বিসর্জন

in hive-129948 •  3 years ago 

শরতের ভোর।চারিদিকে শিউলি ফুলের গন্ধ। শিশির ভেজা ঘাস। কিছুক্ষণ আগেই মহালয়ার চন্ডীপাঠ শেষ হলো।এখনো যেন তার সুর কানে বাজছে।স্নান সেরে সাঝি হাতে শিউলি তলার দিকে হেঁটে চলেছে দূর্গা।

এই সময়ে মন্দিরে মা দূর্গার আগমনে সাথে সাথে রায় চৌধুরীর বাড়ির একমাত্র মেয়ে দূর্গাও সেজে ওঠে নতুন রূপে নতুন সাজে।কারণ জন্মটা তার এই ক্ষণে।এমন কোন এক শারদীয়ায় দুর্গেশ্বর রায় চৌধুরী আর স্বরুপিনী দেবীর কোল জুড়ে দূর্গার আবির্ভাব।

বেশ শান্ত স্বভাব, গলায় মধুর সুর,এক কথায় রূপে গুণে অতুলনীয়। রায় চৌধুরী বাবুও মেয়েকে গড়ে তুলতে এতোটুকু কার্পন্য করেননি।শিক্ষায় দীক্ষায় মনের মত করেই বড় করে তুলেছে।

---এখানে দাঁড়িয়ে?
---হ্যাঁ,ফুল তুলতে এসেছিলাম। দেখো,নীলকন্ঠ দাদা,কত ফুল তুলেছি আজ।ঠাকুর ঘর সাজিয়েও কিছু ফুল এমনিই সাজিতে পড়ে রবে।
---আজ সব ফুল মায়ের চরণেই দিও।
---কেন বল তো?
--- নাহ্!এমনিই বললাম। চলি,তুমি সন্ধ্যায় মন্দিরের দিকে আসবে?
---দেখি,বাবা অনুমতি দিলে, আসবো।
---তোমার বাবার কথাই তো শেষ কথা।চলি।

দূর্গেশ্বর বাবু কপিলমুনি গ্রামের মাথা বলা যায়।বহু বছর আগে থেকে রায়চৌধুরী বাড়িতে দূর্গা পূজা হয়ে থাকে।এবারের আয়োজন আরেকটু বেশি। কারণটা দু-এক জন ছাড়া আর কারো জানা নেই।তার মধ্যে নীলকন্ঠ এর বাবা দিগ্বিজয় বাবু একজন।দুজন ছোটবেলার বন্ধু। দিগ্বিজয় বাবু বেশ কয়েক বারের চেয়ারম্যান। সম্মান আর মান মর্যাদায় বেশ সুনাম।

---ষষ্ঠী পূজার এখনো পাঁচ দিন বাকী। তবুও সন্ধ্যায় মন্দিরে ঢাকের আওয়াজ,প্রদীপ জ্বালানো,গান বাজনা।এবার আর নাটক মঞ্চ হবে না।কেন জানি না।পিছনে কে যেন এসে দাঁড়াল।
---একটা অনুরোধ করি,এবার পূজায় নীল শাড়ি পরো।
---আচ্ছা। এটুকু বলতে মন্দিরে ডেকেছো?
---না,বাবার অনুমতি ছাড়া আসতে পারো কিনা,দেখতে।
---আসিনি তো।
---কাকুকে তো দেখলাম বাবার সঙ্গে বসে আমাদের বাড়িতে চা খাচ্ছেন।
---সে আমি দুপুর বেলাতে জানিয়েছিলাম।
---আসতে দিলো?
---হ্যাঁ
---আমার কথা বলেছিলে?
---হুম,বললাম,নীলকন্ঠ দাদা আমাকে মন্দিরে দেখা করতে বলেছে।
---তারপর?
---জানতে চাইল কেন।আমি বললাম, পূজার সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আলোচনা করবে।
---ও আচ্ছা।
---নীলকন্ঠ দাদা,তোমাকে এমন অস্থির লাগছে কেন?
---বলবো,পূজা শুরু হোক।

চারিদিকে পূজার গন্ধ।আত্মীয় পরিজন আসতে শুরু করেছে সবার বাড়িতে বাড়িতে।নানান রকম খাদ্য খাবার, মিষ্টি মিঠাই।প্রতিটা বাড়িতে আল্পনার রঙ যেন প্রতিটা মানুষের আনন্দের রূপলেখা।নতুন জামাকাপড়, নতুন অলঙ্কার। যার যেমন সাধ্য সে তেমন ভাবেই সাজতে শুরু করেছে।
আজ ষষ্ঠী, কাল সপ্তমী।

সকাল বিকাল দু'বারই দূর্গা মন্দিরে। পারলে আরো একবার বেশি যায়।পরোনে ঐ একিই রঙের শাড়ি। চারিদিকে কাকে যেন খুঁজে চলেছে।

মহাষ্টমী শুরু।আজ মন্দিরে বসার জায়গা হবে না।ঠাকুর মশাইকে কয়েকবার অঞ্জলি মন্ত্র পাঠ করাতে হবে।ভোর বেলায় শিউলি তলা থেকে শুরু করে অষ্টমীর অঞ্জলি দেওয়া পযর্ন্ত,শত মানুষের ভিড়ে কোন একটা মুখ খুুঁজে ফেরা।

মন্দির প্রায় ফাঁকা।ছোট্ট একটা মেয়ে হঠাৎ করে একটা কাগজ ধরিয়ে দিয়ে ছুটে পালালো।আমি কোনকিছু জানতে চাওয়ার আগেই আমার হাত থেকে শিউলি ফুলের মালাটা নিয়ে।

চিঠি!!!

দূর্গা,
প্রিয় কথাটা যুক্ত করতে পারলে মনের তৃপ্তি একটু বেশি পেতাম বোধ করি কিন্তু পারলাম না।হয়তো প্রিয় শব্দে যতটুকু চাওয়া তার চেয়েও আরো একটু অধিকার দেখানো উচিত ছিল,সেখানেও হেরে গেলাম।তাই পত্রে কিছু কথা।আমি নীলকন্ঠ বলে তোমাকে নীলাম্বরী সাজতে বলেছি একথাটা যেমন সত্য, তার থেকেও বেশি সত্য আমার চলে যাওয়া। বাবা আর কাকুর সব কথা আড়ালে দাঁড়িয়ে আমি শুনেছিলাম। আমাদের বিয়ের দিন তারা নিজেরা বসে ধায্য করেছেন।তোমাকে পাওয়া আমার সাধনা ছিল যেমন তোমাকে হারানো আমার ব্যর্থতাও তেমন।আমি চলেছি,তোমার আমার দেশকে মুক্ত করার এক কঠিন বাস্তবতার উদ্দেশ্যে।মন্দিরের মাকে প্রণাম করে তাই সবাইকে ছেড়ে আজ দেশ মাতাকে মুক্তি দিতে আমার চলে যাওয়া।
আমার প্রেম ভালবাসা বলো আর সাধনা আরাধনা বলো,সবই বিসর্জন দিয়ে এক নতুনের পথে গমন করেছি।
ফিরে আশার পথ চেয়ে না থেকে তুমি ভালো থেকো।
আমার নীলাম্বরী, এই স্মৃতিটুকু আমাকে আমার সাহস যোগাবে।
ইতি,
নীলকন্ঠ।

---কাঁদছিস কেন মা?আর কাঁদিস না।কি হয়েছে, খুলে বল আমাদের।আমরা তোর বাবা-মা। তোর চোখের জল এভাবে কিভাবে সহ্য করবো।মেয়েকে শান্তনা দিয়ে চলেছে দূর্গেশ্বর বাবু আর স্বরুপিনী দেবী।
কিন্তু দূর্গার কান্না আর থামছে না।ওদিকে মন্দিরে বিসর্জনের ঢাকের বাজনা শুরু হয়েছে। সবাই মাকে বিদায় জানাতে মন্দিরে।

নীল শাড়ি পরে বাইরের বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে আরেক রূপের দূর্গা।একে যেন আগে কেউ কখনো দেখেনি,চেনে না,জানে না।
দূর্গেশ্বর বাবু দু'পা এগিয়ে আবার জানতে চাইল,
কি হয়েছে মা?
দূর্গা বিসর্জনের অশ্রু না মুছেই এবার চিঠিটা বাবার হাতে দিয়ে বললো ---
আজ আমার একরূপের বিসর্জন হলো।।

IMG20210501172305.jpg

Authors get paid when people like you upvote their post.
If you enjoyed what you read here, create your account today and start earning FREE STEEM!
Sort Order:  

বিসর্জন নিয়ে খুব সুন্দর একটি গল্প উপস্থাপন করেছেন। এটি পড়ে মনটা খুব ভালো লাগলো।

ধন্যবাদ

সত্যি বলতে কি, আমার যেখানে দাদু বাড়ি ছিল সেখানে পুরো এলাকাতে হিন্দু পরিবারের বসতি ছিল অনেক আর আমি ছোটবেলা থেকেই দুর্গাপূজা অনেক দেখেছি ।যাইহোক বিসর্জন নিয়ে অনেক ভালো লিখেছেন। আর আমার সেই পুরনো দিনগুলোর কথা মনে পড়ে গেল। ধন্যবাদ আপনাকে ।

পুরোনো স্মৃতি জাগাতে পারলাম তাহলে। যাই হোক,লেখাটি পড়ার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ।

বছর দুয়েক আগে খুব কাছ থেকে দাদা শ্বশুরের বাড়ি থেকে দূর্গা পূজার বিষয় গুলো দেখেছি। শেষের দিনটি আসলেই অনেক বেদনাগন হয়। যাইহোক ভালো লিখেছেন।

গল্পটা আসলে দেশপ্রেমের , সব জাগতিক ভালোবাসা-বাসির ঊর্ধ্বে হলো দেশপ্রেম । দেশের জন্য নিজের ছোটবেলাকার প্রথম প্রেম বিসর্জন । দারুন লাগলো । Awesome

একদম ঠিক কথা। দেশপ্রেমের উপর কিছুই হতে পারে না।