কলকাতার প্রথম বেসরকারি উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত স্কুল। ওরিয়েন্টাল সেমিনারি।

in hive-129948 •  2 days ago 

কলকাতার প্রথম বেসরকারি উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত স্কুল

💮💮💮💮💮💮💮💮💮


IMG_20241106_173944_931.jpg

বাগবাজার মায়ের ঘাট। চিত্রগ্রাহক - কৌশিক চক্রবর্ত্তী


🙏 সকলকে স্বাগত জানাই 🙏


ইংরেজ শাসকদের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সাহায্য নিয়েই তখন ইংরাজি শিক্ষা বিস্তারের ধুম পড়ে গেছে এই শহর কলকাতায়। গোলদিঘির পাড়ে শহরের মান্যগণ্য মানুষদের হাত ধরে তৈরি হয়েছে হিন্দু কলেজ। সম্পূর্ণ সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় জাঁকিয়ে বসেছে সংস্কৃত কলেজ। এমনকি হেয়ার সাহেবও নিজের উদ্যোগে স্কুল খুলেছেন। এছাড়াও বিভিন্ন দিকে তৈরি হচ্ছে বেসরকারি উদ্যোগে বিদ্যালয় স্থাপন। নতুন করে বাঙালি যুবকদের পাশ্চাত্য সংস্কৃতিতে শিক্ষাদান করতে উঠেপড়ে লেগেছেন শহরের বিশিষ্ট নাগরিকেরা সবাই। খ্রীষ্টান পাদ্রীদের তৈরি স্কুলেও তখন বাঙালি নওজোয়ানদের ভিড়। ফিরিঙ্গী কমল বসুর নিজের বাড়িতে তৈরি স্কুল থেকে শুরু করে শ্রীরামপুরে উইলিয়াম কেরী সাহেবের তৈরি কলেজ, কোথাওই ছাত্রের অভাব নেই। কিন্তু হিন্দু বাঙালির উদ্যোগে স্কুল একটিও নেই তখন। ফিরিঙ্গী বা পাদ্রীদের স্কুলে সাধারণ ইংরাজি শিক্ষার সাথে সাথে ধর্মের শিক্ষা উঠে আসত খুব প্রাসঙ্গিক ভাবে। কেরী সাহেব যেমন শ্রীরামপুরে গঙ্গার ধারে গীর্জায় খ্রীষ্ট ধর্মে দীক্ষা দিতেন রীতিমতো জাঁকজমক সহকারে। দীক্ষাদানের দিন প্রচুর স্থানীয় মানুষ ভিড়ও জমাতেন শুধুমাত্র এই অনুষ্ঠান দেখবার জন্য। প্রথম দিকে শ্রীরামপুর কলেজ কাউন্সিলের চাপিয়ে দেওয়া শুধুমাত্র ধর্মতত্ত্ব বিষয়ে পড়াশোনার নির্দেশের বিরোধিতা করলেও বিভিন্ন ধর্ম থেকে খ্রীষ্টান ধর্মে ধর্মান্তরিত করবার জন্য তিনি অগ্রগণ্য ভূমিকা নিয়েছিলেন তা বলাই বাহুল্য। কেরী সাহেব বা ডাফ সাহেবদের মত পাদ্রীরা এদেশে এসে স্কুল কলেজ খুললেও বাংলার রক্ষণশীল সমাজে খুব যে সমাদৃত হয়েছিলেন তা ভাবার কোনো অবকাশই নেই। বরং বারেবারে পড়তে হত তীব্র বাধার সামনে। কলকাতার বাঙালী সমাজ ব্যঙ্গ করে ছড়া কাটত-

গুরুমশাইয়ের মারধর ঘুচে গেল জারিজুরি
ডাফ কেরী পাদ্রীরা সবাই পড়ায় ধরি ধরি
বিলিতি খানা খাইয়ে তারা ছেলেদের মাথা খেলে
মুরগী ভেড়ার ছেনা গুলো কাঁটা চামচেয় গেলে
টেবিল চেয়ার ছেড়ে আর কেউ যে চায় না খেতে
আসন পেতে বসলে খেতে, বলে, ধুলো পড়ে পাতে।

প্রসঙ্গত বলে রাখা ভালো, হিন্দু কলেজের বাঙালী তরুণ স্কলাররা তখন প্রকাশ্যে হিন্দু পন্ডিতদের নাকের ডগায় গোমাংস পর্যন্ত খেত নির্বিচারে। বিখ্যাত ডিরোজিয়ান রাধানাথ শিকদার বা কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়রা নিজ নিজ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত হলেও হিন্দু রক্ষণশীল সমাজের চোখে ছিলেন একঘরে। যদিও তা নিয়ে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া তাঁদের ধাতে সইত না। আবার সেই সময় হিন্দু পন্ডিত ও ব্রাহ্মণদের তীব্র দাপটে হিন্দু শ্রেণীর সমস্ত অন্ত্যজ ও শূদ্র সমাজ প্রায় একপেশে। হিন্দুত্বেরও একরকম হাড়কঙ্কালসার চেহারা। সতীদাহ থেকে সাগরে শিশু বিসর্জন, সবকটি নারকীয় প্রথাই প্রায় সমান লয়ে সম্পন্ন হয়ে চলেছে রোজ। এই বিকৃতপ্রায় সমাজে একটা সতেজ হাওয়া যে দরকার ছিল তা প্রায় সকলেই বুঝবেন নিশ্চয়। আর সেই হাওয়া এসেওছিল যথা সময়ে। হিন্দু বাঙালী গৌড়মোহন আঢ্য শুরু করলেন সম্পূর্ণ বেসরকারী মালিকানায় পরিচালিত একটি বিদ্যালয়। প্রথমে বেশোহাটায় পড়াশোনা শুরু হয়ে পরে বিদ্যালয় ভবন বানিয়ে দেয় বিখ্যাত মার্টিন অ্যান্ড বার্ণ কোম্পানি। যে বাড়িটি আজও বিদ্যমান। অর্থাৎ এটিই সে যুগের প্রথম প্রাইভেট স্কুল। ওরিয়েন্টাল সেমিনারি। সম্পূর্ণ ধর্মীয় শিক্ষার বাইরে তৈরি হওয়া বাঙালী যুবকদের ইংরাজি শিক্ষার জন্য প্রথম প্রাইভেট ইনিসিয়েটিভ। আবার হিন্দু কলেজে পড়া যুবকদের মতো নাস্তিক তৈরি না হবার প্রতিশ্রুতি। এই ছিল ওরিয়েন্টাল সেমিনারিতে ছাত্র ভর্তির আসল বিজ্ঞাপন। আর তার ওপর কম বেতন তো ছিলই। মাত্র ৩ টাকা। আজকের প্রাইভেট স্কুলগুলোর মত নয়। বরং সেযুগে সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত হিন্দু কলেজের থেকেও কম ফিস ছিল এই স্কুলের। অথচ এক পয়সাও সরকারি সাহায্য কখনো নিতে হয় নি গৌড়মোহন আঢ্যকে। নিজে চারদিকে ঘুরে বেড়াতেন যোগ্য শিক্ষক নিজের স্কুলে আনবার জন্য। এমনকি শ্রীরামপুরে একজন শিক্ষকের খোঁজে এসে সেখান থেকে ফিরে যাবার পথেই দুর্ভাগ্যবশত নৌকা ডুবে প্রাণ হারান তিনি। একসময় দলে দলে ছাত্রের ভিড় সামলাতে না পেরে চিৎপুর ও বেলঘরিয়ায় শাখা খুলতে হয় কতৃপক্ষকে। তো তৎকালীন কলকাতার শিক্ষা মানচিত্রে ওরিয়েন্টাল সেমিনারি এক অন্যতম নাম। শিক্ষক নিয়োগে ছিল অভিনবত্ব। খ্রীষ্টান সাহেব থেকে শুরু করে বাঙালী পন্ডিত, সকলেই বিভিন্ন শ্রেণীতে দায়িত্ব নিয়ে শিক্ষা দিতেন বিভিন্ন বিষয়ে। তো সেই সময় শুধু বেসরকারি উদ্যোগে পরিচালিত এই বিদ্যালয় ছিল কলকাতার মানুষের বিস্ময়। সেই সময়কার ওরিয়েন্টাল সেমিনারির ছাত্ররা তাদের শিক্ষকদের নিয়ে মুখে মুখে ছড়া বেঁধেছিল -

গুড সাহেবের লম্বা ঠাং
তার নীচে ঈশ্বর ব্যাং
ঈশ্বর ব্যাং বড় দানা
তার নীচে গুপে কানা।


🙏 ধন্যবাদ 🙏


(১০% বেনিফিশিয়ারি প্রিয় লাজুক খ্যাঁককে)



1720541518267-removebg-preview.png

Onulipi_07_27_10_21_22.jpg


Yellow Modern Cryptocurrency Instagram Post_20240905_213048_0000.png

new.gif

1720541518267-removebg-preview.png


--লেখক পরিচিতি--

IMG_20240303_181107_644.jpg

কৌশিক চক্রবর্ত্তী। নিবাস পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলায়। পেশায় কারিগরি বিভাগের প্রশিক্ষক। নেশায় অক্ষরকর্মী। কলকাতায় লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলনের সাথে দীর্ঘদিন যুক্ত৷ কলকাতা থেকে প্রকাশিত কবিতার আলো পত্রিকার প্রধান সম্পাদক। দুই বাংলার বিভিন্ন প্রথম সারির পত্রিকা ও দৈনিকে নিয়মিত প্রকাশ হয় কবিতা ও প্রবন্ধ। প্রকাশিত বই সাতটি৷ তার মধ্যে গবেষণামূলক বই 'ফ্রেডরিক্স নগরের অলিতে গলিতে', 'সাহেবি কলকাতা ও তৎকালীন ছড়া' জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। সাহিত্যকর্মের জন্য আছে একাধিক পুরস্কার ও স্বীকৃতি। তার মধ্যে সুরজিত ও কবিতা ক্লাব সেরা কলমকার সম্মান,(২০১৮), কাব্যলোক ঋতুভিত্তিক কবিতায় প্রথম পুরস্কার (বাংলাদেশ), যুগসাগ্নিক সেরা কবি ১৪২৬, স্রোত তরুণ বঙ্গ প্রতিভা সম্মান (২০১৯), স্টোরিমিরর অথর অব দ্যা ইয়ার, ২০২১, কচিপাতা সাহিত্য সম্মান, ২০২১ তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য।



কমিউনিটি : আমার বাংলা ব্লগ

ধন্যবাদ জানাই আমার বাংলা ব্লগের সকল সদস্যবন্ধুদের৷ ভালো থাকুন, ভালো রাখুন।

Drawing_11.png

44902cc6212c4d5b.png

6VvuHGsoU2QBt9MXeXNdDuyd4Bmd63j7zJymDTWgdcJjo1LsUc8S2zjHiaW6UcX2M5SAfbrPcxiCjQzCc6aZJSjUDgt85bSStrwGCUjZMWCDKxNata4NQ2cZTKGxsY.png

FrDSZio5ZCzUamf35asauSgs1tnNGCc8exBrDii52qi3JpjTyYCF9oFoYfs1EV4VTnFw6faxzt5X7uHiwMAHmLS3ef2Jb2JcxHBkpRBd2y...Qa3Q3c7Biv4c8mKsr8DHNVYqqpVomFSv1wmkMCbhs7oCjb14sjkA3vxAfSRk8QPzNZ5UirrZUzvHCXygHCV49RVVZBeTFCeo47WcQXnjLYGy2RNdJQycJW4cN.jpeg

2N61tyyncFaFVtpM8rCsJzDgecVMtkz4jpzBsszXjhqan9xBEnshRDSVua5J9tfneqYmTykad6e45JWJ8nD2xQm2GCLhDHXW9g25SxugWCoAi3D22U3571jpHMFrwvchLVQhxhATMitu.gif


Authors get paid when people like you upvote their post.
If you enjoyed what you read here, create your account today and start earning FREE STEEM!
Sort Order:  

Upvoted! Thank you for supporting witness @jswit.

Daily tasks-

Screenshot_20250308-213548.jpg

Screenshot_20250308-212717.jpg