বাংলা ব্লগ
ধন্যবাদ জানাই আমার বাংলা ব্লগের সকল সদস্যবন্ধুদের৷ ভালো থাকুন, ভালো রাখুন।
Upvoted! Thank you for supporting witness @jswit.
Downvoting a post can decrease pending rewards and make it less visible. Common reasons:
Submit
https://x.com/KausikChak1234/status/1848070065268371550?t=P3rYf0y1-OX2iwcamPRPSA&s=19
Downvoting a post can decrease pending rewards and make it less visible. Common reasons:
Submit