জননেতা ভাসানী আমাদের লাল মাওলানা, রেড মাওলানা। তা মাওলানা আবার লাল হয় কীভাবে?
ভাসানী সম্বন্ধে আমার তেমন জানাশোনা নেই। বাংলাদেশের রাজনীতিতে তার নাম তেমন উচ্চারিত হয় না। ফলে তিনি মাঝেমধ্যে একটা কিংবদন্তী চরিত্র হিসেবে উত্থাপিত হোন। ভাসানী আওয়ামী মুসলিম লীগের নেতা ছিলেন কিন্তু আওয়ামী লীগ তাকে এখন আর পোঁছে না। অবশ্য ভাসানীও একটা সময় পরে আওয়ামী লীগকে পুঁছত না। ভাসানী ন্যাপ নেতা, এ পরিচয়ে তার নাম অনেকবার শুনেছি। আমার আত্মীয়-স্বজন, পরিচিত অনেককে শুনেছি তারা ভাসানীপন্থী ছিলেন। দেশে-বিদেশে ভাসানীর অনেক ভক্ত আছেন। অনেক বছর আগে কোথায় যেন পড়েছিলাম ভাসানীর এক ভক্ত তাঁকে নিয়ে গান লিখেছেন, “মাওলানা ভাসানী তুমি কোথায়?” গানের এই ধুয়োটুকুই মনে আছে, পুরো গানটা মনে নেই।
Image may contain: text that says 'মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানীর তম জন্মবার্ষিকীতে মওলানা ভাসানী আর্কাইভের পক্ষ থেকে গভীর শ্লদ্ধা জন্ম: ১২ই ডিসেম্বর ১৮৮০ মৃত্যু: ১৭ নভেম্বর ১৯৭৬'
ভাসানী যেহেতু কিংবদন্তী তাই কিংবদন্তীদের নিয়ে যা হয় তাকে নিয়েও তাই হয়েছে। ভাসানীকে নিয়ে অনেক দূর্বোধ্যতা আছে। একদিকে জনগণের মানুষ, নেতা, সহজ, সরল জীবন। মানুষ তাকে পীর মানত। অপরদিকে বামপন্থী নেতা, রেড মাওলানা। বাম রাজনীতির মত ও পথের আন্তর্জাতিক রাজনীতির অংশ। ভাসানী বাংলাদেশপন্থী। পাকিস্তানকে ‘আসসালামু আলাইকুম’, ভারতকে ‘খামোশ’ বলা আপোষহীন রাজনীতিক।
এতকিছু কীভাবে মেলানো সম্ভব? কেউ কেউ আছেন তার পীর সত্ত্বাকে নিয়ে থাকেন তারা তার বামপন্থাটুকু দেখেন না, দেখতে চান না। পীর হয়ে, মুসলিম হয়ে কী সাম্যবাদী রাজনীতি সম্ভব?
আমার মনে হয় সম্ভব। প্রত্যেক নবী-রাসুল তার কওমের মানুষের জন্য তখনকার সময়োপযোগী সাম্যবাদী কাজ কাজ করে গেছেন। যীশুর কথা বলা যায়। যীশু সূদ, লগ্নি ব্যবস্থা, বাজার ব্যবস্থার প্রতিবাদ করেছেন। সমাজের নির্যাতিত নিপীড়িত জেলে, মুটে মজুরদের মধ্যে কাজ করেছেন। রাজশক্তির প্রতি বিরোধীতার শাস্তি হিসেবে রোমান সম্রাটের প্রতিনিধির দ্বারা ক্রুশবিদ্ধ হয়ে জীবন দিয়েছে।
নবী মোহাম্মদও তেমনি মক্কা নগরের বাজার কালচারে মধ্যে বেদুঈন এথিকস চালু করেছেন। যেটা তিনি তার দুধ মা হালিমার কাছে থাকার সময়ে বেদুঈনদের কাছ থেকে শিখেছেন। বেদুঈনেরা গোত্রের সবাইকে নিয়ে একসাথে খায়। খাবারের অভাব হলে পাশের গোত্রে রেইড দিয়ে সেখান থেকে খাবার নিয়ে আসে। এর সাথে যাকাত এবং ফিতরার মত কিছু ব্যবস্থা করে জনকল্যাণ মূলক কিছু প্রোগ্রাম চালু করে দিয়ে গেছেন।
ধর্মীয় নেতাদের বৈপ্লবিক ভূমিকা সেজন্য নতুন কিছু নয়। তাদের সাংগঠনিক শক্তি এবং নেতৃত্বের মাধ্যমে তারা সমকালীন প্রচলিত নিয়মের মধ্যে কিছু বিপ্লব সাধন করে গেছেন।
বিশ শতকে এসেও আমরা দেখি লাতিন আমেরিকায় ‘লিবারেশন থিওলজি’ ধর্মকে সাথে নিয়ে গরীব মানুষের মধ্যে জনকল্যাণমূলক কাজ করছে। ধর্ম সেজন্য বড় ফ্যাক্টর নয়। মানুষের জন্য কাজ করতে চাইলে ধর্ম বিশ্বাস বড় সমস্যা নয়। জনসম্পৃক্ততা, জনগণের হয়ে জনগণের জন্য কাজ করে তাদের আশু সমস্যা সমাধান এখনকার সময়ের জন্য জরূরি কাজ। এরপরে না হয় বিপ্লব কর যাবে। বিপ্লব তো আর কোথাও চলে যাচ্ছে না।
মজলুম জননেতা মাওলানা ভাসানী
পাশ্চাত্য চিন্তা-চেতনা এবং সারা দুনিয়ার অন্যান্য অঞ্চলের চিন্তা-চেতনার বিকাশের মধ্যে মৌলিক পরিবর্তন আছে। তবে রাস্তা ভিন্ন হলেও লক্ষ্য এবং অর্জন একই। পাশ্চাত্য দর্শন যুক্তিকে ভিত্তি করে যে জায়গায় পৌঁছেছে, ভারতীয় দর্শন তেমনি ধর্মকে সহায় করে একই জায়গায় পৌঁছায়। আধুনিক পাশ্চাত্য দর্শনে কান্ট, শোপেনহাওয়ার,হেগেলের সাথে ভারতীয় বেদান্ত দর্শনের মূল প্রতীপাদ্যের সাথে অমিলের চেয়ে মিলই বেশি। ভারতের কণাদ দর্শন আর ডেমোক্রিটাস, এপিকিউরাসে কণাবাদের মূল বিষয় এক। পার্থক্য তারা দুটি ভিন্ন ভিন্ন অবস্থান থেকে একই জায়গায় পৌঁছেছেন।
“Eastern philosophy has been in some ways profounder than Western philosophy for much of the past, but in the last two hundred years the balance has been redressed. The Upanishads were mostly written before western philosophy was born. Throughout the centuries during which ancient Greek philosophy was forming, Hinduism and Buddhism were intellectually lively and were spreading across vast areas of Asia.
There are obvious similarities between many of the doctrines of Hinduism and Buddhism, on the one hand, and Kantian-Schopenhauerian philosophy on the other.” – ব্রায়ান ম্যাগি
পাশ্চাত্যের কাছে ভারতের ভক্তিবাদ যেমন দূর্বোধ্য, অবমাননাকর তেমনি ভারতীয় আধ্যাত্মিক জলহাওয়ার মানুষের কাছে পাশ্চাত্যের যুক্তিবাদ নীরস। সেজন্য কার্ল মার্ক্সের কাছে মানুষের জন্যে ভক্তিভরে হনুমানের কাছে মাথা নত করার মত অবমাননাকর আর কিছু হতে পারে না। মার্ক্সের কাছে ভক্তিবাদ এতই অবজ্ঞার বিষয় যে হনুমানের নামটাও তিনি সঠিকভাবে লিখেননি।
“brutalizing worship of nature, exhibiting its degradation in the fact that man, the sovereign of nature, fell down on his knees in adoration of Kanuman, the monkey” – কার্ল মার্ক্স
ভারতবর্ষ আধ্যাত্মিক চিন্তার জগত। এখানে মানুষের চলাফেরায় উঠাবসায় যোগ দর্শনের প্রভাব, জীবন দর্শন ধর্মীয় প্রথা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। কানু ছাড়া এখানে গীত নেই। তাই পাশ্চাত্যের ইওরোসেন্ট্রিক চিন্তা দিয়ে ভারতের ভাববাদ, সাকার পূজার মর্ম বুঝা যাবে না। তাছাড়া মানুষের স্বভাবজাত চেতনা সহজে পরিবর্তন হবে না। ভারতীয়রা তাদের সাহিত্য, সংস্কৃতি, জীবনাচরণের সর্বত্র ধর্ম দ্বারা নিয়ন্ত্রিত।
তাই বলে কী এখানে বামপন্থা কাজ করবে না। অবশ্যই করবে। বামপন্থা কোন স্থান-কাল নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দর্শন নয়। গরীব মানুষকে নিয়ে কার্ল মার্ক্সই প্রথম কথা বলেছেন এমন নয়। সভ্যতার শুরু থেকে ‘হ্যাভস আর হ্যাভ নট’দের দ্বন্দ্ব চলছে। দাস বিদ্রোহ থেকে শুরু করে মধ্যযুগের কৃষক বিদ্রোহ, আধুনিক যুগে শ্রমিক আন্দোলনের মাধ্যমে মানুষ আজকের যতটুকু অর্জন সেটা আদায় করে নিতে পেরেছে। পরিবেশ পরিস্থিতি, দেশ-কাল ভেদে আন্দোলন সংগ্রামের গতি-প্রকৃতি পরিবর্তিত হয়েছে। কিন্তু একটা বিষয় সব সময় স্থির নির্দিষ্ট ছিল, গরীব, নির্যাতিত মানুষ প্রতিবাদ-প্রতিরোধের মাধ্যমে আপামর মানুষের সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে গেছে। আমাদেরকে মানুষের ইতিহাস শুরু করার পথে অগ্রসর করেছে। এখনো তাই হবে এবং দেশে দেশে তাই হচ্ছে। প্রশ্ন হলো, আপনি কী নির্যাতিত, নিপীড়িত, মজলুমের পক্ষে, ইতিহাসের সাথে হাঁটতে চান? নাকী ইতিহাসের বিপক্ষে দাঁড়িয়ে ক্ষমতাবানদের সাথে থাকতে চান? না সহীহ, শুদ্ধ বিপ্লবের জন্য অপেক্ষা করা আর্মচেয়ার বিপ্লবী হতে চান?
আধ্যাত্মিক প্রাণি হিসেবে মানুষের আধ্যাত্মিক জীবনের বিরোধীতা করা যায় না। আর সবকিছু কেড়ে নেয়া গেলেও এটা মানুষের কাছ থেকে কেউ কেড়ে নিতে পারে না। ভারতবর্ষের মত আধ্যাত্মিক সমাজে তাই আধ্যাত্মিক না হলে জনবিচ্ছিন্নতার হুমকি থেকে যায়।
আধ্যাত্মিকতার দিক থেকে আমি বামপন্থার সাথে কোন বিরোধ দেখি না। একজন মানুষ আধ্যাত্মিকভাবে নিজেকে আশরাফুল মখলুকাত ভেবে কিছু সময় মানসিক স্তরের ভিন্ন একটা অবস্থা, অল্টারড কনশাসনেস অবস্থায় থাকতে পারে। কিন্তু তাকে রুটি রুজির জন্য, সমাজের একজন হয়ে থাকার জন্যে মাটিতে নেমে আসতেই হবে। মাটিতে নেমে আসলে তার সমস্যা নিয়ে কথা বলা, তার দাবী-দাওয়া আদায় করা যদি বামপন্থা হয় তাহলে তাকে বামপন্থী হওয়া ছাড়া অন্য উপায় থাকে না। পুঁজিপতিরা কখনো এমনি এমনি ছেড়ে দেবে না, অধিকার আদায়ের জন্য লড়াই-সংগ্রাম করতে হবে। সেই লড়াইয়ে একজন মানুষের ধর্মীয় বা আধ্যাত্মিক পরিচয় মূখ্য কিছু নয়। তার সামাজিক বিনির্মাণ, রুটি-রুজি এমনকী তার ধর্ম-আধ্যাত্মিকতা পর্যন্ত এই লড়াইয়ের সাথে সম্পর্কিত।
মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী রসিকও বটেঃ - আমি নশ্বর এর বাংলা ব্লগ । bangla blog | সামহোয়্যার ইন ব্লগ - বাঁধ ভাঙ্গার আওয়াজ
মাওলানা ভাসানী বাংলাদেশে সেই কাজটিই করে গেছেন। তার কাজে আধ্যাত্মিকতা বা বামপন্থা কোনটাই একে অপরের বিরোধী ভূমিকায় হাজির হয়নি। বরং তারা একে অপরের সম্পূরক ভূমিকা নিয়ে তাঁকে একজন পূর্ণাঙ্গ বিপ্লবী, সমাজতান্ত্রিক রাজনৈতিক কর্মী, নেতা হতে সহায়তা করেছে। মানুষের জন্য তার দ্বার ছিল অবারিত। গণ মানুষের কাছে তিনি পৌঁছাতে পেরেছেন, তাদের হৃদয়ে তিনি স্থান করে নিয়েছেন। কারও কাছে হয়ত পীর, কারও কাছে হয়ত আপোষহীন নেতা, কারও কাছে দুটোই। মুসলিম হয়েও পাকিস্তান বিরোধীতা, ভারতবেষ্টিত রাষ্ট্র হয়েও ভারতকে হুমকি দেবার সাহসী নেতা বাংলার ইতিহাসে বিরল। অন্য অনেক নেতা ভাসানীর সাথে বেঈমানী করলেও ভাসানী তাদের সাথে বা বাংলাদেশের সাথে কখনো বেঈমানী করেননি। আজ ১২ ডিসেম্বর মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী’র ১৪০তম জন্মবার্ষিকী।
**বাঙালি জাতির আর এক জনক **
পোস্ট শেয়ার করুন