আগামীকাল আমার বিয়ে। অথচ আমি এখনও বাড়িতে পৌঁছোতে পারিনি। আজ আমার অনার্স সেকেন্ড ইয়ারের শেষ পরীক্ষা ছিল। পরীক্ষা শেষে হোস্টেলে গিয়ে গোছগাছ সেরে বেরিয়েছি। এখন দাঁড়িয়ে আছি ফরিদপুর রেলওয়ে স্টেশনের কাউন্টারে।
সন্ধ্যা ৬ টার ট্রেনে রাজবাড়ির উদ্দেশে যাত্রা শুরু হবে আমার। ঘড়িতে এখন সময় ৫ টা বেজে ৩০ মিনিট। ট্রেন আসতে এখনও ত্রিশ মিনিট বাকি। গতরাতে পরীক্ষার চিন্তায় ঘুম হয়নি মোটেও। মোটকথা গত এক সপ্তাহ ধরেই বিয়ে আর পরীক্ষা দুই নিয়েই ঘুম জিনিসটা থেকে দুরত্ব বেড়েছে। ঠিকঠাক ঘুম না হলে দিনের বেলায় জ্বর জ্বর বোধ হয়। আমার ভেতরেও এমন অনুভূতি হচ্ছে। আমি প্লাটফর্মের সিমেন্টের গোল পাটাতনের উপর বসে পড়লাম। আমার পাশে হরেক রকম মানুষ। কেউ বসে আছে, কেউ দাঁড়িয়ে আছে, কেউ ছুটাছুটি করছে, কেউবা বাদাম-পপকর্ণ কিনছে।
মোবাইলে ভাইব্রেশন হচ্ছে। ব্যাগের ভেতর থেকে ফোনটা বের করে হাতে নিয়েই বুঝতে পারলাম বাবা কল করেছে। কল রিসিভ করতেই ভেসে এল মায়ের গলা,
"ট্রেনের টিকেট পেয়েছিস মা? বাড়িতে আসতে আসতে ক'টা বাজবে তোর?"
আমি বুঝতে পারলাম আমার পৌঁছানো নিয়ে বাড়ির সবাই বেশ উদ্বিগ্ন হয়ে আছে। তাদের টেনশন বুঝতে পেরে আমি স্বাভাবিক গলায় বললাম,
"ছয়টার টিকেট কিনেছি। ঠিক সময় মতো ট্রেন এলে রাত আটটার মধ্যেই বাড়িতে পৌঁছে যাব।"
"তুই ফেরার পরই কিন্তু হলুদের অনুষ্ঠান শুরু হবে। রাস্তায় কোথাও দেরি করিস না মা, জলদি চলে আসিস।"
আমার একটু মেজাজ খারাপ হলো; তবুও প্রকাশ না করে ফোন রাখতে চাইলাম। মা বলল,
"সাবধানে আসিস। এমনিতেই একটা দুর্ঘটনা ঘটে গেছে বাড়িতে। এখন কোন মুখে তোর শ্বশুরকে এসব বলব সেটাই বুঝতে পারছি না।"
আমি জিজ্ঞেস করলাম, "কিসের দুর্ঘটনা? আর দুর্ঘটনার কথা আমার শ্বশুরকেই বা জানাতে হবে কেন? দুর্ঘটনার সাথে তাঁদের সম্পর্ক কী?"
মা কণ্ঠে অস্থিরতা ধরে রেখেই বলতে লাগল,
"তুই আগে বাড়িতে আয়। তারপর তোকে সবটা জানাব।"
বলেই ফোনটা কেটে দিল সে।
আমি ফোনটা ব্যাগে রেখে আবার চারপাশটায় দৃষ্টি রাখতে লাগলাম। বারবার ঝিঁমুনি এসে চোখ দুটিকে বুজিয়ে দিতে চাইছে। আমি বসে না থেকে উঠে দাঁড়ালাম।
দুই
রেললাইনের উত্তর দিকটায় গাছগাছালিতে ভরা জায়গাটায় নির্দিষ্ট দুরত্বে দুরত্বে বেঞ্চ পেতে রাখা হয়েছে। ঝিঁমুনির ভয়ে বসে না থেকে সেদিকটাতে এগিয়ে গেলাম। কিছুক্ষণ বাদে চিপস, বিস্কুট আর কোমল পানীয়ের তপ্লি ঘাড়ে ঝুলিয়ে এক হকার এলো আমার কাছে।
"বিস্কুট, আরসি লাগবো আপা।" কয়েকবার জিজ্ঞেস করল।
বয়স তের কী চৌদ্দ হবে হকার ছেলেটার। ছেলেটাকে দেখে কেন জানি না মায়া হলো আমার। আমি ওর থেকে একটা কোমল পানীয়ের বোতল কিনলাম। তারপর মূল্য পরিশোধের জন্য পঞ্চাশ টাকার নোট দিয়ে বাকী বিশ টাকা আর ফেরত নিলাম না। হকার চলে যাবার পর খেয়াল করলাম এক লোক হাতে ছোট একটা কাপড়ের ঝোলা ঝোলাতে ঝোলাতে এদিকটাতেই আসছে। লোকটাকে আসতে দেখে আমি বসে পড়লাম। লোকটা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কেমন যেন এদিক-সেদিক করতে লাগল। খানিকবাদে আমার পাশে ঘুরল। বলে উঠল, "কিছু মনে করবেন না প্লিজ। আপনাকে দেখে ভালো বংশের মেয়ে বলে মনে হচ্ছিল বলেই অনুরোধটা নিয়ে আপনার কাছে এসেছি। আমার কাছে থাকা একটি জিনিসকে সুরক্ষিত স্থানে রাখা জরুরি। এখানে আমার বেশ বিপদ। আপনি যদি আমাকে বিশ্বাস করতে পারেন তবে আপনার কাছেই জিনিসটা রাখতে চাই। এতটুকু বিশ্বাস রাখতে পারেন আমি যা রাখব সেটা বেআইনী কিছু না। আমি কোনো ক্ষতি করব না আপনার। আমার হাতে সময় কম, দ্রুত আপনার ফোন নম্বরটি আমাকে দিন। আমি সময় মতো যোগাযোগ করে নেব আপনার সাথে।"
আমি পুরো জমে গিয়েছি। কী বলব বোধ পাচ্ছি না। তবু আমতা আমতা করে কণ্ঠ তুলে বললাম, " দুঃখিত, আমি পারব না। আপনি অন্য কাউকে খুঁজে নিন।"
নিচের দিকে তাকিয়ে কথাগুলো বলছিলাম। মাথা তুলতেই দেখি লোকটি পাশে নেই। অদ্ভুত ব্যাপার! আমি দ্রুত এদিক-ওদিক তাকালাম। এভাবে মুহূর্তেই হাওয়া কী করে হয়ে গেল লোকটা। আজব!
লোকটির হাতের সেই ঝোলাটাকে দেখলাম আমার পায়ের কাছে পড়ে আছে। ঝোলাটা উঠাব কি উঠাব না চিন্তায় পড়ে গেলাম। হঠাৎ স্মরণ হলো লোকটি না আমার ফোন নম্বর চেয়েছিল?
"ছিঃ কী কাজ করলাম, তাকে ফোন নম্বরটিও দিলাম না। এখন উপায়? আমার ট্রেন তো এখনি এসে পড়বে। লোকটিকে তার এই ঝোলা কেমনে ফিরিয়ে দেব?" অস্থিরতা কাজ করতে শুরু করল ভেতরে। একবার ভাবলাম যাহ্ নিচ থেকে তুলবই না এই জিনিস। আবার মনে হলো লোকটা যদি এরপর কোনোভাবে আমার ঠিকানায় পৌঁছে যায় তবে তাকে কী জবাব দেব? অনেক চিন্তাভাবনা আর মনস্তান্ত্বিক টানাপোড়েন পোহিয়ে হাত বাড়ালাম ঝোলাটির দিকে। মনে মনে দোয়া ইউনুস পড়তে লাগলাম। আল্লাহকে ডেকে বলতে লাগলাম, "রক্ষা করো সৃষ্টিকর্তা। এর মধ্যে কোনো বোমাটোমা যেন না থাকে। আগামীকাল আমার বিয়ে। আমার বাবা-মা আমার অপেক্ষাতে পথ চেয়ে বসে আছে। আমার বর আমাকে ঘিরে স্বপ্ন সাজাচ্ছে। বিয়ের আগেই আমার বরটাকে তুমি বউছাড়া কোরো না আল্লাহ্।"
কী অদ্ভুত! এমন জটিল মুহূর্তে ওই অপরিচিত ভদ্রলোকের কথা মনে পড়ল কেন? অতি টেনশনের মধ্যেও হাসি বেরিয়ে চোয়াল টেনে ধরতে লাগল।
অদ্ভুতুরে হাসি হাসছি এমন সময় সেই হকার ছেলেটা আমাকে ডাকতে লাগল। কেন ডাকছে সে, আমি এই প্রশ্নটা জিজ্ঞেস না করে এক দৃষ্টিতে তাকিয়েই আছি। আমাকে ওভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে ছেলেটা ছুটে আসলো আমার দিকে। আমার বেশ কাছে এসে বলতে লাগল, "আপা আপনের ট্রেন আইসা গেছে। ট্রেন তো এখনই ছাইড়া দিব। আপনে যান না?"
তিন
ঘোর কাটিয়ে তাকিয়ে দেখি ট্রেনের হুঁইসেল বাজছে। আমি এক দৌঁড়ে ট্রেনের দিকে ছুটতে লাগলাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই ট্রেনের দরজা পেয়ে উঠে সিটে বসলাম। বসার পর থেকেই বারবার আমি আশপাশটায় তাকিয়ে লোকগুলোকে খেয়াল করতে লাগলাম। ঝোলাওয়ালা সেই লোকটাকে খুঁজে পাওয়া যায় কি না, এই আশায়। কিন্তু না কোথাও লোকটির দেখা নেই। এভাবে কোথায় চলে গেল অদ্ভুত লোকটা!
চিন্তা করতে করতে ঝোলাটাকে আমার সাইড ব্যাগের মধ্যে ঢুকিয়ে রেখে আমি জানালার বাইরে তাকিয়ে আছি।
ট্রেন চলছে ঝকঝকাঝক। আমি জানালার পাশে বসে আছি। মৃদুমন্দ ঠান্ডা বাতাস এসে আমার চুলগুলিকে উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে। গত এক সপ্তাহের নির্ঘুমতায় শরীরে যে অস্বস্তির জন্ম হয়েছিল নিমেষেই সেসব অস্বস্তি কেটে যাচ্ছে মনে হলো।
প্রায় বিশ মিনিট পর ট্রেন পরের স্টেশনে থামল। আমি জানালা থেকে মুখ সরিয়ে নড়েচড়ে বসতে যাব তখনই খেয়াল হলো আমার ব্যাগের চেন খোলা। আমি হন্তদন্ত হয়ে ব্যাগের ভেতরে হাত দিয়ে সেই ঝোলাটাকে খুঁজতে লাগলাম। না, আমার সাইড ব্যাগের কোথাও ঝোলাটি নেই।
দুশ্চিন্তার বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে আমাকে ভিজিয়ে তুলছে ক্রমাগত। উপায়ন্তর না বুঝে আমি পাশের লোকটিকে জিজ্ঞেস করলাম, "আমার ভানিটি ব্যাগের ভেতরে মেটে রঙের ছোট একটা কাপড়ের ঝোলা ছিল। আমার ব্যাগের চেন খুলে ঝোলাটাকে কি কাউকে নিতে দেখেছেন?"
আমার কথা শুনেই লোকটা ক্ষেপে গেল। বলল, "আপনি কি আমাকে চোর মনে করছেন? আপনার এতো বড়ো সাহস কেমনে হলো যে আপনার কী না কী হারিয়ে আর সেই কথা আপনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন? আমাকে চেনেন আপনি? আমার চাচাতো ভাইয়ের ছেলে পুলিশের বড়ো ওসি। আর আপনি কি না আমাকে চোরের অপবাদ দেন?"
লোকটা অহেতুক চিৎকার- চেঁচামেচি করতে লাগল। আমি বারবার বলার চেষ্টা করছি যে আমি তাকে অপবাদ দেইনি। কেউ ব্যাগটা খুলেছে কি না জিজ্ঞেস করেছি মাত্র। কিন্তু কে শোনে কার কথা। শেষমেষ আমি তার পাশ থেকে উঠে গিয়ে অন্য একটা সিটে গুঁটিসুটি হয়ে বসলাম। মনটা ভীষণ রকমের খারাপ হয়ে গেছে। একজন লোক আমাকে বিশ্বাস করে আমার কাছে একটা জিনিস রাখল অথচ সেটাকে আমি সুরক্ষিত রাখতে পারলাম না। হারিয়ে ফেললাম? কী জবাব দেব আমি তার কাছে? আমানত রক্ষা করতে না পারার ব্যর্থতাস্বরূপ কতবড়ো শাস্তি যে অপেক্ষা করছে আমার জন্য তা কে জানে?
এসব ভাবছি আর অস্থিরতা বাড়ছে। এমন সময় প্রচণ্ড ঝামটা এসে আমাকে উল্টে নিচে ফেলে দিতে চাইল। আমি সিটটাকে শক্ত করে ধরে নিজেকে নিচে পড়া থেকে আটকে রেখেছি। হঠাৎ তাকিয়ে দেখি সেই ঝোলাওয়ালা লোকটি আমার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। মিনমিনে গলায় আমাকে বলছে, "আমার ঝোলাটা দিন।"
আমি ক্ষমা চেয়ে বলতে লাগলাম, আপনার ঝোলাটাকে হারিয়ে ফেলেছি আমি।"
শুনেই লোকটা ক্ষেপে উঠল আমার উপর। বলল, "আমানত, খিয়ানতের শাস্তি জানিস। এই ট্রেনেই আজ তোর মৃত্যু লেখা আছে। এবার মর।"
ঝোলাওয়ালা লোকটা হেঁচকা টানে আমাকে দরজার সামনে নিয়ে এল। আমি চিৎকার করে বাঁচার আকুতি প্রকাশ করতে লাগলাম।
এমন সময় কেউ একজন আমাকে এক ধমক দিল বলে কানে এল। ধীরে ধীরে শান্ত হয়ে চোখ খুলে বুঝতে পারলাম এতোক্ষণ ধরে যা দেখছিলাম সে সবই দুঃস্বপ্ন। বোধ ফিরতেই ব্যাগের চেন খুললাম। ঝোলাটি ঠিকঠাক সেরকমই পড়ে আছে দেখে স্বস্তির নিশ্বাস ফেললাম।
চার
অস্থিরতা কাটিয়ে শান্ত হওয়ার চেষ্টা করছি তখনই সামনের রাজবাড়ি স্টেশনে যাত্রীদের নেমে পড়ার বার্তা জানিয়ে দেয়া হলো। আমার নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছে গেছি আমি। একটু পরই নেমে পড়ব ট্রেন থেকে।
কিন্তু ঝোলাটির মালিক এখনও এলো না ভেবে মনটা খারাপ হলো আবারো। নিজেকে বুঝিয়ে বলতে লাগলাম, "লোকটির জিনিস আমি তো আর নিজের জন্য চেয়ে রাখিনি। সে যদি নিজ থেকে জোর করে তার জিনিস রেখে যায় তবে আমি কী করতে পারি?"
স্থির করলাম এই উটকো ঝামেলা নিয়ে আর একটুও দুশ্চিন্তা নয়।
ট্রেন থেকে নেমে কখনো অটো আবার কখনো রিকসা নিয়ে ভেঙে ভেঙে বাড়িতে পৌঁছালাম। পৌঁছাতে পৌঁছাতে ঘড়িতে রাত নয়টা বাজল। বাড়িতে ঢুকেই দেখি বাড়ির সবাই খুব চিন্তা করছে আমার জন্য। যাহোক আমাকে কোনো রকমে সাজিয়ে হলুদের মঞ্চে বসানোর পরই হলুদের অনুষ্ঠান শুরু হলো। অনুষ্ঠান শেষ হতে হতে রাত বারোটা গড়াল।
সবাই যখন ঘুমানোর জন্য বিছানা খুঁজতে ব্যস্ত তখন আমার মা আমাকে নিরিবিলি তাদের রুমে ডাকল। তারপর বলল, "একটা অঘটন ঘটে গেছেরে অদিতি। এখন কী করব ভেবে পাচ্ছি না। লজ্জার কথাটা কী করে প্রকাশ করব বুঝতে পারছি না।"
আমি অভয় দিয়ে বললাম, "বলো কী হয়েছে? আমাকে বলতে আবার কিসের লজ্জা?"
মা জানাল, রিটায়ারমেন্টে যাওয়ার আগে আমার বিয়ের জন্য যে হার, কানের দুল আর হাতের চুড়ি বানিয়ে রেখেছিল বাবা; গত পরশু সেই গয়নার বাক্সটি খুলে দেখে বাক্সে হার নেই। হাতের চুড়ি আর কানের দুল পড়ে আছে শুধু। বাড়ি ভর্তি মেহমান, লজ্জায় কাউকে জিজ্ঞেসও করতে পারেনি। কেবল আমার ছোট ভাই আর বোনকে জিজ্ঞেস করা হলে তারা এ ব্যাপারে কিছুই জানে না বলে দিয়েছে। এদিকে পাত্রপক্ষের কোনো দেনা-দরবার না থাকলেও পাত্রের মায়ের কাছে দেড় ভরি সোনা দিয়ে গড়ানো হারের গল্প না কি করেছে মা কয়েকবার। হার ছাড়া মেয়ে পাঠালে তারাই কী মনে করবে এটাই এখন বারবার বলছে মা? আবার এই মুহূর্তে বিয়ের খরচ বাদে পর্যাপ্ত টাকাও বাবার হাতে নেই। এই অবস্থায় তারা কী করবে বুঝতেও পারছে না।
সব শুনে আমি বললাম, "কী আর করার! চিন্তা করে আর কী হবে? নেকলেস ছাড়াই যাব আমি, আমাকে জিজ্ঞেস করলে বলব চুরি হয়ে গেছে নেকলেসটি।"
মা বলে উঠল, "এতে তোর বাবা-মাকে প্রতারক ভাববেন তারা। ভাববেন, ভন্ডের মতো গল্প করতে পারি শুধু। কী যে লজ্জায় পড়েছি। আচ্ছা অদিতি, এক কাজ করলে কেমন হয়, আগামীকাল একটা সিটি গোল্ডের হার পরিয়ে দেব তোকে? বিয়ের দিন অত যাচাই-বাছাই করতে কে যাবে? পরে ধীরে-সুস্থে একটি হার বানিয়ে দেয়া যাবে। তুই কী বলিস?"
এ কথায় আমি সায় না দিতে পেরে বললাম, "এতে তোমাদেরকে প্রতারক বলার চান্স আরো বেশি। এরচেয়ে সত্যটা জানিয়ে দেওয়াটাই ভালো। মিথ্যের ফল ভালো হয় না কখনও।"
বুঝলাম মা আরো দুশ্চিন্তায় পড়ে গেছে। আত্মীয়দের কারো কাছ থেকে ধারে অথবা জুয়েলারি দোকান থেকে ভাড়ায় তিন-চার দিনের জন্য একটা হার নিবে কি না জিজ্ঞেস করল। পরক্ষণে আবার নিজেই বলল,
"চোর যদি হারের পিছু না ছাড়ে? যদি অন্যের হারও চুরি হয়ে যায়, তখন! তোর অসুস্থ বাবা পেনশনের টাকা দিয়ে কেনোরকমে সংসার চালায়। ছোট ছেলে-মেয়ে দু'টির পড়াশোনাটাও বন্ধ হয়ে যাবে যদি হারচুরির গচ্চা টানতে হয়। কী করব রে অদিতি, আমি তো কিছুই ভেবে পাচ্ছি না। তোর বাবার মুখটাও রে চুপসে গেছে একদম।"
মায়ের কথাগুলো শুনে মন খারাপ হয়ে গেল আমার। দুশ্চিন্তায় রাতে ঘুম হলো না একদমই। ভাবলাম, বরের সাথে যোগাযোগ থাকলে ভালো হতো, এই দুর্ঘটনার কথাটা তাকে অন্তত জানানো যেত। হঠাৎ এক সপ্তাহের মধ্যে বিয়ে ঠিক হয়ে যাওয়ায় বর সম্পর্কে জানারই সময় হয়নি আমার। তার উপর পরীক্ষার চিন্তায়ই বিভোর ছিলাম গত একমাস। বাবা-মা বলেছে ছেলে আমেরিকা প্রবাসী...দেখতে সুন্দর, ব্যবহারও না কি ভালো। তাই আর দ্বিতীয়বার না ভেবে বাধ্য মেয়ের মতো বাবা-মায়ের পছন্দেই মত দিয়ে দিয়েছি। এদিকে বাবার শরীরটাও ভালো না, এত চাপ হয়তো সে নিতেও পারছে না, এটা ভেবেই আরো মত দিয়েছি।
পাঁচ
নিজের সাথে সারা রাত বকবক করলাম এসব নিয়ে। শেষ রাতের দিকে মনে পড়ল সেই অদ্ভুতুরে ঝোলাওয়ালা লোকটির কথা। মনে পড়তেই খেয়াল হলো, ঝোলাটার মধ্যে কী আছে সেটাই তো দেখা হয়নি।
বিছানা থেকে নেমে টেবিলের নিচের পাল্লার তালা খুলে ব্যাগটি বের করলাম। ঝোলা খুলেই আমার চোখ কপালে উঠল,
"এ তো আমার জন্য বাবার বানানো সেই হারটি। হারটি ওই লোকটার কাছে গেল কীভাবে? তার মানে ওই ঝোলাওয়ালা লোকটিই এই হার চুরি করেছিল? পরে কোনোভাকে আমাদের দুর্দশার কথা জানতে পেরে বিবেকের অনুশোচনায় হারটি আমার কাছে ওভাবে রেখে গেছে? কী আজব!"
যা হোক মা-বাবাকে কারো কাছে ছোট হতে হবে না ভেবে স্বস্তি লাগল। ভাবলাম সকালে উঠেই মাকে ঝোলাওয়ালা চোরের গল্পটা বলব আর তাদের হারটি ফিরিয়ে দেব।
সকাল থেকেই বিয়ে উৎসবী আমেজে সারাবাড়ি মেতে উঠল। বাবা-মায়ের মুখে প্রশান্তির হাসি দেখে আমার মনটাও ভালো হয়ে গেল।
সারা দিনের বিয়ের ঝক্কি পুড়িয়ে আমি এখন বসে আছি আমার ফুলশয্যার বিছানায়। বুক ধকধক করছে, ভয় লাগছে প্রচণ্ড। অপরিচিত একজন মানুষের সামনে কী ভাবে কথা বলব, তার দিকে কীভাবে তাকাব, এসব ভাবছি আর লজ্জায় লাল হয়ে যাচ্ছি। হঠাৎ মনে হলো কেউ রুমে ঢুকছে। আমি ঘোমটাটা সামনে টেনে দিলাম আরেকটু। কিছুক্ষণবাদে একটি পুরুষ কণ্ঠ আমার পাশে বসে বলতে লাগল,
"অদিতি, সেদিন তুমি আমাকে অনেক খুঁজেছ তাই না?"
কণ্ঠ শোনামাত্রই আমি চোখ তুলে উপরে তাকিয়েই বরফ হয়ে গেলাম। এ তো সেই ঝোলাওয়ালা লোকটি। যে কি না আমাদের আলমারি থেকে হার চুরি করে আবার আমারই কাছে রেখে উধাও হয়ে গিয়েছিল। আমার মেজাজ গরম হচ্ছে, রাগে ফুঁসছি আমি। শেষপর্যন্ত একটা চোরের সাথে বাবা-মা আমাকে বিয়ে দিল? আমি এখনই উঠে চলে যাব এখান থেকে, এই চোরের সাথে আর একটি মুহূর্তও না, এই কথাটাই বলতে যাব তখনই লোকটি বলে উঠল, "কী ভাবছো? তোমার হার আমি কোথায় পেলাম... সেটাই তো, হুম? শোন, পরশু সন্ধ্যায় তোমার ছোটভাই হঠাৎ আমাকে ফোন দিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ে। বলে কয়েকদিন আগে একটা বিপদে পড়ে আমার অনেক টাকার দরকার পড়ে যায় ভাইয়া। উপায় না পেয়ে আলমারি থেকে আপুর জন্য বানানো হারটি জুয়েলারি দোকানে বেচে দেই। কিন্তু আজ বিষয়টি মা-বাবার নজরে পড়ার পর থেকে তারা হাত-পা ভেঙে বসে পড়েছে। মনে হচ্ছে তারা অসুস্থ হয়ে পড়বে। আমার অপরাধের শাস্তি আমাকে দেন তবুও আপনি কিছু একটা করেন ভাইয়া।
কী করব, শেষ পর্যন্ত শ্যালকের সম্মান রাখতে জুয়েলারি দোকান থেকে হারটি কিনে কাপড়ের ঝোলায় ভরে তোমার কাছে ওভাবে ঝোলাটি রেখে আসি আমি। কী ম্যাডাম, নেকলেস রহস্য এবার বোঝাতে পারলাম তো, হুম?
শাকিল এ কাজ করেছে শুনে এখন উল্টো লজ্জা লাগছে আমার। আমি বলে উঠলাম,
"আমার ভাইয়ের অপরাধের জন্য লজ্জিত আমি। শুধু শুধু আমি আপনাকে অপরাধী ভাবছিলাম। আমাকে ক্ষমা করবেন। আমি মনে করেছিলাম নেকলেসটি আপনিই...."
বর লোকটা আমার কথা শেষ করার আগেই আমাকে থামিয়ে বলে উঠল,
"ঠিকই তো মনে করেছ। আমি যে মহাচোর সেটাও ধীরে ধীরে বুঝতে পারবে তুমি, হুম!"
বর লোকটা হাসছে আর একটু একটু করে ঝুঁকে পড়ছে আমার দিকে। আমি লজ্জাবতির মতো লজ্জায় জড়োসড়ো হয়ে যাচ্ছি.....
Authors get paid when people like you upvote their post.
If you enjoyed what you read here, create your account today and start earning FREE STEEM!
If you enjoyed what you read here, create your account today and start earning FREE STEEM!
হ্যালো মুরগি ভাই।
আপনি নিজস্ব লেখা ব্যতীত অন্যের সামগ্রী এখানে শেয়ার করতে পারবেন না।
আপনার পোস্টের লেখাগুলো শতভাগই চৌর্যবৃত্তি করা।
এ ধরনের post আমাদের কমিটিতে রাখা হয় না। নতুন ইউজার হওয়ার কারণে শুধুমাত্র আপনার পোস্ট Mute করা হচ্ছে। পরবর্তীতে আবার একই ধরনের কাজ করলে আপনার একাউন্ট কমিউনিটি থেকে ব্যান করা হবে।
কমিউনিটির নিয়মাবলী ভালোভাবে পড়ে নিন
https://steemit.com/hive-129948/@rme/last-updated-rules-of-amar-bangla-blog-community-29-sep-21
যে কোন বিষয়ে জানার প্রয়োজন হলে আমাদের সাথে Discord এ যোগাযোগ করুন।
Discord server link: https://discord.gg/ettSreN493
Source: https://hi-in.facebook.com/Valobas4u/posts/1393168394437957
আশ্চর্য_ঝোলা
লেখা: মিনা শারমিন
Downvoting a post can decrease pending rewards and make it less visible. Common reasons:
Submit