সেকালের বাংলায় লক্ষ্মীপূজার গল্পকথা, পর্ব -৩ (শেষ পর্ব)

in hive-129948 •  last month 

প্রিয় আমার বাংলা ব্লগের বন্ধুরা,


সমস্ত ভারতবাসী এবং বাংলাদেশের বাঙালি সহযাত্রীদের আমার আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন।


InShot_20241025_110522197.jpg








আশা করি আপনারা ঈশ্বরের কৃপায় সুস্থ আছেন, সব দিক থেকে ভালোও আছেন। আপনাদের সবার ভালো থাকা কামনা করে শুরু করছি আজকের ব্লগ।



বন্ধুরা, বিগত দুটি পর্বে অনেক ইতিহাস ও গল্পের কথা আপনাদের কাছে তুলে ধরেছি। লক্ষ্মীপূজার গল্প আজ শেষ করব। আজ বলব আশ্বিনের কোজাগরী পূজা কিভাবে হয় ও লক্ষ্মীপূজার বাস্তবিকতা আমার মতে।



আশ্বিন-পূর্ণিমায় কোজাগরী লক্ষীপূজা একটি বহু প্রাচীন উৎসবের সাথে জড়িত। বহু শতাব্দী পূর্বে শরৎকালে শস‍্য কর্তন হলে সীতা যজ্ঞ হত এবং তাতে সীতা এবং ইন্দ্র আহুত হতেন। পারস্কর গৃহ‍্য-সূত্রে সীতাকে এই স্থলে ইন্দ্রপত্নী বলা হয়েছে; কারণ সীতা লাঙ্গলপদ্ধতিরূপিণী শস‍্যউৎপাদয়িত্রী ভূমিদেবী; ইন্দ্র বৃষ্টি জল প্রদানকারী কৃষিকার্যের সুবিধাদাতা দেব। পূর্বে ইন্দ্র আহুত হতেন বলে তিথিতত্ত্বে ইন্দ্র-পূজার বিবরণ আছে। তা ছাড়াও লক্ষীর যে মূর্তি কল্পনা করা হয়েছে তাতে দেখতে পাওয়া যায় লক্ষ্মীর হস্তে ধান‍্যমঞ্জরী। এখনও লক্ষীপুজোর সময় কাঠায় ভরে নবীন ধান‍্য দেওয়া হয়ে থাকে।

বাংলায় কোজাগরী লক্ষ্মীপূজার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গি ভাবে জড়িয়ে আছে পিটুলির আল্পনা। পশ্চিমবাংলার বিভিন্ন প্রান্তে লক্ষ্মীপূজার আল্পনায় দেখা যায় আঞ্চলিকতার প্রভাব। এখনও গ্রামাঞ্চলে ঘরের দরজা থেকে দেবীর আসন, সেখান থেকে ধানের গোলা পর্যন্ত আল্পনায় ছোট ছোট পায়ের ছাপ এঁকে দেওয়া হয়। যেন মা লক্ষ্মী ছোট ছোট সুন্দর পা ফেলে গোলায় প্রবেশ করছেন আর দেখে নিচ্ছেন সন্তানদের খাদ্যাভাব আছে নাকি। না থাকলেও তিনি আশির্বাদে তা দূর করে দেবেন। পূজা বা ব্রতকথার সাথে আল্পনার একটি সম্পর্ক আছে। আল্পনা কামনার প্রতিচ্ছবি৷

পুজো হয় মূলত প্রতিমা, সরা, নবপত্রিকা কিংবা কলার পেটোর তৈরি নৌকায়। কোজাগরী লক্ষ্মীপুজোতে দেখা যায় জেলা ভিত্তিক আঞ্চলিক আচার অনুষ্ঠান। এখনও ঘরে ঘরে প্রতি বৃহস্পতিবার লক্ষ্মীর পাঁচালি পাঠ করে তাঁর আরাধনা করা হয়। উপচারে ফল মিষ্টি ছাড়াও থাকে মোয়া, নাড়ু ইত্যাদি। লক্ষ্মীর আচার অনুষ্ঠানেও দেখা যায় নানা ধরনের তাৎপর্য। কোনও কোনও পরিবারে পুজোয় মোট চোদ্দটি পাত্রে উপচার রাখা হয়। কলাপাতায় টাকা, স্বর্ণ মুদ্রা, ধান, পান, কড়ি, হলুদ ও হরিতকী দিয়ে সাজানো হয় পুজো স্থানটিকে। পুজোর উপকরণ এবং আচার অনুষ্ঠান দেখে অনুমান করা যায় বাংলার কৃষি সমাজের প্রভাব।

আসলে লক্ষ্মীই হল বাঙালীর দেবী। লৌকিক দেবী। তৎকালীন বাংলায় বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে এতো ঘটা করে দুর্গাপূজার চল ছিল না, হলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তা বারোয়ারি পূজা। একমাত্র লক্ষ্মীপূজাই গৃহস্থ বাড়ির বড় ও প্রধান পূজা হিসেবে গন্য করা হত৷ আশ্বিনের ওই কোজাগরী লক্ষ্মীপূজাই হত কত রকমফেরে ধুমধাম করে৷ সে যেন সত্যিই এক দেখার মতো দৃশ্য। বাড়ির মা ঠাকুমা কাকিমা জেঠিমা সবাই মিলে লক্ষ্মীকে আবাহন করতেন ছড়া কেটে। হাত জোড় করে বলতেন-

আঁকিলাম পদ্ম দু'টি, তাই মাগো নিই লুটি
দিনরাত পা দু'টি ধরি, বন্দনা করি
আঁকি মাগো আল্পনা, এই পূজা এই বন্দনা

সব ছড়ার মধ্যেই ছিল বাসনা, অভিমান এবং আকাঙ্খা। পেঁচা, কড়ি, ধানের গোলা আঁকার সাথে সাথে তাই ছড়াও কাটা হত।

আমি আঁকি পিটুলির গোলা, আমার হোক ধানের গোলা
আমি আঁকি পিটুলির বালা, আমার হোক সোনার বালা

আবার থাকত মন শুদ্ধ করার বার্তা।

আঁকলাম আল্পনা, দূরে ফেলি আবর্জনা
শুভ শুদ্ধ মন নিয়ে করি তব আরাধনা

এছাড়াও রয়েছে ব্রতকথা যেখানে আমরা আরও অনেক গল্প পাই এবং সেই ব্রতকথা পাঠ করার সাথে সাথে বাড়ির অন্যান্য স্ত্রী দের জানিয়ে দেওয়া হয় লক্ষ্মী দেবীর মাহাত্ম্য। কথায় আছে লক্ষ্মী ভীষণ চঞ্চলা। তাই শাঁখ কাঁসর ঘন্টা ইত্যাদি না বাজিয়ে শান্ত পরিবেশেই দেবীর পূজো করা হয়। আসলে নিঃশব্দেও যে উৎসব যাপন করা যায় এটাই হয়তো তার প্রমান।

ছোট থেকেই দেখেছি পাঁচালি পড়ার সময় বাড়ির বাকিরা চুপ করে বসে শুনতেন৷ আজ বুঝি এও একত্রে থিতু হয়ে বসে থাকার উপায়৷ এতে মনমালিন্যই যে দূর হয় তা নয় একাগ্র হতেও সাহায্য করে৷ বাংলার ঘরে ঘরে বাড়ির বৌদের লক্ষ্মী বলার চল আছে। বৃহস্পতিবার করে মা ঠাকুমা কাকিমা জেঠিমা সবাই পায়ে আলতা পরতেন৷ লক্ষ্মীবারে পরতে হয়। আর পূজার দিন তো কথাই নেই ধোয়া লাল পেড়ে শাড়ি লাল টিপ সিঁদুর আলতা শাঁখাপলাতেই প্রতিটি বঁধু মা লক্ষ্মীর রূপ। তৎকালীন বাংলায় মানুষের অতো ঐশ্বর্য কোথায়? তাও অল্পেই নিজেকে সাজিয়ে তোলার এ উপায় কখনোই কম নয়। আজকালের মনোবিদরাও বলে থাকেন নিজেকে ভালোবাসতে, নিজেকে সাজাতে৷ এক ঘেঁয়েমি থেকে বেরিয়ে এসে নিজেকে সুন্দর করে দেখতে শিখলে পৃথিবীটাও সুন্দর দেখায়৷ সেকালে এতো প্রসাধন যেমন ছিল না ভেজালও ছিল না৷ তাই তো এতো অল্প সাজেই বাড়ির বৌ মেয়েরা খুশি হয়ে উপাচারে মেতে উঠে সংসারে আনন্দ ডেকে আনত।

সোজা ভাবে বললে পূজা শুধু পূজা নয় একটা উৎসবও বটে। যা কেন্দ্র করে মানুষের উচ্ছ্বাস প্রকাশ পায়। আত্মীয় বন্ধুবান্ধবদের সাথে সামান্য সময় কাটানোর সুযোগ হয়। ভালো মন্দ খাওয়া দাওয়ার পাশাপাশি দৈনন্দিন জীবন থেকে একটা দিন একটু অন্যরকম করে বেঁচে নিয়ে পরবর্তী দিনগুলোর নিরলস পরিশ্রমের অক্সিজেন ভরে নেওয়া। আমার তো তাই মনে হয়। আত্মবিশ্বাস দৃঢ় করার পাশাপাশি একটা বিরতি। রোজের একই কাজ থেকে একটু বিরতি নেওয়া৷

আবার লক্ষ্মী পূজার প্রসাদের আচার দেখে জানিনা কেন আমার বারবারই মনে হয় সাধারণ মধ্যবিত্ত বা নিম্নবিত্তের মানুষদের এইভাবে একটা নিয়মের মধ্যে এনে ফল খাওয়ার সুযোগ করে দেওয়া। যাতে শরীরে নানান ভিটামিন, মিনারেলসের ঘাটতি কিছুটা হলেও চলে যায়৷ নইলে দীনদুঃখী বাংলায় সেযুগে কতজনেই বা ফলমূল খেতে পেত?

এইসব প্রত্যক্ষ প্রার্থনার আড়ালে জীবনের নানান দিক বজায় রাখার কারণেই হয়তো বছর বছর ধরে বাংলার ঘরে ঘরে আড়ম্বরে কিংবা অনাড়ম্বরেই হয়ে আসছে মা লক্ষ্মীর পূজা।



বন্ধুরা আজ শেষ করলাম। আপনারা পড়ে মতামত দেবেন আশা করি। আবার আসব অন্য কোন লেখা নিয়ে৷ আজ

টা টা...
1000205476.png


1000216462.png

পোস্টের ধরণলক্ষ্মীপূজার গল্প
মাধ্যমস্যামসাং এফ৫৪
লোকেশনপুণে,মহারাষ্ট্র
ব্যবহৃত অ্যাপক্যানভা, অনুলিপি


1000216466.jpg


১০% বেনেফিশিয়ারি লাজুকখ্যাঁককে


1000192865.png


~লেখক পরিচিতি~

1000162998.jpg

আমি নীলম সামন্ত। বেশ কিছু বছর কবিতা যাপনের পর মুক্তগদ্য, মুক্তপদ্য, পত্রসাহিত্য ইত্যাদিতে মনোনিবেশ করেছি৷ বর্তমানে 'কবিতার আলো' নামক ট্যাবলয়েডের ব্লগজিন ও প্রিন্টেড উভয় জায়গাতেই সহসম্পাদনার কাজে নিজের শাখা-প্রশাখা মেলে ধরেছি। কিছু গবেষণাধর্মী প্রবন্ধেরও কাজ করছি। পশ্চিমবঙ্গের নানান লিটিল ম্যাগাজিনে লিখে কবিতা জীবন এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি৷ ভারতবর্ষের পুনে-তে থাকি৷ যেখানে বাংলার কোন ছোঁয়াই নেই৷ তাও মনে প্রাণে বাংলাকে ধরে আনন্দেই বাঁচি৷ আমার প্রকাশিত একক কাব্যগ্রন্থ হল মোমবাতির কার্ণিশইক্যুয়াল টু অ্যাপল আর প্রকাশিতব্য গদ্য সিরিজ জোনাক সভ্যতা



কমিউনিটি : আমার বাংলা ব্লগ

আমার বাংলা ব্লগ পরিবারের সব্বাইকে আমার আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন৷ ভালো থাকুন বন্ধুরা। সৃষ্টিতে থাকুন।

🌾🌾🌾🌾🌾🌾🌾🌾


1000205458.png

Untitled_design_-_18.png

IMG_5055.jpg

puss_mini_banner9.1-1.png

1000205505.png

Authors get paid when people like you upvote their post.
If you enjoyed what you read here, create your account today and start earning FREE STEEM!
Sort Order:  

Upvoted! Thank you for supporting witness @jswit.

image.png

লক্ষ্মীপুজো নিয়ে এই সিরিজটা দারুন হলো। আজ শেষ পর্ব পড়লাম। লক্ষ্মীপুজোকে যুক্তি এবং পুরানের আঙ্গিকে ফেলে এত সুন্দর লেখা খুব কম হয়। সবকটি পর্ব অসাধারণ হল। লক্ষ্মী পুজো বাংলার একেবারে ঘরের পুজো। কিন্তু বর্তমানে আমরা বাঙালির সংস্কৃতি ভুলে বাইরে নিয়ে বেশি আগ্রহী। তাই বর্তমান পরিস্থিতিতে এই প্রবন্ধ প্রাসঙ্গিক বলেই আমার মনে হল।

চেষ্টা করেছি আমার মতো করে আমার চোখ দিয়ে দেখতে৷ তুমি বলছ যখন তখন সামান্য হলেও হয়েছে৷