আমার একটি জনপ্রিয় বই সাহেবি কলকাতা ও তৎকালীন ছড়ার মুখবন্ধ
মুখবন্ধ
ঠিক করলাম কলকাতা শহর নিয়ে লিখব। প্রাণের শহর, প্রেমের শহর আর আনন্দের শহর৷ কিন্তু সবটাই যেন ছায়াছবি। ফ্ল্যাশব্যাকে পিছিয়ে যেতেই কত বৈচিত্র্য। কখনও শোভাবাজারে দরবার মহলে কবিগানের লড়াই, আবার কখনও বাগবাজারে রূপচাঁদ পক্ষীর সুর। কলকাতা মানেই নিত্যনতুন ছড়া, গান, তর্জা, কবির দল, টপ্পা, দরবারি আর বাবুয়ানা। আজকের কলকাতা শহর বড়ই কেতাদুরস্ত। নিয়মের বদলে যাওয়া রঙে সেও যেন ছুটছে। কিন্তু একটা আস্ত শহর তো আর একদিনে গড়ে ওঠে না, স্বভাবতই কলকাতাও তা হয়নি৷ তিল তিল করে গড়ে ওঠা এই শহরের বুকেও তাই প্রাচীনত্বের পাথর। অবশ্যই দিল্লী, হায়দরাবাদ না বারাণসির মত হাজার বছরের শহর না হয়েও কলকাতার আনাচেকানাচে ঐতিহ্যের মধুর গন্ধ। আজও অলি-গলিতে ভাঙাচোরা গাড়ি-বারান্দার নীচে লুকিয়ে থাকা কত বাহারি গল্প।
কলকাতা ছড়ার শহর। আর ছড়া থেকেই তৈরি হত গান। কখনও সেই গানকে বুকে ধরেই ভোলা ময়রা, রাম বসু, অ্যান্টনি সাহেব বা পক্ষীরাজ রূপচাঁদ জয় করেছেন সর্বত্র। একসময় এই মাটিতেই ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত, দীনবন্ধু মিত্রের মত কবি সাহিত্যিকরা একের পর এক ছড়া ও কবিতায় আজও অমর করে রেখেছেন সেকালের কলকাতাকে। আবার মানুষের জন্য কাজ করতে গিয়েও ব্যঙ্গবিদ্রূপ ছড়ায় ছড়ায় বারবার বিদ্ধ হতে হয়েছে রাজা রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মত দিগ্বিজয়ী মানুষকেও। এককথায় ছড়ায় ছড়ায় বাঁধা আমাদের এই তিলোত্তমা। শুধু সময়ে সময়ে ছড়াগুলোকে ধরতে পারলেই যেন চেনা হয়ে যায় একটা শহর গড়ে ওঠার কাহিনী। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে হারাতে বসেছে সেইসব ছড়া আর গান।
কথাতেই বলে সংস্কৃতিপ্রিয় বাঙালী, আর সংস্কৃতির পীঠস্থান কলকাতা। যার ছত্রে ছত্রে কবিতা, ছড়া, গান, সাহিত্য। কলকাতার ছড়া নিয়ে কাজ শুরু করবার অনুপ্রেরণা ঠিক এইখান থেকেই। একটা শহরকে ভালোবাসতে গেলে তার উৎস সন্ধানটা ভীষণ জরুরি। আর কলকাতার উৎস যেন মিশে আছে সেইসব ছড়াতেই। কাজটা শুরু করা সত্যিই বড় কঠিন মনে হয়েছিল একটা সময়ে। কিন্তু হাতে এলো হরিহর শেঠের সংকলিত কিছু প্রাচীন কলকাতার ছড়া, যা বাছতে বাছতে আর পটভূমিকা খুঁজতে খুঁজতে কখন হারিয়ে গেলাম আড়াইশো বছর আগের রাস্তায়৷ যাত্রাপথ শুরু সেই সময় থেকেই। এরপর ধীরে ধীরে পথ হাঁটা। যত এগিয়েছি, দীর্ঘ হয়েছে পথ। উঠে এসেছে শহরের নতুন নতুন গল্প। প্রাসঙ্গিক ভাবেই ঘাঁটতে হয়েছে অনেক পুরনো নথি, বই। এই কাজের জন্য যে সকল বইয়ের নাম না করলেই নয়, তাদের মধ্যে প্রাণকৃষ্ণ দত্তের কলিকাতার ইতিবৃত্ত, রাধারমণ মিত্রের কলিকাতা দর্পণ, পূর্ণেন্দু পত্রীর ছড়ায় মোড়া কলকাতা উল্লেখযোগ্য।
এই শহরের ইতিহাস প্রথম লেখা হয় সাহেবদের হাতেই। তারা তাদের মত করেই লিপিবদ্ধ করে গেছেন এই শহরের ইতিহাসকে। যেমন ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গের হর্তাকর্তা জেফানিয়া হলওয়েল সাহেব নবাব সিরাজের কলকাতা আক্রমণ ও ফোর্ট উইলিয়াম পতনের ইতিহাসকে নিজের মত করে ব্যাখ্যা করেছেন। তৈরি করেছেন অন্ধকূপ হত্যার মত আষাঢ়ে কাহিনী। সিরাজকে তলানিতে নামিয়ে বেশি করে তুলে এনেছেন ইংরেজদের ফলতায় আশ্রয়ের কথাকেই। এভাবেই বারবার বিকৃত হয়েছে কলকাতার ইতিহাস। কিন্তু বাঙালী হিসাবে প্রথম কলকাতার ইতিহাসকে পর্ব বিভাগ করে মানুষের সামনে তুলে আনেন প্রাণকৃষ্ণ দত্ত, রাধারমণ মিত্র প্রমূখ লেখকেরা। আকরগ্রন্থ হিসাবে নামোল্লেখ করতেই হয় কালীপ্রসন্ন সিংহের 'হুতুম পেঁচার নক্সা'র। এরপর থেকে বিভিন্ন বাঙালী লেখকদের কলমে লেখা হয়েছে এই শহরে বিলিতি বনিকদের সাম্রাজ্যের ইতিহাস।
কলকাতা নিজেই বড় অবাক করবার মত একটি বিষয়। অপেক্ষায় নবীন একটি শহর হলেও অনেক প্রাচীন শহরের মতোই এর ঐতিহ্যের ইতিহাস। বিশেষ করে এর মধ্যে মিশে আছে একটা জঙ্গলে ঘেরা অজ পাড়াগাঁকে সাহেবদের পছন্দ মত করে সাজিয়ে তোলার গল্প। জঙ্গল কেটে, খাল বুজিয়ে মহানগরী তৈরির ইতিহাস। যেন ভারতের মাটিতেই আস্ত একটা ইউরোপিয়ান নগরী। সাহেবদের নয়নের মণি। আর তাই নবাব আমির ওমরারা এই শহরকে কেড়ে নেবার চেষ্টা করলেই বারবার রে রে করে তেড়ে এসেছেন তাঁরা। কলকাতার অধিকার ছেড়ে দিতে বুকে ব্যথা অনুভব করেছেন গোরা সাহেবরা। আজ আমরা বাঙালীর কলকাতা বলে বিশ্বব্যাপী দাবী করলেও হয়ত কোথাও গিয়ে তাদের বুকে বাজে সেই বিজয়োল্লাস।
সে একটা সময়ের কথা। যেকোনো ঘটনায় মুখে মুখে ছড়া কাটত শহরের লোক। অভাব ছিল না চারণ কবি, স্বভাব কবিদেরও। কথায় কথায় ছড়া বেঁধে তৈরি হত গান। আর ঢাক ঢোল পিটিয়ে, ভেঁপু বাজিয়ে, কোঁচা বেঁধে কোমর দুলিয়ে সেইসব ছড়াই গাওয়া হত রাস্তায় রাস্তায়। গলা মেলাত শহরবাসীও। আবার সেই গানই কখনো গাওয়া হত মেলা পার্বণ অথবা জমিদারের দরবারেও। প্রথম থেকেই আমার উদ্দেশ্য ছিল সেইসব পুরনো ছড়ার পটভূমি খোঁজার। কাজে কতটা সফল হতে পেরেছি তা তো পাঠকদের বিচার্য, কিন্তু যত এগিয়েছি, ততই কাজটা বেশি সুখপ্রদ হয়ে উঠেছে। এক একটা স্তর ভেদ করে যেন বেরিয়ে এসেছে নতুন নতুন তথ্য। ছড়াগুলোর প্রতিটি পংক্তিতেই যেন জীবন্ত হয়ে রয়েছে ইতিহাস। শুধু চাক ভেঙে মধু নেবার মত করে খুঁজে নেওয়া। আজও আমরা, 'ইকির মিকির চাম চিকির' ছড়ায় খেলা করতে দেখি শিশুদের। কিন্তু এই ছড়ার পিছনে লুকিয়ে থাকা ঐতিহাসিক গল্পটা নিয়ে আমরা নাড়াচাড়া করি ক'জন? বাংলার রাজা প্রতাপাদিত্যকে দমনের উদ্দেশ্যে মোঘল সেনাপতি মানসিংহ বাংলায় এসেছেন। বাংলায় ঢুকেই তিনি গ্রহণ করেছেন নদীয়ার রাজা ভবানন্দ মজুমদারের আতিথ্য। লোক লস্কর, সৈন্য সামন্ত সমেত রাজা মানসিংহ ভবানন্দের রাজপুরীতেই উঠলেন। কিন্তু বাংলা আক্রমণ করে বাংলারই রাজার ক্ষতি করতে আসা ভিনদেশী মানসিংহকে বাংলার মানুষ ভালো মনে নেবেন না সেটাই স্বাভাবিক। তাই এই বিপুল সংখ্যক সেনাবাহিনীর খাবার তৈরির দায়িত্বে যারা ছিলেন, তাদের মুখের এই কথ্যছড়া এত বছর পরে আজও সমান জনপ্রিয়। 'চামের কাটা মজুমদার', 'ধেয়ে এলো দামোদর' বা 'ভাতে পড়লো মাছি' জাতীয় পংক্তিগুলোই পরিস্কার এই ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষ্য বহন করে আজও।
যেমন 'আইকম বাইকম তাড়াতাড়ি / যদু মাস্টার শ্বশুরবাড়ি'৷ শিশুদের এই ছড়াতেও সমসাময়িক প্রেক্ষাপট স্পষ্ট। প্রথমেই ইংরাজি শব্দ 'আই কাম'। অর্থাৎ ইংরেজরা এদেশে এসে নতুন ইংরেজি শেখানোর পর এদেশের মানুষেরা বাংলা আর ইংরাজির এক অদ্ভুত মিশেল তৈরি করতেন। আর সেই নব্য বাংরাজি ভাষাতেই হত ছড়া বা গান নির্মাণ৷ যেমন রূপচাঁদ পক্ষীর বিভিন্ন পদেও আমরা এই ধারা লক্ষ্য করেছি। ছড়া যুগে যুগে এভাবেই যেন জীবন্ত ধরে রেখেছে সমসাময়িক সময়কালকে।
কলকাতা বিষয়ক বিভিন্ন ছড়াকে তাদের প্রেক্ষাপট সমেত এই দু'মলাটে ভরে রাখবার চেষ্টা করলাম। যদি এই কাজ পাঠকের ভালো লাগে ও কলকাতার ইতিহাস জানবার পথে সঠিক দিশা নির্দেশ করে, তবেই সমস্ত পরিশ্রম সার্থক বলে বিবেচনা করব। সেই উদ্দেশ্যেই আমার কাজটুকু আমি প্রিয় পাঠকদের হাতে তুলে দিলাম। বাকিটা সময় আর কলকাতা শহরের বুকে বেঁচে থাকা ইট কাঠ কড়িবরগায় লেখা থাক।
কৌশিক চক্রবর্ত্তী
কোন্নগর, হুগলি
🙏 ধন্যবাদ 🙏
(১০% বেনিফিশিয়ারি প্রিয় লাজুক খ্যাঁককে)
--লেখক পরিচিতি--
কৌশিক চক্রবর্ত্তী। নিবাস পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলায়। পেশায় কারিগরি বিভাগের প্রশিক্ষক। নেশায় অক্ষরকর্মী। কলকাতায় লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলনের সাথে দীর্ঘদিন যুক্ত৷ কলকাতা থেকে প্রকাশিত কবিতার আলো পত্রিকার প্রধান সম্পাদক। দুই বাংলার বিভিন্ন প্রথম সারির পত্রিকা ও দৈনিকে নিয়মিত প্রকাশ হয় কবিতা ও প্রবন্ধ। প্রকাশিত বই সাতটি৷ তার মধ্যে গবেষণামূলক বই 'ফ্রেডরিক্স নগরের অলিতে গলিতে', 'সাহেবি কলকাতা ও তৎকালীন ছড়া' জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। সাহিত্যকর্মের জন্য আছে একাধিক পুরস্কার ও স্বীকৃতি। তার মধ্যে সুরজিত ও কবিতা ক্লাব সেরা কলমকার সম্মান,(২০১৮), কাব্যলোক ঋতুভিত্তিক কবিতায় প্রথম পুরস্কার (বাংলাদেশ), যুগসাগ্নিক সেরা কবি ১৪২৬, স্রোত তরুণ বঙ্গ প্রতিভা সম্মান (২০১৯), স্টোরিমিরর অথর অব দ্যা ইয়ার, ২০২১, কচিপাতা সাহিত্য সম্মান, ২০২১ তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য।
কমিউনিটি : আমার বাংলা ব্লগ
ধন্যবাদ জানাই আমার বাংলা ব্লগের সকল সদস্যবন্ধুদের৷ ভালো থাকুন, ভালো রাখুন।
Upvoted! Thank you for supporting witness @jswit.
Downvoting a post can decrease pending rewards and make it less visible. Common reasons:
Submit
https://x.com/KausikChak1234/status/1896626355602858009?t=aN0BdHHMCzitFDIp53aJXg&s=19
Downvoting a post can decrease pending rewards and make it less visible. Common reasons:
Submit
Daily tasks-
Downvoting a post can decrease pending rewards and make it less visible. Common reasons:
Submit
কলকাতার ইতিহাস ও সংস্কৃতির সঙ্গে ছড়ার সম্পর্ক যে কতটা গভীর, তা চমৎকারভাবে তুলে ধরা হয়েছে। ছড়ার প্রতিটি পংক্তির ভেতর লুকিয়ে থাকা ইতিহাস, মানুষের আবেগ, সময়ের স্বাক্ষর এসবের অনুসন্ধান সত্যিই প্রশংসনীয়। অতীতকে নতুন করে ছুঁয়ে দেখার এই প্রয়াস নিঃসন্দেহে আমাদের সমৃদ্ধ করছে। ধন্যবাদ দাদা বিষয়টি আমাদের সাথে শেয়ার করার জন্য।
Downvoting a post can decrease pending rewards and make it less visible. Common reasons:
Submit
অনেক ধন্যবাদ আপনাকে আমার সম্পূর্ণ পোস্টটি পড়ে এত সুন্দর একটি সুচিন্তিত মতামত প্রকাশ করবার জন্য।
Downvoting a post can decrease pending rewards and make it less visible. Common reasons:
Submit