☘️ নমস্কার বন্ধুরা☘️
নীলমের লেখামিতে আপনাদের স্বাগত
কেমন আছেন বন্ধুরা? আশা করি ঈশ্বরের কৃপায় আপনারা বেশ ভালই আছেন। আমিও খুব ভালো আছি। আপনাদের সুস্থতা কামনা করেই শুরু করছি আজকের পোস্ট। আজ চলুন কবিতা পড়ি। শুধু কবিতা পড়বো বললে ভুল হবে, আজ আমি আমার লেখা সম্পর্কেও কিছু বলবো এবং কবিতা সম্পর্কেও কিছু বলবো।
বন্ধুরা যেমন ভাবে প্রকৃতিতে পরিবেশে বিবর্তন ঘটেছে ঠিক তেমনি সাহিত্য সৃষ্টিতেও পরিবর্তন ঘটেছে। যেমন আমি যদি বিদ্যাপতি থেকেই ধরি তাহলে দেখা যায় বিদ্যাপতির পর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ওনাকে অনুসরণ করেছেন, ওনার থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছে কিন্তু ওনার মতো লেখেননি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিশাল সৃষ্টি এবং নোবেল পুরস্কারের কারণে আমরা ওনার কাব্যিক বা সাহিত্যিক সময়কালটাকে রাবীন্দ্রিক যুগ বলে জানি। ওনার একটা নির্দিষ্ট ঘরনা ছিল, যাকে আমরা রবীন্দ্র ঘরানা বলেও ব্যাখ্যা করি। ওনার পরবর্তীতে জীবনানন্দ দাশ যখন লিখতে শুরু করেন তখন নতুন যুগ শুরু হয় যার নাম হয় রবীন্দ্রোত্তর যুগ। জীবনানন্দ দাশ প্রথম মানুষ যিনি সচেতন ভাবে রবীন্দ্র ঘরানা ভেঙে বেরিয়ে আসেন। কবিতা আস্তে আস্তে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রভাব মুক্ত হল। এদিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হলো। ধীরে ধীরে তৈরি হলো আধুনিক কালখন্ড। এই পরিবর্তনের ধারা শুধুমাত্র বাংলা সাহিত্যে তা কিন্তু নয় পাশ্চাত্য সাহিত্যের হাত ধরে ঢুকে পড়ে বাংলা সাহিত্যে৷ তারপর আমরা কবিতার অনেক ওঠানামা দেখেছি আমরা দেখেছি হাংরি আন্দোলন। এই সবকিছুর ভেতর দিয়ে হাঁটছি আর আস্তে করে আধুনিক যুগ পেরিয়ে উত্তরা আধুনিকে ঢুকে পড়েছিলাম। আধুনিক যুগে আমরা প্রচুর রূপকের ব্যবহার করতাম, অলংকারের ব্যবহার করেছি। উত্তরাধুনিক যুগে ও যার ব্যবহার তীব্র ছিল। আমি শুরুর দিকের কথা বলছি। আমাদের পশ্চিমবঙ্গের বাংলা সাহিত্যে কবিতাকে যিনি হাতে ধরে এক একটা পাঁচিল টপকে নিয়ে গেছেন তার নাম একবার উল্লেখ করতেই হয়। তিনি হলেন বিখ্যাত কবি প্রভাত চৌধুরী। বর্তমান যুগোপযোগী কবিতা যাকে আমরা আপডেটেড ভার্সন বলি, সেই ভার্শন আমাদের শিখিয়েছে অহেতুক কবিতাকে শক্ত শক্ত শব্দের বাঁধনে বেঁধে অকারণ কাঠিন্য তৈরি না করতে। এরপর এতদিন যাবৎ যা লেখা হয়েছে যে ধরনের লেখা হয়েছে সেই একই জিনিস যদি আমরা লিখতে থাকি তাহলে আমাদের কবিতা লেখার প্রয়োজন কি? শুধুই কি নিজের কথা কাব্যিক আকারে বলে নিজেকে কবি কবি বলে সবার কাছে পরিচয় দেওয়া নাকি কবিতা জগতে একটি দৃষ্টান্ত তৈরি করা যা আগামী দিনে কবিতাকে নতুন দিশা দিতে সাহায্য করবে।
বর্তমান যুগে দেখুন আমাদের চিন্তা ভাবনা জ্ঞান অনেক প্রাচীন পন্থাকে টপকে ভেঙে এগিয়ে যেতে চায়। আমাদের দাদু ঠাকুমা বা বাবা মারা যে ধরনের ভাবতেন ঠিক একই পদ্ধতিতে আমরা ভাবি না। আবার দেখুন সমাজব্যবস্থার মধ্যেও সাংঘাতিক পরিবর্তন আমরা দেখতে পাই। আজকের ইন্টারনেটের জগতে সারা বিশ্ব আমাদের হাতের মুঠোয় যার ফলে আমরা অন্যের সংস্কৃতি জীবনযাত্রা সর্বোপরি প্রতিবেশী বা দূর দেশের মানুষদের সাথে বন্ধুত্ব করে তাদের মানসিকতাগুলোকে জেনে নিজেদেরকে পরিবর্তন করছি ভেতর ভেতর। আমাদের দেশে এখন সমলিঙ্গের বিবাহ, লিভ টুগেদার, পরকীয়া ইত্যাদি ধারণাগুলি আইনত সিদ্ধ করা হয়েছে। অর্থাৎ মানুষের চিন্তাভাবনায় যে একটা মুক্তভাব এসেছে তা খুবই স্পষ্ট। জীবনযাত্রা যখন এইভাবে বদলাতে পারে সৃষ্টিও বদলাবে। এ অবধারিত। আমরা বাঁধ ভাঙ্গার কথা বলি। আমরা কোলাবরেশনের কথা বলি।
একটু তলিয়ে ভেবে দেখলে যখন মানুষ সৃষ্টি হয়েছিল, যখন সভ্যতা তৈরি হয়েছিল তখন কোন কিছুতেই কোন বাধ্যবাধকতা ছিল না, যেটা ছিল সেটা বাঁচার জন্য লড়াই। কিন্তু সমাজ ব্যবস্থা যখন তৈরি হলো, সেখানে মানুষকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করার জন্য সমাজের সুবিধার্থে নানান ধরনের নিয়ম-কানুন, বাধা বিপত্তি, বাধ্যবাধকতা ইত্যাদি তৈরি হল। অথচ আজকের জীবনযাত্রা যেন ক্রমশ আদিমেই ফিরে যেতে চায়। আজ আমরা বেশ কিছু মানুষেরা ভাবতে শিখেছি আমাদের ভেতরে আমাদের পূর্বপুরুষের আদিম স্বভাব জেগে আছে। সমাজে ঘটে যাওয়া নানান ঘটনা আমাদের এই রকম ভাবতে সাহায্য করে। তো পারিপার্শ্বিক অবস্থা যখন পরিবর্তন হচ্ছে তখন সাহিত্যই বা কিভাবে থোড় বড়ি খাড়া খাড়া বড়ি থোড়, কিংবা বাঁধা গথে এগোবে? কবিতার ধরন তো বদলাতেই হতো।
উত্তরাধুনিকের সিঁড়ি পেরিয়ে আমরা যখন আপডেটেড যুগে ঢুকে গেছি তখন আমাদের কবিতা শব্দ নিয়ে খেলতে চায়। সেই খেলার মধ্যে দর্শন থাকতেও পারে, নাও থাকতে পারে, সেখানে একটা বৃষ্টির বর্ণনা থাকতে পারে, সেখানে স্বপ্নের কথা থাকতে পারে, সেখানে কল্পনার কথা থাকতে পারে। তবে কবিতা সহজে হতে চায়। কেন জানেন? এখন মানুষের মাথা খাটিয়ে কবিতা পড়ার মতো সময় নেই। যে কারণে কবিতার আকার ছোট হয়েছে। যে কারণে আমরা একটি কবিতা খুব বেশি হলে ১৬ থেকে ১৮ লাইনে শেষ করি। বর্তমানের কবিতার মধ্যে না বলা কথার আরোহন অবরোহন যেমন থাকে তেমনি কবিতার কথন যেকোনো লাইনে বাঁক নিতে পারে। যে বাঁকের সাথে আগের লাইনের হয়তো কোন বাহ্যিক সাদৃশ্য নেই। কবিতার অঞ্চল এখন অনেক বেশি উন্মুক্ত। আমরা জীবনযাত্রা থেকে শূন্যে ভাসিয়ে নিয়ে যাই তাকে, আবার শূন্য থেকে সর্বত্র। শুধু যে প্রবাহ আগে বয়ে গেছে সেই গড্ডলিকা প্রবাহে লেখনি যাতে না-বয় সেই দিকটা লক্ষ্য রাখি। কিন্তু এর অর্থ কখনোই শেখায় না কবিতাকে অহেতুক মেধার প্রয়োগ ফলিয়ে কঠিন করে তোলা। বর্তমান সাহিত্য চায় কবিতাকে একটা উচ্চতায় পৌঁছে দিতে। কি সেই উচ্চতা তা কিন্তু স্পষ্ট নয় তাও ভেঙে এগিয়ে যাওয়ার একটা অলিখিত প্রথা উজ্জল থেকে উজ্জ্বলতর-তম হয়ে উঠেছে।
অনেক বললাম এবার চলুন আমার কবিতাটি পড়াই৷
নাকছাবির আপোষ
------------------------------------ নীলম সামন্ত
একটা পাখি বেঁচে থাকার জন্য বৃক্ষে বাসা বাঁধে
মনোরঞ্জনের জন্য খাঁচায় ঢোকে,
বৃষ্টি থেকে বাঁচতে ঘুলঘুলি বা চিলেকোঠায় মাথা গোঁজে
এই বৈশিষ্ট্যগুলোকে উপেক্ষা করে
সিগারেট ধরালাম
আগুন সরে যেতেই ছাই-য়ের সাথে ছড়িয়ে পড়ল
নাকছাবির আপোষ
কুড়িয়ে নেবার লোক নেই
রেফারি জানে নাকছাবি বৃক্ষ থেকে খাঁচায় ঢুকে পড়া পাখির,
স্বীকার করলেই নাটকের তৃতীয় পর্বে উঠে আসবে সমুদ্রশঙ্খ।
সন্ধ্যা নামে। দলকে দল ফিরে আসে ঘরে,
আমি নাটকে লিখি ভাঙাগড়ার জীবনচক্রে
পাখিদের বৃক্ষ না হতে পারার জাফরানি বুদবুদ।
কবিতাটিতে আমি যা বলতে চেয়েছি সেটা সরাসরি লিখেছি আশা করি আপনারা পড়লে তা বুঝতে পারবেন। কোনো রূপকের আড়ালে আলাদা করে কিছু বলতে চাইনি। বিশেষ অলংকারে সাজিয়ে তুলিনি। শুধু যেটুকু বলার সেটুকুই বলেছি। আর চমক বলতে যেগুলো আটকাচ্ছে সেগুলো বিশেষণের প্রয়োগ। এই প্রয়োগও আস্তে আস্তে কমে যাবে কবিতা আরো স্বচ্ছ এবং সোজাসাপটা হয়ে উঠবে। আমি যখন উত্তরআধুনিক ঘরানা লিখতে শুরু করেছিলাম তখন আমার কবিতা বেশ কঠিন হতো, অনেকেই বুঝতে পারতেন না। কিন্তু এক একটা ঘটনা যখন টপকে এগোচ্ছি তখন শিখলাম বর্তমান কবিতা কিন্তু ওই কাঠিন্য দাবি করে না।
এই কবিতাটিতে আমি একটি পাখির জীবনযাপন বলতে চেয়েছি। সত্যিই তো ভেবে দেখুন একটি পাখি সর্বদাই নির্ভরশীল প্রাণী। তার বেঁচে থাকার জন্য গাছের উপর নির্ভর করতে হয় নয়তো খাঁচার উপর। আবার পরের পংক্তিতে দেখুন নাকছাবি পড়ে যাওয়ার কথা বলেছি অর্থাৎ এই জায়গায় পাখি কিন্তু একটা মানুষ। পাখি সেই মানুষ যে সারাদিন ঘুরে বেড়ালেও তার বেঁচে থাকার জন্য একটা দ্বিতীয় বা তৃতীয় নির্ভরশীলতার প্রয়োজন হয়। আবার দেখুন প্রকৃতির পাখি আজীবন কাল গাছে থেকে গেল কখনো বৃক্ষ হতে পারে না। তেমনি পাখি স্বভাবের মানুষগুলিও কিংবা মেয়েগুলিও কখনো বৃক্ষের মতো আত্মনির্ভরশীল হতে পারেনা। তারা পাখিওয়ালার হাত ধরে খাঁচা বন্দি হয়। আর নইলে বৃক্ষের মতো মানুষের বাহুবন্ধনে নিশ্চিন্তে পড়ে থাকে। তাদের হাত ধরে ছেড়ে দিয়ে আবার টেনে নিলে তারা ঢুকে যায়। আসলে এই সব মিলিয়ে জীবন তো একটা নাটক, যেখানে অনবরত ভাঙার গড়ার খেলা অবিরাম হয়ে চলেছে।
বন্ধুরা কেমন লাগলো আজ আমার কবিতার পোস্ট। কবিতাটি পড়ে আপনাদেরও কি এই একই মতামত তৈরি হয়েছে যা আমি লিখতে চেয়েছি? আপনাদের কমেন্টের অপেক্ষায় রইলাম।
কাল আবার আসবো পোস্ট নিয়ে, আজ এ পর্যন্তই থাক।
টাটা৷
ছবিটি আমার এক বন্ধুর মোবাইলে তোলা। এবছর বইলেমায়। |
---|
~লেখক পরিচিতি~
আমি নীলম সামন্ত। বেশ কিছু বছর কবিতা যাপনের পর মুক্তগদ্য, মুক্তপদ্য, 'কবিতার আলো' নামক ট্যাবলয়েডের সহসম্পাদনার কাজে নিজের শাখা-প্রশাখা মেলে ধরেছি। তবে বর্তমানে বেশ কিছু গবেষণাধর্মী প্রবন্ধেরও কাজ করছি। পশ্চিমবঙ্গের নানান লিটিল ম্যাগাজিনে লিখে কবিতা জীবন এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি৷ বর্তমানে ভারতবর্ষের পুনে তে থাকি৷ যেখানে বাংলার কোন ছোঁয়াই নেই৷ তাও মনে প্রাণে বাংলাকে ধরে আনন্দেই বাঁচি৷ আমার প্রকাশিত একক কাব্যগ্রন্থ হল মোমবাতির কার্ণিশ ও ইক্যুয়াল টু অ্যাপল আর প্রকাশিতব্য গদ্য সিরিজ জোনাক সভ্যতা।
কমিউনিটি : আমার বাংলা ব্লগ
আমার বাংলা ব্লগ পরিবারের সব্বাইকে আমার আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন৷ ভালো থাকুন বন্ধুরা। সৃষ্টিতে থাকুন।
Upvoted! Thank you for supporting witness @jswit.
Downvoting a post can decrease pending rewards and make it less visible. Common reasons:
Submit
আধুনিক থেকে উত্তর আধুনিক কবিতার পটপরিবর্তনটা সুন্দর ব্যাখ্যার মাধ্যমে উঠে এলো। উত্তর আধুনিক কবিতা ঝরঝরে। আর প্রভাত চৌধুরীর নাম খুব প্রাসঙ্গিকভাবেই এলো। তাঁর হাত ধরে বাংলা কবিতার সাম্প্রতিকতম উত্তরণ সত্যিই সাহিত্যের এক বাঁক৷ সঙ্গে কবিতা নাকচাবির আপোষ প্রণিধানযোগ্য। সব মিলিয়ে সুন্দর একটি পোষ্ট।
Downvoting a post can decrease pending rewards and make it less visible. Common reasons:
Submit
তোমার মন্তব্য খুব ভালো লাগে৷ সুন্দর করে গুছিয়ে বলো। আচ্ছা কবিতাটার শেষ স্ট্যাঞ্জা টা দেখো তো৷ কন্টিনিউটি কি নেই? আমি ভাবছি৷
Downvoting a post can decrease pending rewards and make it less visible. Common reasons:
Submit