প্রিয় আমার বাংলা ব্লগের বন্ধুরা,
সমস্ত ভারতবাসী এবং বাংলাদেশের বাঙালি সহযাত্রীদের আমার আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন।
আশা করি আপনারা ঈশ্বরের কৃপায় সুস্থ আছেন, সব দিক থেকে ভালোও আছেন। আপনাদের সবার ভালো থাকা কামনা করে শুরু করছি আজকের ব্লগ।
কিছুদিন আগেই আপনাদের সাথে গল্প করছিলাম আমার গ্রীষ্মকালীন পুরী ভ্রমণের। পুরী ভ্রমণ মানেই জগন্নাথ মন্দির দর্শন একটি প্রধান ও বিশেষ অঙ্গ। তালপাতার বাক্সে মোড়া জগন্নাথের প্রসাদ সাথে হলুদ রঙের ডুরি ছাড়া পুরী ভ্রমণ অসম্পূর্ণ।
যেদিন আমরা পড়িতে পৌঁছেছিলাম সেদিন মন্দির দর্শনে যেতে পারিনি। পরের দিন সকাল বেলায় আমাদের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ভোটের প্রচারে নীলাচল এসেছিলেন যে কারণে রাস্তাঘাট সবকিছু বন্ধ ছিল এবং মন্দিরও সাধারণ মানুষের জন্য বন্ধ। তাই দুপুরবেলায় আমরা একটা অটো ভাড়া করে লোকাল সাইট সিন করলাম। আর সন্ধ্যেবেলায় চলে গেলাম মন্দির দর্শন করতে। এই সাইট সিন হিসেবে সাধারণ লোকজন জগন্নাথের মাসির বাড়ি মামার বাড়ি এইসবই দেখেন কিন্তু আমি ঠিক করেছিলাম এগুলো তো সবাই দেখেছে তো একটু অন্যরকম কিছু যদি দেখা যায়। বন্ধুর থেকে সাহায্য নিয়ে প্ল্যান বানিয়ে ফেললাম। গিয়েছিলাম, গম্ভীরা, সেই জায়গা যেখানে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু প্রায় আঠেরো বছর ধরে সাধনা করেছিলেন, হরিদাস ঠাকুরের সমাধি ক্ষেত্র, ইসকন মন্দির, সিদ্ধবকুল মঠ, টোটো গোপীনাথ। এইসব সেরে পৌঁছে গিয়েছিলাম জগন্নাথ মন্দিরে। আমরা জগন্নাথ মন্দিরের সামনে থেকে ঢুকতে পারিনি। পেছনের দিকে একটা গেটের সামনে আমাদের রাস্তা শেষ হয়েছিল। সেখানেও ঢোকা যায় সেখানে জুতো মোবাইল রাখার জন্য কাউন্টার রয়েছে। তবে আশ্চর্যের বিষয় এই সমস্ত গেট দিয়ে দর্শনার্থীরা স্বাভাবিকভাবে ঢুকতে পারে না। স্বাভাবিক মানে লাইন দিয়ে সরাসরি ঢুকতে পারেনা। মন্দিরের পন্ডা অর্থাৎ দালাল রয়েছে তাদেরকে মাথাপিছু একশ' টাকা করে দিলে, তারা ঢুকিয়ে দেয়।
মন্দিরের ভেতরে কোনরকম ইলেকট্রনিক ডিভাইস নিয়ে ঢোকা যায় না। সেটা কি কারণে আমার ঠিক জানা নেই তবে আমার ধারণা কোন ইলেক্ট্রো ম্যাগনেটিক পাওয়ার আছে। যে কারণে আমার এমন ধারণা হয়েছে সে কারণটি আমি ধীরে ধীরে বলবো। অবশ্যই এটা আমার কোন অন্ধ বিশ্বাস নয় তবে এই ধারণাটুকু আমার হয়েছে। মন্দিরের ভেতরে যেহেতু মোবাইল বা ক্যামেরা নিয়ে ঢোকার অনুমতি নেই তাই ভেতরের বিভিন্ন অংশ যেমন ভোজনশালা শ্মশান ইত্যাদির কোন ছবি আমার কাছে নেই।
তো যে কথা বলছিলাম, মন্দিরের এক পন্ডাকে ধরলাম এবং মাথাপিছু একশ' টাকা করে দিয়ে আমরা সবাই ঢুকে গেলাম। মন্দিরের ভেতরের পন্ডা আমাদের অন্য একটি গেট দিয়ে ঢুকিয়েছিলেন। এই মুহূর্তে ঠাকুরের ভোগারতি হচ্ছিল তাই সামনের গেটটি বন্ধ ছিল। আমরা যখন ঢুকেছিলাম তখন দেশে কি মারাত্মক ভিড় বলে বোঝানো যাবে না। আমাদের সবার বাবা মায়েরা ছিল প্রত্যেকেই বয়স্ক। এই ভিড়ের মধ্যে ঠাকুর দর্শন করা খুবই কঠিন হয়েছিল। আমরা দাঁড়িয়ে ছিলাম অপেক্ষা করছিলাম যাতে দর্শন করতে পারি। ভোগারতি শেষ হওয়ার পর মানুষের ভিড় উপচে পড়ে, ওই ঠেলাঠেলি গুঁতোগুঁতির মধ্যে যেতে পারিনি বেশ কিছু সময় পর আমরা জনস্রোতে দাঁড়িয়ে গিয়েছিলাম। নিজের পা চালাতে হয়নি শুধু ব্যালেন্স করে দাঁড়িয়ে থাকা। ধাক্কাধাক্কিতে অবশেষে পৌঁছে গেলাম দারুব্রহ্মের মুখোমুখি। কোন রকমে দেখেই বাইরে বেরিয়ে আসি। মন্দিরে গেলে যে আমি বিশেষ কিছু চাই বা মানত করি সেরকমটা না। বিগ্রহ গুলো দেখতে আমার অপূর্ব লাগে। মনে হয় শিল্পের ভেতর ঈশ্বর জেগে আছে৷ আর শিল্পীই তার দারুন নিঁখুত হাতে ঈশ্বরকে জাগিয়ে তুলেছেন। আমি সর্বদাই দেখেছি যে কোন ঈশ্বরের বিগ্রহের সামনে দাঁড়িয়ে ঈশ্বর হাসছেন। আহা কি যে অপূর্ব লাগে দেখতে আপনাদের বলে বোঝাতে পারবো না।
মন্দির দর্শন হয়ে গেলে আমরা অন্য একটি সিঁড়ি দিয়ে নামি। জগন্নাথ মন্দিরের যে প্রধান দরজা সেখান থেকে দর্শনার্থীরা উঠে বিগ্রহ দর্শন করলেও সেই একই সিঁড়ি দিয়ে নেমে যান না। মন্দিরের মুখ্য দরজায় এই বাইশটি সিঁড়ি যোগদর্শনের বাইশটি তত্ত্ব। প্রথম পাঁচটি সিঁড়ি চক্ষু, কর্ণ , নাসিকা, জিহ্বা ও ত্বক- পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের প্রতীক। পরবর্তী পাঁচটি সিঁড়ি রূপ, রস, গন্ধ, শব্দ ও স্পর্শ পাঁচ প্রাণের প্রতীক। পরের পাঁচটি সিঁড়ি ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ ও ব্যোমের প্রতীক। শেষ দুটি সিঁড়ি মানুষের বুদ্ধি ও অহংকারের প্রতীক।
তবে যেহেতু এটি মন্দির এর সম্পর্কে রয়েছে নানান মিথ। সেরকমই এক মিথের কারণে ওই বাইশটা সিঁড়ির তিন নম্বর সিঁড়িতে পা দিয়ে উঠলেও নামার সময় কেউ পা রাখেনা। সে কারণেই অন্যান্য দরজা দিয়ে বেরিয়ে যাওয়াটাই সহজ হয় সবার কাছে৷
এরপর আমরা সোজা চলে যাই ভোজনালয়ে। প্রচুর লোকজন সেখানে জগন্নাথের প্রসাদ নিয়ে বসে রয়েছেন এবং সবাইকে খাওয়াচ্ছেন। সেই প্রসাদ সবাই হাসিমুখে পেট ভরে খেয়ে থেকে যাচ্ছে। প্রসাদ তো আমি নেবই কিন্তু তার আগে আমার উদ্দেশ্য ছিল এই মন্দিরের এক পাশে ভোজনালয়ে পেরিয়ে গিয়ে দেখে নেওয়া শ্মশানটি। মন্দিরের ভেতরে শ্মশানে এটি কি কম আশ্চর্য নয়? আসলে জগন্নাথ দেবের মূর্তিটি মহানিম কাঠের তৈরি। এই বিগ্রহটি প্রতি আট, বারো বা উনিশ বছর অন্তর বদলে দেওয়া হয়। তখন একটি বিশেষ আচার পালন করা হয় এবং পুরনো যে কাঠের বিগ্রহটি সেটি এই শ্মশানে দাফন করা হয়। দাফনেরও একটি নির্দিষ্ট নিয়ম রয়েছে। স্বপ্নে দাঁড়িয়ে যে সমস্ত কথা বিস্তারিতভাবেই শুনেছি। সেসব নিয়ে লিখতে গেলে আরো একটি ব্লগ লাগবে তো পরে অন্য একদিন লিখব।
এইসব সেরে আমরা হোটেলে চলে আসি। আমাদের টোটো ভাড়া করতে হয়েছিল। সেকি বিস্তর দরাদরি। আসলে মন্দির যেখানে সেখানে ব্যবসা তো থাকবেই। জানি মানুষ দর কষাকষি করবে না তো মুনাফা যতটা খুশি লুটে নেওয়া যায়। পরের দিন সকাল বেলায় আমাদের সবারই মনে ছিল যে আরেকবার যাই দিনের আলোয় মন্দিরটি কেমন দেখতে সেটা দেখে আসব। সেই হিসেবে সকাল সকাল আমরা প্রাতঃরাশ সেরে টুকটুক করে হেঁটে বেরিয়ে পড়েছিলাম। মন্দির সামনে অনেক কেনাকাটার জন্য দোকান রয়েছে। সেখানে আমার মায়েরা টুকটাক জিনিসপত্র কেনাকাটা করল। তারপর হোটেলে ফিরে চলে আসি এবং আসার পরেও আমরা টুকটাক বাজার করতেই থাকি। বাজার করলাম সেই নিয়ে নয় আরেকদিন ব্লগ করব।
বন্ধুরা আমার এই জগন্নাথ মন্দির দর্শনের গল্প আপনাদের সাথে ভাগ করে নিলাম। কেমন লাগলো জানাবেন। সর্বোপরি বলব জগন্নাথ মন্দির নিয়ে গল্প এবং মিথ এবং বিশ্বাসের কোন শেষ নেই। এমন কিছু ঘটনা ঘটে থাকে যার পেছনে কোন বিজ্ঞান নেই অথচ ঘটে। জানেন মন্দিরের এই যে পতাকাটা দেখছেন এই পতাকাটা সবসময়ই বাতাসের গতির বিপরীতে উড়তে থাকে। কোনটা কখনো শুনেছেন নাকি কখনো সম্ভব কিন্তু এখানেই ঘটে। আবার জানেন পাখিরা তো আকাশ দিয়ে ওড়ে, ঈগলের কথাই বলুন কত উঁচু দিয়ে ওড়ে, মন্দিরের মাথা দিয়ে একটি পাখি উড়ে না এমনকি ঈগলও না। শুধু পাখি কেন একটি এরোপ্লেন বা হেলিকপ্টার উড়তে দেখা যায় না। এরকম আরো অনেক কিছুই ঘটনা রয়েছে এখানে, যা বিজ্ঞানসম্মত নয় কিন্তু ঘটে। কেন ঘটে তার উত্তর আজ পর্যন্ত কেউ জেনে উঠতে পারেনি। আবার অবাক বিষয় কি জানেন, এই জগন্নাথ মন্দিরের সবথেকে উল্লেখযোগ্য নাম শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু। যিনি আঠেরো বছর ধরে এখানেই সাধনা করেছেন অথচ এই মন্দিরে এসে ভেতরে ঢুকে বিগ্রহের দর্শন করেছেন মাত্র দুবার। কি আশ্চর্য তাই না? শ্রী চৈতন্য মহাপ্রভুকে নিয়ে আরেকদিন গল্প বলব তখন কথাগুলো বিস্তারিত আলোচনা করব।
আসলে জগন্নাথ মন্দির এবং পরী নিয়ে বলতে শুরু করলে কথা যেন ফুরোয় না। তাও আজকের লেখা এখানেই শেষ করছি। আপনারা খুব ভালো থাকবেন। আবার কালকে আসব অন্য একটি লেখা নিয়ে।
টাটা
পোস্টের ধরণ | ভ্রমণকথা |
---|---|
ছবিওয়ালা | নীলম সামন্ত |
মাধ্যম | আইফোন ১৪ |
লোকেশন | নীলাচল, পুরী, উড়িষ্যা, ভারতবর্ষ |
ব্যবহৃত অ্যাপ | ক্যানভা, অনুলিখন, ইনশট |
৫% বেনেফিশিয়ারি এবিবি স্কুলকে এবং ১০% বেনেফিশিয়ারি লাজুকখ্যাঁককে
~লেখক পরিচিতি~
আমি নীলম সামন্ত। বেশ কিছু বছর কবিতা যাপনের পর মুক্তগদ্য, মুক্তপদ্য, পত্রসাহিত্য ইত্যাদিতে মনোনিবেশ করেছি৷ বর্তমানে 'কবিতার আলো' নামক ট্যাবলয়েডের ব্লগজিন ও প্রিন্টেড উভয় জায়গাতেই সহসম্পাদনার কাজে নিজের শাখা-প্রশাখা মেলে ধরেছি। কিছু গবেষণাধর্মী প্রবন্ধেরও কাজ করছি। পশ্চিমবঙ্গের নানান লিটিল ম্যাগাজিনে লিখে কবিতা জীবন এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি৷ ভারতবর্ষের পুনে-তে থাকি৷ যেখানে বাংলার কোন ছোঁয়াই নেই৷ তাও মনে প্রাণে বাংলাকে ধরে আনন্দেই বাঁচি৷ আমার প্রকাশিত একক কাব্যগ্রন্থ হল মোমবাতির কার্ণিশ ও ইক্যুয়াল টু অ্যাপল আর প্রকাশিতব্য গদ্য সিরিজ জোনাক সভ্যতা।
কমিউনিটি : আমার বাংলা ব্লগ
আমার বাংলা ব্লগ পরিবারের সব্বাইকে আমার আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন৷ ভালো থাকুন বন্ধুরা। সৃষ্টিতে থাকুন।
Upvoted! Thank you for supporting witness @jswit.
Downvoting a post can decrease pending rewards and make it less visible. Common reasons:
Submit