।।স্বাগতম্। আসুন এবার একটু বিরিয়ানির স্বাদ নিই।।
কলকাতা হল আনন্দের শহর। সারা দেশের লোকে বলে সিটি অফ জয়। ভারতবর্ষে অনেকগুলো মেট্রো শহর৷ অনেক মানুষ। তাদের বহু ভাষা, বহু সংস্কৃতি। কিন্তু সবের মাঝেও কলকাতার মাহাত্ম্যই আলাদা। আমার ঘরের শহর হলেও আমি মাঝেমাঝে বাইক নিয়ে বেরিয়ে পড়ি শহরটাকে বিভিন্ন রঙে ছুঁতে। এই কলকাতার এক মনকাড়া খাবার হল বিরিয়ানি। যদিও ভারতে হায়দ্রাবাদ, লক্ষ্ণৌ, দিল্লীর বিরিয়ানি প্রথম থেকেই দেশ বিদেশের মাটিতে জায়গা করে নিয়েছিল। কিন্তু কিজানি কোন অজানা রহস্যে কয়েক দশক ধরে সারা দেশে কলকাতা বিরিয়ানির আলাদাই কদর। সে কদর বলে বোঝাবার নয়৷ তামাম ভারতবর্ষ থেকে লোকজন কলকাতায় এসে বিরিয়ানি টেস্ট করে তবেই বাংলার মাটি ছাড়েন। আমিও কদিন ধরে কলকাতা তথা পশ্চিমবঙ্গের স্পেশাল বিরিয়ানি নিয়ে কিঞ্চিৎ তদন্ত করছিলাম আরকি। আসলে খাদ্যরসিক বাঙালি হিসাবে বিরিয়ানি যথারীতিই ভীষণ প্রিয়। মানে সবকিছু প্রিয় জিনিসের সাথে বিরিয়ানিকে তুলনা করতে বসে পড়ার মতো। তাই এই মোঘল পদটি নিয়ে আমার আলাদা একটা দুর্বলতা আছে বৈকি৷ সারা ভারতে বিভিন্ন শহরে ঘুরে বেড়ানোর সুবাদে বিরিয়ানির স্বাদও নিয়েছি সাধ্যমতো। যেমন নিজামের শহর হায়দ্রাবাদই ধরা যাক৷ কয়েক বছর আগে তখন গেছি এই শহরে। ঘুরে বেড়াচ্ছি বিখ্যাত চারমিনার থেকে সালারজং মিউজিয়াম। নিজামের প্যালেস আজও অক্ষত। মনে রাখবার মতো তার জাঁকজমক। কিন্তু ফিরে আসার দিন মনে হল সব হল, কিন্তু হায়দ্রাবাদী বিরিয়ানির? অনেক গুণগান শুনেছি তার। সকাল সকাল ছুটলাম রেস্তোরাঁয়। খেলামও। স্পাইসি মশলাদার টেস্ট। সাথে ছোট ছোট কুচো মাংস। জমে গেল সে বেলার খাওয়াদাওয়া।
কিন্তু কলকাতা বিরিয়ানিতে কী বিশেষত্ব আছে যা তামাম ভূভারতে আর নেই। পড়াশোনা করতে গিয়ে উঠে এলো চমকপ্রদ কিছু তথ্য। কলকাতার বিরিয়ানিতে প্রধান আকর্ষণ হল আলু। আর এই আলু দেওয়া বিরিয়ানিরই লাভার সারা বিশ্বজুড়ে। লাল কাপড়ে মোড়া বড় হাঁড়িতে হলুদ সোনালী লম্বা চাল যেন দূর থেকে ডেকে নেয় বিরিয়ানিপ্রেমীদের। আর তার সুবাস ছড়িয়ে থাকে আনাচেকানাচে। কলকাতার এই আলু বিরিয়ানির কথা উঠলে যাঁর কথা প্রথমেই উঠে আসে তিনি হলেন অযোধ্যায় আওয়াধ সুবার নবাব ওয়াজেদ আলি শা। ১৮৫৬ সালে ইংরেজ রেসিডেন্ট সাহেব দ্বারা তিনি বিতাড়িত হন নিজের নগরী আওয়াধ থেকে। আর তারপর দু বছর ইংরেজ কারাগারে অবরুদ্ধ থাকার পর তাকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় এই কলকাতায়। যদিও এ সিদ্ধান্ত তাঁর নিজের ইচ্ছেতেই। তিনিই থাকবার জন্য বেছে নিয়েছিলেন শহর কলকাতাকে। বাকি জীবন নির্বাসনে থাকবার মত কলকাতায় গঙ্গার ধারে বাস করলেও তিনি এখানেই গড়ে তুলেছিলেন ছোটখাটো রাজত্ব। তাঁর সাথে কলকাতায় এসেছিল তাঁর ভৃত্য, খানসামা, বাবুর্চি, নর্তক সবাই। কলকাতার বুকে সে যেন এক আস্ত নবাবী নগর। থাকবার জন্য তিনি বেছে নেন মেটিয়াব্রুজ। যা আজকের গার্ডেনরিচ। গঙ্গার ধারে নিরিবিলি বাসস্থান। সেখানেই রাজত্ব কায়েম করে নগরী পত্তন করেন নবাব। আর শুরু হয় তাঁর নতুন জীবন। প্রায় ত্রিশ বছর কলকাতাবাসী ছিলেন তিনি। এবার আসি আমাদের বিরিয়ানি প্রসঙ্গে। কলকাতায় থাকাকালীনই প্রথম আজকের এই আলু বিরিয়ানির প্রবর্তন করেন নবাব ওয়াজেদ আলি। কেন মাংস ছেড়ে বিরিয়ানিতে আলুর আমদানি? আসলে তখন আজকের মতো সহজলভ্য ছিল না আলু। তাই মাংসের পরেই দামী ও পছন্দের সব্জী হিসাবে আলুর কদর ছিল আকাশছোঁয়া। নিজের নগরী থেকে নবাবী হারিয়ে নবাবও তখন লড়াই করছেন অর্থসংকটে। তার ওপরে এতো মানুষ নির্ভর করে থাকে শুধু তাঁর ওপর। তাই মাংসের মত দামী খাবারের বদলে আলু দিয়ে বিরিয়ানি তৈরি করলে সবার পেট ভরা খাওয়াও জোটে, আবার সাশ্রয় হয় রাজকোষেও। সবকিছু দিক বিচার করলে এছাড়া উপায় নেই আর। তাই আলু দেওয়া বিরিয়ানি তখন থেকেই স্থান পেতে শুরু করে কলকাতায়।
যদিও কলকাতায় বিরিয়ানি বিখ্যাত হয়েছে খুব বেশিদিন নয়। বছর ত্রিশ আগেও বিরিয়ানি ছিল বড়লোকের বিলাসিতার খাদ্যপদ। কিন্তু আজ? কথায় কথায় বিরিয়ানি। আর দামও তার নাগালের মধ্যে। তাই ছোটখাটো পার্টি থেকে বন্ধুবান্ধবদের খাওয়ানো, বিরিয়ানির জুড়ি মেলা ভার। সামান্য টাকাতেই সবার উদরতৃপ্তি, মনে স্বর্গীয় আনন্দও।
কলকাতা বিরিয়ানি তুলনায় কম মশলাদার। তাতে জাফরান, গোলাপ জল থেকে শুরু করে ঘি মিশ্রিত হলেও তা কখনোই মাত্রাতিরিক্ত নয়। আর তাতে চিকেন, মাটন, আলু আর ক্ষেত্রবিশেষে ডিম। আর সেই পদেরই জগৎ জোড়া খ্যাতি। বিরিয়ানির হলুদ রং যেন মনভোলানো। চোখে দেখলে জিভকে আটকে রাখা বেশ কঠিন। জাফরান মিশ্রিত হলুদ চালের আভায় আটকে যায় চোখ। আর জল আসে জিভে। বিরিয়ানি নামটা নিতান্তই মোঘল যুগের। সহজে অনেক মানুষের খালিপেট নিবারণের উপায় হিসাবে সেই প্রাচীন যুগ থেকেই বিরিয়ানির রমরমা এদেশে। বিরিয়ানি শব্দের আগমন উর্দু শব্দ বিরিয়ান থেকে। যার উৎস ফার্সী থেকে। তারপর সেই নাম আজ আপন হয়ে ঢুকে গেছে বাঙালির হেঁশেলে। বিরিয়ানির ইতিহাসের সাথে জড়িয়ে আছে মোঘল বেগম মুমতাজমহলের নাম। শুধু তাজমহলে নয়, সারা ভারতে বিরিয়ানির সাথে জড়িয়ে আছে তাঁর স্মৃতি। শোনা যায় তাঁর নির্দেশেই যুদ্ধক্লান্ত মোঘল সৈন্যদলকে বিরিয়ানি রেঁধে দেয় বাবুর্চি। এ হল এমন একটি পদ যা মাংস ও চালের সংমিশ্রণে তৈরি হয় এবং সহজেই সৈন্যদের ভগ্নস্বাস্থ্য পুনরুদ্ধার করা যায়। মোঘল দরবারে তাই এই জনপ্রিয় পদের ছিল তুমুল চাহিদা। আর সেখান থেকেই তা ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে৷ শুধু এক এক জায়গায় এক এক রকমফের। কিন্তু রন্ধনপ্রণালী মোটামুটি একই।
আজ দোকানে দোকানে সমস্ত বিরিয়ানির হাঁড়ি মোড়া থাকে লাল কাপড়ে। এর পিছনেই দীর্ঘ ইতিহাস। আজকের দিনে এই পদ এতো সহজলভ্য হলেও এক সময় এ ছিল আভিজাত্যের প্রতীক। শোনা যায়, সম্রাট হুমায়ুন যখন দিল্লী থেকে বিতাড়িত হয়ে আশ্রয় নেন সুদূর ইরানে, তখন পারস্য সম্রাট তাঁকে অভ্যর্থনা জানান লাল গালিচায় ও রূপোর থালায় খাবার পরিবেশন করেন লাল কাপড়ে মুড়ে। সেই থেকেই মোঘল দরবারে লাল কাপড়ে মুড়ে খাবার পরিবেশনের প্রথা। যা আজও পাড়ায় পাড়ায় অলিতে গলিতে দেখা যায় হাঁড়ি মুড়ে রাখতে। আর যা দেখে ছুটে যায় আট থেকে আশির দল। বিরিয়ানির স্বাদে গন্ধে মজে থাকে আপামর বাঙালি তথা বাংলার বাইরের খাদ্যপ্রেমী মানুষও।
কলকাতা বিরিয়ানিকে আরও বিখ্যাত করেছে উত্তর ২৪ পরগনা জেলার শহর ব্যারাকপুর। এই শহর তাই বিরিয়ানির শহর বলেই খ্যাত। এই শহর সামরিক শহর। জুড়ে আছে সিপাহী বিদ্রোহের নায়ক মঙ্গল পাণ্ডের স্মৃতি। এই শহর থেকেই ইংরেজ বিরোধিতার প্রথম আগুন সিপাহী বিদ্রোহের নাম নিয়ে ছড়িয়ে পড়ে দেশের প্রতি কোণে। আজও শহীদ মঙ্গল পাণ্ডের ফাঁসির স্মৃতি বুকে ধরে নিজের মতো আছে ব্যারাকপুর। আর আজ বিদ্রোহের সাথে সাথে তার জগৎ জোড়া খ্যাতি বিরিয়ানির জন্য। ব্যারাকপুরের বিখ্যাত দাদা বৌদির হোটেল প্রতিদিন প্রায় ৫ হাজার প্লেট বিরিয়ানি বিক্রি করে। তবু স্বাদে গন্ধে প্রতিটি প্লেটের স্বাদ মুখে লেগে থাকবার মতো। এছাড়াও এই শহরে আছে বিখ্যাত ডি বাপী বিরিয়ানি। স্বপ্ন দামে তারাও দিনের পর দিন বাঙালিকে বিরিয়ানি খাইয়ে চলেছে। এছাড়াও কলকাতায় অবস্থিত আর্সালান, আমিনিয়া, করিম'স, সিরাজের বিরিয়ানিও জিভে জল আনা। কিন্তু এসব বড় বড় নাম বাদ দিলেও আজ পাড়ায় পাড়ায় বিরিয়ানির পসরা সাজিয়ে বসে স্থানীয় ব্যবসায়ীরা। তার স্বাদও অতুলনীয়। সবাই যেন সবার প্রতিযোগী। কিন্তু আজও সবের মধ্যেই যেন মিশে আছেন নবাব ওয়াজেদ আলি শা আর তার মেটিয়াব্রুজের দিনগুলো। কলকাতা তাই স্পেশাল তার বিরিয়ানির স্বাদে। আর সেই বিরিয়ানির স্বাদেই মাতোয়ারা সারা দেশ।
ভালো থাকুন সকলে। আমার বিরিয়ানির বারোমাস্যা আপনাদের ভালো লাগলে সবার নিজের অঞ্চলের এক প্লেট করে বিরিয়ানি পাঠিয়ে দেবেন এই আশা রইল। 🤣🤣
--কৌশিক চক্রবর্ত্তী, হুগলি, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত।
আসলে তো আমি দেখছি আজকের পোস্টে আপনি কলকাতার সব বিরিয়ানির দোকানগুলো এক জায়গায় নিয়ে এসেছেন। যদিও এসব বিরিয়ানি দোকান থেকে আমার বিরিয়ানি খাওয়া আছে। আসলে প্রতিটা বিরিয়ানির স্বাদ একেক ধরনের হলেও খেতে কিন্তু সবগুলোই ভালো। হয়তোবা আপনিও আমার মত একজন বিরিয়ানি লাভার। ধন্যবাদ আপনাকে এত সুন্দর একটা পোস্ট আজকে আমাদের মাঝে শেয়ার করার জন্য।
Downvoting a post can decrease pending rewards and make it less visible. Common reasons:
Submit
আমি সত্যিই একজন বিরিয়ানি লাভার। তাই পুরো বিষয়টা এক জায়গায় আনার চেষ্টা করলাম। আর কলকাতার বিরিয়ানি স্বাদে গন্ধে অনন্য তা কে না জানে। এই পোস্টটি আপনার ভালো লাগায় আমি আপ্লুত। এরপর আরো বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আমার বাংলা ব্লগে আলোকপাত করার চেষ্টা করব। সাথে থাকবেন। আর মাঝেমাঝে বিরিয়ানি খাবেন। ☺️☺️
Downvoting a post can decrease pending rewards and make it less visible. Common reasons:
Submit