পেশওয়াদের বাড়ি শনিওয়ার ওয়াড়াতে কাটানো কিছু সময়|| ঐতিহাসিক জায়গায় ভ্রমণের অভিজ্ঞতা ||

in hive-129948 •  5 months ago  (edited)

প্রিয় আমার বাংলা ব্লগের বন্ধুরা,


সমস্ত ভারতবাসী এবং বাংলাদেশের বাঙালি সহযাত্রীদের আমার আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন।


1000230057.jpg








আশা করি আপনারা ঈশ্বরের কৃপায় সুস্থ আছেন, সব দিক থেকে ভালোও আছেন। আপনাদের সবার ভালো থাকা কামনা করে শুরু করছি আজকের ব্লগ।



1000230110.png

শনিওয়ার ওয়াড়ার প্রধান দরজা

মহারাষ্ট্র মানেই মারাঠাদের সাম্রাজ্য। অবিভক্ত ভারতবর্ষের শক্তিশালী যেকটি রাজা ছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম মারাঠারা। ছত্রপতি শিবাজী মহারাজের হাত ধরে এই মারাঠা সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। তিনি খুব অল্প বয়সে মারা গেলেও তাঁর কর্মকাণ্ড এবং তার কৃতিত্ব আজও তাকে অমর করে রেখেছে। বর্তমান মারাঠা অঞ্চলগুলোতে অর্থাৎ মহারাষ্ট্রে আজও তিনি ঈশ্বরের সমতুল্য হিসেবে পুজিত হন। খ্রিস্টীয় সপ্তদশ শতাব্দী থেকে উনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধ পর্যন্ত মারাঠা সাম্রাজ্যের বিস্তার অবিভক্ত ভারতবর্ষের প্রায় সিংহভাগ জুড়ে। মুঘলরা অনেক ছলা-কলা করেও তাদের পরাস্ত করতে পারেননি আবার ব্রিটিশদের কাছেও যে খুব সহজে ধরা দিয়েছিলেন তা নয়। মারাঠাদের সব থেকে চর্চিত বিষয় হলো তাদের ছেলেদের পাশাপাশি মেয়েদের শক্তির কথা। এখানে মেয়েরাও যুদ্ধ করতে কখনো পিছপা হননি।

1000230059.jpg

সুরক্ষার খাতিরে দরজায় লাগানো বল্লমের মুখ

১৭০০ থেকে ১৭৪০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত এই মারাঠা সাম্রাজ্যেরই প্রধানমন্ত্রী পেশওয়া বাজি রাও (প্রথম) পুনে অঞ্চলের কসবাপেটের মুথা নদীর তীরে তৈরি করেন এই দুর্গটি। কোন বিশেষ শখ আহ্লাদ পূরণের জন্য নয়, এই দুর্গে তারা বসবাস করত এবং তাঁর জন্য নির্ধারিত অঞ্চল দেখভাল করাই তাঁদের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল। এই দুর্গের নাম হল শনিওয়ার ওয়াড়া। ১৭৩০ সালের ১০-ই জানুয়ারী শনিবার এই দূর্গের ভিত্তি স্থাপন হয়েছিল বলেই এর নাম শনিওয়ার৷ ওয়াড়া শব্দের অর্থ হল দুর্গ৷

1000230060.png

প্রধান দরজার পেছনের দিক

মহারাষ্ট্রের নানান দুর্গ গুলোর মধ্যে এই দুর্গটি অবশ্যই উল্লেখযোগ্য। বাজি রাও অত্যন্ত নামকরা প্রধানমন্ত্রী। যাঁকে নিয়ে বর্তমান ভারতীয় ফিল্ম ইণ্ডাষ্ট্রিতেও নানান সিনেমা হয়েছে৷ উল্লেখযোগ্য হল বাজি রাও মস্তানি৷

আমার পরিবার সমেত সেখানে গিয়ে উপস্থিত হয়েছিলাম গত শনিবার। যদিও কাকতালীয় ভাবেই শনিবার শনিওয়ার ওয়াড়া ভ্রমণ হয়েছে৷ গিয়ে যা বুঝলাম সেই মুথা নদীর তীর বা পেশওয়াদের গমগমে পদচারণের লেস মাত্র নেই। কংক্রিটের ঘিঞ্জি পরিবেশের মধ্যে হাজার হাজার অত্যাধুনিক গাড়ি ঘোড়ার আওয়াজের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে শনিওয়ার ওয়াড়ার টিকে থাকা পরিখা। মাত্র কয়েকশ' বছরেই ভেঙে গেল দুর্গ! কেন? ১৮২৮ খ্রীস্টাব্দের এক হঠাৎ অগ্নিকাণ্ডে দুর্গটি নিজেই ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল, তবে টিকে থাকা কাঠামোগুলি এখন একটি পর্যটন স্থান হিসাবে রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়েছে। মারাঠা সাম্রাজ্যের অন্তর্গত বিশিষ্ট রাজভবন যেহেতু শনিওয়ার ওয়াড়া তাই এই দুর্গের ভিত্তি পাথর দিয়ে নির্মিত হয়েছিল৷ বাকিটাও হত কিন্তু বাধ সাধল সাতারার রাজা শাহু৷ অগত্যা ইট দিয়ে বাকি সাততলা নির্মাণ হয়েছিল। ইটের বাড়ি আর কতদিন টিকতে পারে। ঠিক যে কারণে বালি পাথরের রাজমহল হওয়ার সুবাদে রাজস্থানের প্যালেসগুলো আজও সুন্দর অবস্থায় দাঁড়িয়ে রয়েছে। তবে মারাঠি সাম্রাজ্যের রায়গড় ফোর্ট ছাড়া কোন দুর্গই আজ সেভাবে নেই। কেবলমাত্র ধ্বংসস্তূপ আর ঢোকার বড় দরজাটুকুই টিকে আছে৷

1000228135.jpg

পেশওয়াদের পরিবার

শনিওয়ার ওয়াড়ার চারপাশে উঁচু পরিখা ছাড়া ভেতরের কোন অংশে কিছু নেই। তবে সেই ফাঁকা অংশটিতে ফোয়ারা এবং নানান ধরনের গাছ লাগিয়ে একটা বাগান মতো তৈরি করা রয়েছে। যা পরিখার দোতলা থেকে দেখতে খুবই ভালো লাগে। তবে পাঁচিলের ওপরে ওঠার পর যখন দেখি চারপাশে অত্যাধুনিক গাড়ির ভিড় লোকজন আর পাশেই একটা কলেজ, প্রচুর ছাত্র ছাত্রী, সব মিলিয়ে পেশওয়াদের এই পাথর নির্মিত প্রথমাংশটি ছাড়া আর কিছুই নেই। ভাবতে অবাক লাগে সেই যুগে দীর্ঘ সময় এই দুর্গে লোক বসবাস করত এক সময় তো লোক সংখ্যা প্রায় হাজারের কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছিল।

1000230069.png

দুর্গের ডান দিকের ভগ্নাংশ

তবে পুরো পরিখাটি বেশ বড়ই। আমাদের গোটাটা ঘুরে দেখতে এবং টুকটাক ছবি তুলতে প্রায় ঘন্টা দুয়েক মত লেগেছিল। এই দুর্গটিতে ঢোকার জন্য কুড়ি টাকা করে টিকিট লেগেছে। তবে উল্লেখযোগ্য বিষয় যেটি, পর্যটকদের জন্যই সামান্যতম হলেও নির্মাণ কাজ চলছে আর ভেতরের ও বাইরের অংশটি অত্যন্ত পরিষ্কার ও পরিচ্ছন্ন। ছোট্ট ছোট্ট দুই একটা তোপ রয়েছে ভেতরে। আর একটা তো মাটিতে পোঁতা আছে। এই দুর্গের ভেতরে বা বাইরে কোন খাবার-দাবারের দোকান পাতি নেই, তবে বাইরে দু একটা মারাঠি খাওয়ারের দোকান আছে। সেখানে সমস্ত ধরনের মহারাষ্ট্রিয়ান খাওয়ার পাওয়া যায়। গাড়ি ঘোড়ার এত ভিড় আর ভেতরে খোলামেলা জায়গার অভাবের কারণে গাড়ি রাখার জায়গাও খুব কম। সর্ব সাকুল্যে দশটা গাড়ি ঢুকে গেলে এগার নম্বর বাইক বা অটোকার জায়গা থাকে না। উইকেন্ডে কয়েক ঘণ্টা ঘোরার জন্য একেবারেই আদর্শ।

1000230111.png

দুর্গের বাম দিকের ভগ্নাংশ

আমরা বাঙালি হয়ে বাংলার ইতিহাসটা যতটুকু জেনেছি সবথেকে বেশি জেনেছি মুঘলদের ইতিহাস। কিন্তু মারাঠাদের ইতিহাস এইভাবে জানিনা। প্রথম বাজিরাও মাস্তানি সিনেমাটি দেখে আমি বেশ উৎসুক হয়েছিলাম পেশওয়াদের সম্পর্কে জানতে৷ কারণ তারা শারীরিক এবং মানসিক দুই দিক থেকেই অত্যন্ত শক্তিশালী। মারাঠা সমেত পেশওয়াদের মনের জোর বিশাল। মুঘলরা নানাভাবে চেষ্টা করেছিল মারাঠা সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা শিবাজী মহারাজ কে মেরে ফেলতে। কিন্তু প্রতিবারই তারা ব্যর্থ হয়েছিল। ব্রিটিশদের কাছেও খুব সহজে মাথা নামায়নি। আপনাদের ঝাঁসির রানীর কথা মনে আছে তো? সেই লক্ষ্মীবাঈও কিন্তু মারাঠি। তাদের বুদ্ধির কাছে ব্রিটিশদের জয় পেতে বেশ বেগ পেতে হয়েছিল।

1000230113.png

পরিখায় ওঠার উঁচু উঁচু সিঁড়ি

এই সমস্ত ঐতিহাসিক জায়গাতে গেলে কেমন যেন হারিয়ে যাই। বারবার মনে হয় মানুষ চিরকালই তার সাম্রাজ্য বাঁচাতে, তার সাম্রাজ্য বৃদ্ধি করতে এগিয়ে গেছে। এর মধ্যে কেউ কেউ সাম্যের কথা বলেছে। আবার কতজনই কত অত্যাচারী ছিল। সব মিলিয়েই ইতিহাস যেন আজও জীবন্ত হয়ে থাকে প্রতিটা দুর্গের কোণায় কোণায়।

1000230114.png

পরিখার সামনের দিকে দোতলা থেকে যা দেখা যায়

বন্ধুরা, আজকের ঐতিহাসিক গল্প এবং ঘুরে বাড়ানোর মুহূর্ত ছবি সমেত সবটাই আপনাদের জন্য রাখলাম। কেমন লাগলো অবশ্যই জানাবেন। আমার এই ছোট্ট ব্লগের মধ্যে দিয়ে সংক্ষিপ্ত ইতিহাস তুলে এনে মারাঠা ও পেশওয়া সম্পর্কে আপনাদের কাছে তুলে ধরলাম৷ অনেক কিছুই আমি এখানকার লোকাল লোকজনের কাছ থেকে শুনেছি এবং দেখেওছি। তাছাড়াও টুকটাক ঐতিহাসিক ডকুমেন্টস যা পড়েছি সেখান থেকেও জেনেছি। তবে তাদের রাজ্যপাঠের কাহিনী অনেক। সেই সম্পর্কিত পরে কখনো আপনাদের বলব তখন তাদের বুদ্ধির পরিচয় দেখলে সত্যিই অবাক হয়ে যাবেন।

1000230115.png

দোতলা থেকে পুরো দুর্গের বর্তমান দৃশ্য

আজ এ পর্যন্তই থাক। কেমন লাগলো অবশ্যই জানাবেন। আবার কাল আসবো অন্য কিছু নিয়ে। ততক্ষণ আপনারা ভালো থাকুন সুস্থ থাকুন।

টাটা

1000205476.png


1000216462.png

পোস্টের ধরণঐতিহাসিক জায়গায় ভ্রমণ অভিজ্ঞতা
ছবিওয়ালানীলম সামন্ত
মাধ্যমস্যামসাং এফ৫৪
লোকেশনপুণে,মহারাষ্ট্র
ব্যবহৃত অ্যাপক্যানভা, অনুলিপি


1000216466.jpg


৫% বেনেফিশিয়ারি এবিবি স্কুলকে এবং ১০% বেনেফিশিয়ারি লাজুকখ্যাঁককে


1000192865.png


~লেখক পরিচিতি~

1000162998.jpg

আমি নীলম সামন্ত। বেশ কিছু বছর কবিতা যাপনের পর মুক্তগদ্য, মুক্তপদ্য, পত্রসাহিত্য ইত্যাদিতে মনোনিবেশ করেছি৷ বর্তমানে 'কবিতার আলো' নামক ট্যাবলয়েডের ব্লগজিন ও প্রিন্টেড উভয় জায়গাতেই সহসম্পাদনার কাজে নিজের শাখা-প্রশাখা মেলে ধরেছি। কিছু গবেষণাধর্মী প্রবন্ধেরও কাজ করছি। পশ্চিমবঙ্গের নানান লিটিল ম্যাগাজিনে লিখে কবিতা জীবন এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি৷ ভারতবর্ষের পুনে-তে থাকি৷ যেখানে বাংলার কোন ছোঁয়াই নেই৷ তাও মনে প্রাণে বাংলাকে ধরে আনন্দেই বাঁচি৷ আমার প্রকাশিত একক কাব্যগ্রন্থ হল মোমবাতির কার্ণিশইক্যুয়াল টু অ্যাপল আর প্রকাশিতব্য গদ্য সিরিজ জোনাক সভ্যতা



কমিউনিটি : আমার বাংলা ব্লগ

আমার বাংলা ব্লগ পরিবারের সব্বাইকে আমার আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন৷ ভালো থাকুন বন্ধুরা। সৃষ্টিতে থাকুন।

🌾🌾🌾🌾🌾🌾🌾🌾


1000205458.png

1000205505.png

Authors get paid when people like you upvote their post.
If you enjoyed what you read here, create your account today and start earning FREE STEEM!
Sort Order:  

দারুন জায়গা এবং অসাধারণ পোস্ট। এই সেই পেশোয়া বালাজি বাজিরাও যার পরাক্রম শিবাজীর পরে মারাঠা সাম্রাজ্যকে এক অন্য উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিল। এইসব ঐতিহাসিক জায়গায় দাঁড়ালে যেন অনায়াসে পৌঁছে যাওয়া যায় ফেলে আসা কোন এক শতাব্দীতে। দারুন লাগলো পোস্টটা। দেখতেও পেলাম জায়গা খানি।