ভারতের একটি আশ্চর্য - কোনারকের সূর্য মন্দির|| ঐতিহাসিক স্থাপত্য সংক্রান্ত পোস্ট||

in hive-129948 •  6 months ago  (edited)

প্রিয় আমার বাংলা ব্লগের বন্ধুরা,


সমস্ত ভারতবাসী এবং বাংলাদেশের বাঙালি সহযাত্রীদের আমার আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন।


1000222602.jpg








আশা করি আপনারা ঈশ্বরের কৃপায় সুস্থ আছেন, সব দিক থেকে ভালোও আছেন। আপনাদের সবার ভালো থাকা কামনা করে শুরু করছি আজকের ব্লগ।



পৃথিবীতে যেমন সপ্তম আশ্চর্য রয়েছে ঠিক তেমনি ভাবেই ভারতবর্ষে ও সপ্তম আশ্চর্য রয়েছে। আমার অনেক দিনের ইচ্ছে ছিল ভারতবর্ষের সপ্তম আশ্চর্য ঘুরে দেখবার৷ কিন্তু সবগুলো হয়ে ওঠেনি যে কটা হয়েছে সেগুলোই এক এক করে আপনাদের কাছে তুলে ধরার পরিকল্পনা করেছি।

প্রথমেই বলি, প্রত্যেকটি আশ্চর্যই আসলে আশ্চর্যজনকভাবে সুন্দর এবং বৈজ্ঞানিকভাবে নির্মিত ইতিহাস সম্পন্ন এক একটি অসাধারণ স্থাপত্য। বিগত দু'টি পোস্টে আমি যেহেতু পুরীর কথা বলেছি এবং আপনারা জানেন আমি এবছর গ্রীষ্মকালের ছুটিতে পুরী বেড়াতে গিয়েছিলাম তাই কোনারকের সূর্য মন্দির সম্পর্কে অনেকটাই বিস্তৃত ইতিহাস সংগ্রহ করে এনেছি। আজ সেগুলোই আপনাদের কাছে তুলে ধরবো।

প্রথমে একটু বলে রাখি এই ইতিহাস আমি কিভাবে জানলাম, সূর্য মন্দিরে ঢোকার আগেই একটা বড় মিউজিয়ামের মত রয়েছে সেখানে সিনেমা হলের মত ভিডিও ক্লিপিং দেখানো হয়েছিল। সেই ভিডিও ক্লিপিং সেই কোনারকের সূর্য মন্দির তৈরি নানান ইতিহাস দেখানো হয়েছে। আমি সেখান থেকেও জেনেছি এবং কয়েকটি বই পড়েও কিছু তথ্য সংগ্রহ করেছি। সবটা তো আর একটা ব্লগে লেখা সম্ভব নয় তাই চেষ্টা করছি যতটা সম্ভব গুছিয়ে আপনাদের কাছে পরিবেশন করা যায় ।

1000222499.jpg

কোনা শব্দটির অর্থই হলো সূর্য, সে কারণেই জায়গাটির নামও কোনারক এবং মন্দিরটি কেউ অনেকে কোনারক মন্দির বলে। ভারতবর্ষে কিন্তু সূর্য দেবতার মূর্তিপূজোর কোনো প্রচলন ছিল না। খ্রিস্টীয় প্রথম শতাব্দীর কাছাকাছি কোন একটা সময়ে পারস্য থেকে মিত্রপূজক মগ নামধারী এক জাতি বলা যায় পুরোহিতের দল ভারতবর্ষে আসে। সম্ভবত কোন এক রাজার আহ্বানই তারা এসেছিল এবং চন্দ্রভাগা নদীর তীরে প্রথম সূর্য মন্দির স্থাপন করেন। এভাবেই শুরু হয় ভারতবর্ষে সূর্য দেবতার মূর্তি পুজো।

1000222475.jpg

কোনারকের সূর্য মন্দির তৈরি নিয়ে বেশ কয়েকটি কিংবদন্তি রয়েছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল, গঙ্গাবংশীয় রাজা নরসিংহ দেব তার রাজত্বকালে রাজনৈতিক আধিপত্যের রাজকীয় ঘোষণা হিসেবে এই সূর্য মন্দির টি নির্মাণ করেন। ওই ভিডিওতে একটা অ্যানিমেশন এর মধ্যে দেখানো হয়েছিল, বারোশ' কারিগরের একটি দল বারো বছর সময় ধরে তাদের এবং শৈল্পিক প্রতিভার মাধ্যমে স্থাপত্য চিন্তাভাবনাকে বাস্তবায়িত করে এই মন্দিরটি নির্মাণ করেন। তবে মন্দিরটি প্রায় সম্পূর্ণ হয়ে গেলেও সেই স্থানে এসে আটকে যায়। যে ধাপটি তারা কোনভাবেই সম্পন্ন করতে পারছিলেন না, এদিকে রাজা নির্দেশ দেন যে করেই হোক একটা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সেই মন্দিরটিকে বানিয়ে শেষ করতে হবে। লোকশ্রুতি অনুযায়ী এই মন্দিরের প্রধান স্থপতি ছিলেন বিশু মহারানা। আবার অনেকে বলে থাকেন শিবাই শান্তরা।

1000222487.jpg

যাই হোক সেই শেষ ধাপ অর্থাৎ মন্দিরের মাথায় একটি গোল চাকতির মত অংশ কিছুতেই বসাতে পারছিলেন না। অনেক চিন্তা ভাবনা করেও যখন এ কাজ সম্পন্ন হচ্ছিল না তখন বিশু মহারানার ছেলে ধর্মপদ তার বাবাকে বারো বছর ধরে দেখতে না পেয়ে খুঁজতে খুঁজতে এসে পৌঁছন এই স্থাপত্য নির্মাণের স্থানে৷ ধর্মপদ সেই যুগে তুখোড় অংকবিদ ছিল। সবকিছু হিসাব নিকাশ করে সে এই মস্তকটি মন্দিরের ওপর বসিয়ে দেয় সঠিকভাবে। কিন্তু রাজার নির্দেশ ছিল যে ওই বারোশ' কর্মীই এই মন্দিরটিকে সম্পন্ন করবেন। বারোশো এর বেশি একজন লেগেছে তাই রাজার রোষানাল থেকে বাকিদের উদ্ধার করার কথা ভেবে ধর্ম পথ আত্মহত্যা করে। এবং তার দেহটি পাওয়া যায় মন্দিরের পাশেই সমুদ্র সৈকত থেকে। গল্পে দেখিয়েছিল ধর্মপদ রাত্রিবেলায় মন্দিরের ওপর থেকে ঝাঁপ দিয়ে দিয়েছিল। আর পরের দিনই ছিল মন্দিরের অভিষেক। এই মৃত্যুটির কারণে সূর্য মন্দিরটি তার পবিত্রতা হারাই বলেই বিশ্বাস করা হয়। আর সে কারণেই অভিষেকও হয় না আর ওই মন্দিরে কোনদিন পূজা পাঠ হয় না। বর্তমানেও মন্দিরটি বন্ধ রয়েছে।

1000171383.jpg

এই মন্দিরটি নির্মাণের উল্লেখ নানান ইতিহাসবিদদের লেখায় পাওয়া যায়। যেমন মাদলা পাঁজি অনুসারে প্রথম নরসিংহ দেব নিজের রাজত্বের অষ্টাদশ বর্ষে মন্দিরটি নির্মাণ করেন, আবার ভিনসেন্ট স্মিথ কোনারক মন্দির নির্মাণকাল ১২৮০ খ্রিস্টাব্দ বলে উল্লেখ করেছিলেন। গঙ্গবংশীয় রাজগণের তাম্রলিপি থেকে জানা যায় প্রথম নরসিংহ দেব কোনারকের মন্দির নির্মাণ করেন। আবুল ফজলের আইন-ই- আকবর গ্রন্থে সূর্য মন্দির নির্মাণ প্রসঙ্গে রাজা প্রথম নরসিংহ দেবের নামই উল্লেখ আছে। এছাড়াও আরো অনেক ভাবেই কোনারকে সূর্য মন্দির নির্মাণ সম্পর্কে নানান তথ্য পাওয়া যায়।

1000171385.jpg

কোনারকের মন্দিরটি যেহেতু সূর্য দেবতাকে উৎসর্গ করে বানানো হয়েছিল বা সূর্য দেবতার পূজো করার কারণে বানানো হয়েছিল তাই মন্দিরটি আসলে দেখতে সূর্য দেবতার রথ। চারপাশে পাথর খোদাই করা ১২ জোড়া চাকা রথটিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে সাতটি ঘোড়া। এই চাকা গুলি আসলে বারটি মাস সহ চব্বিশটি পক্ষ'র অর্থ বহন করে। এবং সাতটি ঘোড়া অর্থ সপ্তাহের সাত দিন। বারোটি চাকার ভেতর আটটি বড় বড় স্পোক রয়েছে যা আসলেই দিনের আট প্রহরের অর্থ বহন করে। আসলে প্রতিটি চাকায় এক একটি সূর্য ঘড়ির রেপ্লিকা বলে ভাবা হয়৷ এই চাকাটির ছবি ভারতীয় দশ টাকার নোটে দেখতে পাওয়া যায়।

1000222481.jpg

মন্দিরের দেওয়ালে অনেক মূর্তি শৈলী নির্মাণ রয়েছে। নানান দেবদেবীর মূর্তি সহ, দৈনন্দিন নশ্বর জীবনের চিত্র, নানান পশু পাখির চিত্র খোদাই করা আছে৷ মন্দিরের শিখরার উপর তন্ত্র ঐতিহ্যের কামুক ভাস্কর্যও খোদাই করা আছে।

সূর্য দেবতার মূর্তি সম্পর্কে একটি কথা শোনা যায়, ওইযে মাথার ওপর মস্তকটি বা চাকতির মতো অংশটি যেটি ধর্মপদ বসিয়েছিল সেইটি বসানোর পরেই সূর্য মূর্তিটি মাটি থেকে অর্থাৎ ভূমি থেকে খানিকটা উপরে উঠে ভাসমান হয়। সূর্য যে আকাশে ভাসে এটি তারই প্রমাণস্বরূপ প্রতিচ্ছবি। তবে এখানে কোন কুসংস্কার বা গল্পকথা নেই এটি একেবারেই বিজ্ঞানভিত্তিক ভাবে চুম্বকের ব্যবহার। কারণ বহু পরে যখন ওই সমুদ্র দিয়ে বৈদেশিক জাহাজ যেত তখন শোনা যায় ওই জাহাজগুলি এই মন্দিরটিকে কিছুতেই পেরিয়ে যেতে পারত না। কারণ তার প্রবল চুম্বকীয় শক্তি টেনে রাখত মন্দিরের দিকে। বর্তমানে অবশ্য সূর্যমূর্তিতে নেই তাই চুম্বকীয় শক্তিটিও নেই।

1000222493.jpg

যা ভারতবর্ষের সপ্তম আশ্চর্যের এক আশ্চর্য তার সম্পর্কে কখনোই একটা ব্লগে লিখে শেষ করা যায় না। যেখানে এই বিষয় নিয়ে বইয়ের পর বই লেখা হয়েছে। আমি খুব সামান্যই তথ্য দিলাম। আবার যদি কখনো এই মন্দির সম্পর্কে লিখি তখন আরো অনেক গল্পের ছলে মন্দিরের ভেতরের নির্মাণশৈলী ও বিজ্ঞান সম্পর্কে আপনাদের বলবো। এই মন্দির একদিন অনেক খারাপ ভাবে ধ্বংসস্তূপ হয়ে যাচ্ছিল কিন্তু ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজের আওতায় আসার পর এর নির্মাণ কাজ শুরু হয় এবং বর্তমানে বেশ ভালো অবস্থায় দাঁড়িয়ে রয়েছে। শোনা যায় কিছু বছরের মধ্যেই মন্দিরটি খোলা হবে।

ব্লগটি শেষ করার আগে বলি কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই সূর্য মন্দির সম্পর্কে লিখে গেছেন,

এখানে পাথরের ভাষা মানুষের ভাষাকে ছাড়িয়ে গেছে।

মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের চতুর্থ পুত্র বলেন্দ্রনাথ ঠাকুর তার 'কণারক' নামক প্রবন্ধে বলেছেন,

কণারকে এখন দেবতা নাই - এ কথা বলা ঘাটে না। কিন্তু সমস্ত প্রান্তর জড়িয়ে সেখানে এক নিঃশ্চল বৈরাগ্য বাসা বাঁধিয়েছে। তাহার মুখে কেবল হায় হায়। বৈান্তিক মায়াবাদীর মতো সে শুধু বলিতেছে, — জীবন অনিত্য, যৌবন অনিত্য, ধন জন অনিত্য, সুখ অনিত্য, সংসার অনিত্য,সকলি যেখানে অনিত্য ও মায়া, সেখানে দেবালয়ে হে বিলম্ব না কেন? দ্বাদশ বৎসরের দুর্ভিক্ষ দিয়া এই পাষাণ স্তূপ রচনা করিয়া কি ফল? দেশ কাল ত সাগর বক্ষে একটা ক্ষণিক বুদবুদ মাত্র ; হায়, মায়াহত, তুমি জানিয়া শুনিয়াও ইহা বুঝিলে না!

এছাড়া স্বামী বিবেকানন্দ সহ অনেক দেশী-বিদেশী জ্ঞানী মানুষেরও উক্তি রয়েছে। পরে কখনও আবার লিখব। আজ এ পর্যন্তই থাক। আগামীকাল আসব অন্য একটি নতুন ব্লগ নিয়ে। ততক্ষণ আপনারা ভালো থাকুন সুস্থ থাকুন।

টাটা

1000205476.png


1000216462.png

পোস্টের ধরণঐতিহাসিক স্থাপত্য সংক্রান্ত পোস্ট
ছবিওয়ালানীলম সামন্ত
মাধ্যমস্যামসাং এফ৫৪
লোকেশনকোনারক, উড়িষ্যা(https://what3words.com/sidelined.vipers.courtyard)
ব্যবহৃত অ্যাপক্যানভা, অনুলিখন
তথ্যসূত্রকোনারকের বিবরণ, নির্মলকুমার বসু


1000217107.jpg


৫% বেনেফিশিয়ারি এবিবি স্কুলকে এবং ১০% বেনেফিশিয়ারি লাজুকখ্যাঁককে


1000217198.png


~লেখক পরিচিতি~

1000162998.jpg

আমি নীলম সামন্ত। বেশ কিছু বছর কবিতা যাপনের পর মুক্তগদ্য, মুক্তপদ্য, পত্রসাহিত্য ইত্যাদিতে মনোনিবেশ করেছি৷ বর্তমানে 'কবিতার আলো' নামক ট্যাবলয়েডের ব্লগজিন ও প্রিন্টেড উভয় জায়গাতেই সহসম্পাদনার কাজে নিজের শাখা-প্রশাখা মেলে ধরেছি। কিছু গবেষণাধর্মী প্রবন্ধেরও কাজ করছি। পশ্চিমবঙ্গের নানান লিটিল ম্যাগাজিনে লিখে কবিতা জীবন এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি৷ ভারতবর্ষের পুনে-তে থাকি৷ যেখানে বাংলার কোন ছোঁয়াই নেই৷ তাও মনে প্রাণে বাংলাকে ধরে আনন্দেই বাঁচি৷ আমার প্রকাশিত একক কাব্যগ্রন্থ হল মোমবাতির কার্ণিশইক্যুয়াল টু অ্যাপল আর প্রকাশিতব্য গদ্য সিরিজ জোনাক সভ্যতা



কমিউনিটি : আমার বাংলা ব্লগ

আমার বাংলা ব্লগ পরিবারের সব্বাইকে আমার আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন৷ ভালো থাকুন বন্ধুরা। সৃষ্টিতে থাকুন।

🌾🌾🌾🌾🌾🌾🌾🌾


1000205458.png

1000205505.png

Authors get paid when people like you upvote their post.
If you enjoyed what you read here, create your account today and start earning FREE STEEM!
Sort Order:  

Upvoted! Thank you for supporting witness @jswit.

মাস তিনেক আগে আমার বাবা মা গিয়েছিলেন পুরী এবং এই সূর্যমন্দিরে। ফেরার পর বাবা -মায়ের থেকেও কিছু কিছু শুনেছি। আজ আপনার এমন তথ্যবহুল পোস্ট টি পড়ে আরো বিশদ জানতে পারলাম। জাহাজের বিষয় টি বাবার থেকেও শুনেছিলাম। আর ছবি গুলোও বেশ দারুণ হয়েছে। এই মন্দির সম্পর্কে আরোও লিখবেন দিদি... আমাদের জন্য।

আপনিও ঘুরে যান৷ খুব ভালো লাগবে৷ পুরীর সমুদ্র সৈকত আর তার চারপাশের নানান স্থাপত্য ইতিহাস মন ভরে যায়৷ তবে আপনাদের জন্য আমি লিখব৷ আপনার মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ ও ভালোবাসা জানাই।