বেলুড় মঠে দুর্গাপুজো
বেলুড় মঠ। রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের প্রধান কার্যালয় হিসেবে পরিচিত। স্বামী বিবেকানন্দ কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত এই মঠ ও মিশন আজ সারা পৃথিবীতে তাদের শাখা-প্রশাখা ছড়িয়ে রেখেছে। বেলুড় মঠ তাদের মধ্যেই প্রধান কার্যালয়। স্বামী বিবেকানন্দের সময়কাল থেকেই এই বেলুড় মঠে ধুমধাম করে পালিত হয়ে আসছে দুর্গাপূজো। এখানকার প্রধান বিশেষত্ব হল মহাষ্টমীর দিন কুমারী পূজার আয়োজন। স্বামীজী তাঁর সময়কালেই নয়জন কুমারীকে একসঙ্গে বসিয়ে বেলুর মাঠে পূজা করেছিলেন দেবীজ্ঞানে। সেখানে উপস্থিত ছিলেন স্বয়ং সারদা মা। স্বামীজি মূর্তি পূজার থেকেও জীব সেবায় বেশি আগ্রহী ছিলেন। তাই দুর্গাপুজোর মাধ্যমে কুমারীদের বরণ করে নেওয়া তারই মস্তিষ্কপ্রসূত। আজ পর্যন্ত বেলুড় মঠে ধুমধাম করে পালিত হয় মহাষ্টমীর এই কুমারী পুজো। মূলত পাঁচ থেকে সাত বর্ষীয় বালিকাদের দেবীজ্ঞানে কুমারী রূপে পূজো করা হয় এখানে। যদিও কুমারী পূজার আয়োজন আরও বিভিন্ন বনেদি বাড়িগুলি করে থাকে, কিন্তু স্বামী বিবেকানন্দের প্রতিষ্ঠা করা বেলুড় মঠের কুমারী পূজার গুরুত্বই আলাদা।
পঞ্চমীর দিন বিকেলে নিজের বাহনটিকে সঙ্গী করে কন্যা সমেত আমি পৌঁছে গিয়েছিলাম বেলুড় মঠে। দুর্গাপূজার সময় চেষ্টা করি একবার অন্তত বেলুড় মঠ ঘুরে আসতে। সেখানে দেবী পূজার মাহাত্ম্য সমস্ত পূজার থেকেই কিছুটা আলাদা। প্রচলিত বেণীমাধব শীল পঞ্জিকা অনুযায়ী বেশিরভাগ মণ্ডপে পূজা হলেও বেলুড় মঠ বরাবর দূর্গা পূজা করে বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত পঞ্জিকা অনুযায়ী। তাই বেলুড়মঠে পূজার নির্ঘণ্ট সব সময়ই একটু আলাদা হয়। এখানে পূজায় আছে ভক্তি এবং নিষ্ঠার এক তীব্র আকর্ষণ। সমস্ত বাহ্যিক আড়ম্বর ত্যাগ করে এখানে মূলত দৃষ্টি দেওয়া হয় দেবীর পূজার দিকে। মঠের সন্ন্যাসীরা একত্রে বসে মনোনিবেশ করেন দেবী দুর্গার পুজোয়।
স্বামী বিবেকানন্দ ছিলেন আড়ম্বরহীন এবং সমস্ত ধর্মকে সম্মান জানানো এক মহামানব। তাই তাঁর চিন্তাপ্রসূত বেলুড় মঠ যেন সমস্ত ধর্মের এক মিলন ক্ষেত্র। আপনারা হয়তো অনেকেই জানেন যে বেলুড় মঠের মন্দিরটি আসলে হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ এবং খ্রিস্ট ধর্মের এক মহা সমন্বয়ে প্রতিষ্ঠিত। এই মন্দিরের উপরিভাগে যেমন পেয়ে যাবেন রাজস্থানের যোধপুরী ঘরানার বারান্দা, আবার ঠিক তেমনিভাবেই পাবেন মুঘল দরবারের অনির্বচনীয় মুসলিম স্থাপত্যশৈলী। আবার মন্দিরের স্তম্ভ গুলি হিন্দ মন্দিরের আদলে নির্মিত। তাই স্বামীজীর চিন্তা প্রসূত এই বেলুড় মঠ সমস্ত জাতি ধর্ম নির্বিশেষে এক মহামানবের মহামিলন ক্ষেত্র।
আপনাদের একটি ঘটনা বলি। তখন কাশ্মীরে ভ্রমণ করছিলেন স্বামী বিবেকানন্দ। সেখানে এক মুসলিম কন্যাকেও তিনি দেবীজ্ঞানী পুজো করেন। তাই তার কাছে এই ধর্ম নিয়ে গোঁড়ামি ছিল কিছুটা বিলাসিতার মত। আমেরিকার চিকাগোর হিন্দু মহাসভাতেও তিনি ভারতবর্ষের সর্বধর্ম সমন্বয়ের কথাকেই প্রতিষ্ঠা করেন জোর গলায়। মানুষের জীবনে ও মননে উদারতা এবং অন্যকে মান দেওয়ার সুগভীর মনোভাবকেই তিনি সারা জীবন সম্মান জানিয়ে এসেছেন। এমনকি তিনি ভারতীয় যুব সমাজকে বলেছিলেন,
গীতা পাঠ করবার চেয়ে ফুটবল খেলায় মনোনিবেশ করা যুবসমাজের জন্য মঙ্গলের।
বেলুড় মঠ তাঁর সেই আদর্শের উপরেই প্রতিষ্ঠিত। তাই এখানে দেবী দুর্গার পূজায় যতটা না দেবী আরাধনা হয়, তার থেকে বেশি হয় মাতৃ আরাধনা। কুমারী পুজো তারই একটি অঙ্গ। আমি বেলুড় মঠ গেলে সেই শান্তির খোঁজই করি। যেখানে ধর্মের গোঁড়ামি আমাকে আঘাত করে না কোনদিন। বেলুড় মঠের মন্দিরটির দিকে তাকিয়ে দেখি কিভাবে সারা ভারতের সমস্ত ধর্ম একাকার হয়ে যায় একটি স্থাপত্যের মধ্য দিয়ে।
পঞ্চমীর দিন তাই ফাঁকায় ফাঁকায় কিছু মুহূর্ত কাটিয়ে এলাম বেলুড়মঠে। মন্দিরের পাশে বরাবরের মতো আয়োজিত হয়েছে দেবী দুর্গার পূজা মণ্ডপটি। সেখানে নেই কোন আড়ম্বর, নেই কোন বিলাসিতা। একেবারে সাধারণভাবে সাবেকি একচালার মাতৃ মূর্তিতে পূজিতা হচ্ছেন দেবী দুর্গা। দেবীর সামনে দাঁড়িয়ে তাই বিশ্ব শান্তির জন্য হাতজড়ো করে এলাম আরেকবার। চারপাশে যেন অসীম নিস্তব্ধতা। সমস্ত মানুষের কলতান তখন যেন ভেসে চলেছে কোন মহা গোলকের মধ্যে। আমি মিশে গেছি স্বামীজীর সেই মানবতার ভাবধারায়।
বেলুড়মঠ হাওড়া জেলার বেলুড়ে একেবারে গঙ্গার পশ্চিম ধারে প্রতিষ্ঠিত। সেখানে এক বিশাল অঞ্চল জুড়ে গড়ে উঠেছে ভারতবর্ষের এই মহান তীর্থক্ষেত্রটি। আমার বাড়ি নিকটে হওয়ায় আমার কাছে তা আর ঘোরবার জায়গা হিসেবে নেই। সেটা আমার নিত্য গন্তব্যের মধ্যে পড়ে। পুজোর সময় বেলুড় মঠে দুর্গাপুজো কিছুক্ষণ হলেও অংশগ্রহণ করা আমার কাছে এক অসীম পূর্ণতার সমান। তাই সমস্ত কাজের মধ্যেও সময় বাঁচিয়ে চেষ্টা করি একটু সময় হলেও সেখানে ঘুরে আসতে। বাহনটি থাকায় যাতায়াতের অসুবিধা হয় না। তাই এবারে একেবারে পুজোর শুরুতেই বেলুড় মঠ ও সেখানকার দেবীদর্শন সেরে পূজা শুরু করলাম এই বছরের মত। সবসময় চাই দেবী দুর্গা অসুর নিধনের মত বর্তমানের হাজার অসুরের নিধন ঘটান। সারা পৃথিবীতে নেমে আসুক শান্তি সুখ ও সমৃদ্ধি। জাতি ধর্ম নির্বিশেষে প্রতিটি মানুষ ভালো থাকুন। সবার মঙ্গল হোক।
🙏 ধন্যবাদ 🙏
(৫% বেনিফিশিয়ারি এবিবি স্কুলকে এবং ১০% বেনিফিশিয়ারি প্রিয় লাজুক খ্যাঁককে)
--লেখক পরিচিতি--
কৌশিক চক্রবর্ত্তী। নিবাস পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলায়। পেশায় কারিগরি বিভাগের প্রশিক্ষক। নেশায় অক্ষরকর্মী। কলকাতায় লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলনের সাথে দীর্ঘদিন যুক্ত৷ কলকাতা থেকে প্রকাশিত কবিতার আলো পত্রিকার প্রধান সম্পাদক। দুই বাংলার বিভিন্ন প্রথম সারির পত্রিকা ও দৈনিকে নিয়মিত প্রকাশ হয় কবিতা ও প্রবন্ধ। প্রকাশিত বই সাতটি৷ তার মধ্যে গবেষণামূলক বই 'ফ্রেডরিক্স নগরের অলিতে গলিতে', 'সাহেবি কলকাতা ও তৎকালীন ছড়া' জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। সাহিত্যকর্মের জন্য আছে একাধিক পুরস্কার ও স্বীকৃতি। তার মধ্যে সুরজিত ও কবিতা ক্লাব সেরা কলমকার সম্মান,(২০১৮), কাব্যলোক ঋতুভিত্তিক কবিতায় প্রথম পুরস্কার (বাংলাদেশ), যুগসাগ্নিক সেরা কবি ১৪২৬, স্রোত তরুণ বঙ্গ প্রতিভা সম্মান (২০১৯), স্টোরিমিরর অথর অব দ্যা ইয়ার, ২০২১, কচিপাতা সাহিত্য সম্মান, ২০২১ তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য।
কমিউনিটি : আমার বাংলা ব্লগ
ধন্যবাদ জানাই আমার বাংলা ব্লগের সকল সদস্যবন্ধুদের৷ ভালো থাকুন, ভালো রাখুন।
Upvoted! Thank you for supporting witness @jswit.
Downvoting a post can decrease pending rewards and make it less visible. Common reasons:
Submit