পশ্চিম মেদনীপুরের পাথরা তথা মন্দির পরগ্ণা'র কথা। পর্ব-২

in hive-129948 •  5 days ago 

প্রিয় আমার বাংলা ব্লগের বন্ধুরা,


সমস্ত ভারতবাসী এবং বাংলাদেশের বাঙালি সহযাত্রীদের আমার আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন।


received_1784726915431336.jpeg

[সোর্স](মেটা AI)








আশা করি আপনারা ঈশ্বরের কৃপায় সুস্থ আছেন, সব দিক থেকে ভালোও আছেন। আপনাদের সবার ভালো থাকা কামনা করে শুরু করছি আজকের ব্লগ।


দীর্ঘ যাত্রাপথে ঠিকে থাকা পাথরা, পশ্চিম মেদিনীপুরের মন্দির-পরগণা


অনেক ঝড়ঝাপটা পার করে কিছু মন্দির আজও টিকে আছে। যারা বয়ে চলছে সেই পুরাতন যুগের ঐতিহ্য। ভারতে যে সব প্রাচীন মন্দিরের নিদর্শন পাওয়া যায়, সেগুলি পাথর বা ইটের তৈরী। বাংলায় পাথরের ব্যবহার পাওয়া গেলেও এঁটেল মাটির প্রতুলতার জন্য মাটি পুড়িয়ে ইট তৈরী সহজ ছিল। তাই পোড়ামাটির অর্থাৎ ইটের মন্দিরের আধিক্য। এই মন্দিরগুলিও মূলত ইটের তৈরী। মন্দিরের চূড়া বা ছাদ নির্মাণে তিন ধরনের আঙ্গিক দেখা যায়। যেমন চালা। বারো চালা অবধি মন্দির দেখা যায়। আবার চালা এবং শিখররীতির মিলিত ফল ‘রত্ন’, যা বিজোড় সংখ্যক হয়। একরত্ন থেকে শুরু করে পঞ্চবিংশ রত্ন দেখা যায়৷

পাথরা মন্দিরগুলি দু-তিনটি কমপ্লেক্সে বিভক্ত। কংসাবতী নদীতীরে কয়েকটি, রাস্তার অপরপারে বেশ ক’টি, এবং খানিক দূরে গ্রামের মধ্যে রাসমঞ্চ এবং অন্যান্য মন্দির। প্রথমে নদীর উত্তর তীরে দক্ষিণমুখি একটি উনিশ শতকের পঞ্চরত্ন মন্দির। ঢালু চালার উপরে চারদিক খোলা চারটি রত্ন। কেন্দ্রে একই আকারের একটি বড় রত্ন। প্রবেশপথে তিনটি খিলান। একগুচ্ছ গোলাকার থাম খিলানগুলিকে ধরে রেখেছে। তাদের মাথায় বিলুপ্তপ্রায় পঙ্খের কাজ। তার উপরে টেরাকোটার ফলক। মন্দিরের কোণায় পাতলা ইটের ব্যবহারও নজরে আসে।

উল্লেখযোগ্য কালাচাঁদ মন্দির চত্ত্বরে আছে সবথেকে উঁচু এবং চিত্তাকর্ষক নবরত্ন মন্দির। এটি আঠেরো শতকে মজুমদার বংশের প্রতিষ্ঠিত। নদীর উত্তর তীরে অবস্থিত। প্রবেশপথে তিনটি খিলানকে দুটি খর্বাকৃতি থাম ধরে রেখেছে। এছাড়া আছে ধর্মরাজ মন্দির। পঞ্চরত্ন বিশিষ্ট ধর্ম ঠাকুরের মন্দিরটি দক্ষিণমুখী। ত্রিখিলান বিশিষ্ট মন্দিরটি তে একসময় টেরাকোটার কারুকার্য থাকলেও আজ প্রায় নিশ্চিহ্ন। তবে মন্দিরের সামনের দিকে কিছুটা পঙ্খের কাজ টিকে আছে। সে যদি রাঢ় অঞ্চলের সর্বোচ্চ দেবতা ছিলেন এই ধর্ম ঠাকুর। তবে মন্দিরটি বর্তমানে বিগ্রহ শূণ্য। বিগ্রহটি রাখা আছে গ্রামেরই এক ভট্টাচার্যের বাড়িতে।

এরপর বলি নবরত্ন মন্দিরের কথা। পাথরার অন্যতম শ্রেষ্ঠ মন্দির হলো এই নবরত্ন মন্দির তবে শোনা যায় শুরু থেকেই এটি পরিত্যক্ত এবং জনশ্রুতি অনুযায়ী অভিশপ্ত। এই কমপ্লেক্সে বেশ কিছু দালান রীতির মন্দির দেখা যায়। তবে এই মন্দিরটিও বিগ্রহহীন। শোনা যায় মন্দিরটি হওয়ার পর থেকেই বিগ্রহ নেই মানে এখানে প্রতিষ্ঠাই করা হয়নি কারণ এটি একটি অভিশপ্ত মন্দির। এই মন্দিরটির গায়েও কিছু টেরাকোটার কাজ আজও বেঁচে আছে। এখানে বেশ কিছু শিবের মন্দির দেখা যায়। আর দেখা যায় ভেষজ রঙের তৈরি আলপনা।

কালাচাঁদ মন্দির কমপ্লেক্সের যে পঞ্চরত্ন মন্দিরটি রয়েছে তার উত্তর দেখে গেলেই দেখা যায় মাকড়া পাথরের দুর্গা মন্দির। যদিও আজ মন্দির নেই আছে মন্দিরের ভগ্নাংশ। অন্যান্য মন্দিরের থেকে এই মন্দিরটি আলাদা শুধুমাত্র উপকরণে কারণ মন্দিরটি মাকড়া পাথরের তৈরি। মাকড়া অর্থাৎ ঝামা পাথর। শোনা যায় জমিদারি আমলে এই মন্দিরে খুব জাঁকজমক করে দুর্গা পুজো হতো। পাথরা গ্রামে এই মন্দিরটি সবথেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। বর্তমানে চারটি ভীতের ওপর কোনমতে টিকে থাকা কঙ্কাল যার শরীর থেকে অধিকাংশ ঝামা পাথরই গ্রামবাসীরা খুলে নিয়ে গেছে। এছাড়াও রয়েছে আরও বেশ কিছু পঞ্চরত্ন মন্দির, রেখা দেউল রীতির মন্দির। এই রেখা দেউল রীতির মন্দিরটি বর্তমানে শীতলা মন্দির নামে বিখ্যাত। তবে অতীতে এখানে মজুমদারদের মানে বিদ্যানন্দ ঘোষাল পরিবারের গৃহদেবতা থাকতো। এই গৃহদেবতা স্থান পরিবর্তনের পর গ্রামবাসীরা এখানে বুড়িমা বা শীতলাদেবীকে অধিষ্ঠিত করেন। এই মন্দিরটি সংস্কার করা হয়েছে বলে এর প্রাচীন ছোঁয়া কিছুই নেই। আধুনিক রঙে নতুন হয়ে উঠেছে। তবে মন্দিরের প্রবেশদ্বারের উপরে পূর্ব-পশ্চিম কোণে থাকা দুটি মূর্তি ও প্রাণীর মুখমন্ডল এখনো আছে।

এবার বলব রাসমঞ্চ কমপ্লেক্সের কথা। রাসমঞ্চ কমপ্লেক্সটি অষ্টভুজাকৃতি। এই কমপ্লেক্স এ প্রায় তিনটি পঞ্চরত্ন মন্দির রয়েছে যেখানে কষ্টিপাথরের তৈরি শিবলিঙ্গ পূজিত হয়। এককালে এখানে রাসলীলা হতো। পাথরার অন্যান্য মন্দিরের তুলনায় এই মন্দিরগুলিতে টেরাকোটার কাজ অনেকখানি টিকে আছে। যেখানে দেখা যায় দশাবতার, কৃষ্ণলীলা, রাম সীতা ইত্যাদি বিভিন্ন দেব-দেবী ও তাদের মোহন্তদের জীবনযাত্রা। এই মন্দিরগুলি বন্দ্যোপাধ্যায়দের তৈরি। এর প্রধান আকর্ষণ হল দ্বারপাল। দ্বারপালগুলিতেও রয়েছে বৈচিত্র। উত্তর দেখে মন্দিরে যে দ্বারপাল রয়েছে তার হাতে লাঠি, পরের মন্দিরের দ্বারপালের হাতে বন্দুক এবং শেষ মন্দিরের দ্বারপালের হাতে তলোয়ার। এই মূর্তিগুলি বর্তমানে অনেকটাই ক্ষয়প্রাপ্ত।

এরকম আরো অনেকগুলি মন্দির রয়েছে নিজ নিজ বৈশিষ্ট্য নিয়ে। আজকের পাথরা গ্রাম শুধুমাত্র মন্দিরগুলির জন্যই ইতিহাসে জায়গা করে নিয়েছে৷ এই যে এত মন্দিরের কথা বললাম এবং একটি গ্রামের কথা বললাম কিন্তু যার কথা একেবারে না বললেই নয় ইয়াসিন পাঠান। এই ইয়াসিন পাঠান ভদ্রলোকটি ভিন্ন ধর্মাবলম্বী হওয়া সত্ত্বেও অত্যন্ত যত্ন সহকারে মন্দিরগুলিকে টিকিয়ে রেখেছেন। স্বধর্মের মানুষদের বিরূপতার সম্মুখীন হতে হয়েছে তাঁকে, মৃত্যুর হুমকি পর্যন্ত শুনতে হয়েছে। কিন্তু হার মানেন লনি। অবশেষে আর্কিওলজিকাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া (ASI)-কে উপলব্ধি করাতে সক্ষম হন, ফলত আজ ৩৪টি মন্দিরের মধ্যে আঠাশটি মন্দির ASI-এর তত্ত্বাবধানে এবং ইতিমধ্যেই এই সংস্থা আঠাশটির মধ্যে আঠেরটির যথাযথ পদ্ধতি মেনে সংস্কার করেছে। গ্রামেরই একটি স্কুলের সামান্য পিওনের চাকরি করে তাঁর এই অসামান্য উদ্যোগ এবং প্রচেষ্টার জন্য সরকার থেকে উনিশশো চুরাশি সালে কবীর সম্মান দেওয়া হয়৷


তথ্যসূত্র -

১) অবহেলিত পুরাকীর্তির প্রাচুর্যঃ পাথরার দেবদেউল- তারাপদ সাঁতরা (দেশপত্রিকা)

২) রিসার্চ জার্নাল, পাথরার মন্দির - তনয়া মুখার্জি

৩) পাথরার মন্দির নিয়ে লেখা - তিলক পুরকায়স্থ

৪) মন্দিরময় পাথরা ব্লগ- প্রীতম নস্কর

৫) বাংলার শিকড়ঃ পাথরা, বাংলার মন্দিররীতির প্রদর্শন মালা, নিউজ বাইট - সুতপা জ্যোতি, সায়ন্তনী নাগ

1000205476.png


1000216462.png

পোস্টের ধরণক্রিয়েটিভ রাইটিং
কলমওয়ালানীলম সামন্ত
মাধ্যমস্যামসাং এফ৫৪
ব্যবহৃত অ্যাপক্যানভা, অনুলিপি


1000216466.jpg


১০% বেনেফিশিয়ারি লাজুকখ্যাঁককে


1000192865.png


~লেখক পরিচিতি~

1000162998.jpg

আমি নীলম সামন্ত। বেশ কিছু বছর কবিতা যাপনের পর মুক্তগদ্য, মুক্তপদ্য, পত্রসাহিত্য ইত্যাদিতে মনোনিবেশ করেছি৷ বর্তমানে 'কবিতার আলো' নামক ট্যাবলয়েডের ব্লগজিন ও প্রিন্টেড উভয় জায়গাতেই সহসম্পাদনার কাজে নিজের শাখা-প্রশাখা মেলে ধরেছি। কিছু গবেষণাধর্মী প্রবন্ধেরও কাজ করছি। পশ্চিমবঙ্গের নানান লিটিল ম্যাগাজিনে লিখে কবিতা জীবন এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি৷ ভারতবর্ষের পুনে-তে থাকি৷ যেখানে বাংলার কোন ছোঁয়াই নেই৷ তাও মনে প্রাণে বাংলাকে ধরে আনন্দেই বাঁচি৷ আমার প্রকাশিত একক কাব্যগ্রন্থ হল মোমবাতির কার্ণিশইক্যুয়াল টু অ্যাপল আর প্রকাশিতব্য গদ্য সিরিজ জোনাক সভ্যতা



কমিউনিটি : আমার বাংলা ব্লগ

আমার বাংলা ব্লগ পরিবারের সব্বাইকে আমার আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন৷ ভালো থাকুন বন্ধুরা। সৃষ্টিতে থাকুন।

🌾🌾🌾🌾🌾🌾🌾🌾


1000205458.png

5q1knatRafuz9XwMuuEKUktArqLQpY9ERHvTUkr4H3M7EJa5zmYjd88Mgg7ucDLaoRyBbuk6ZDoBxSEqGcM8f9gtL5ff3dELA5FFXhfdJMy3CLVqCeBiUcuHt1GpdcrweUGxxxmGTC4nBtUhD1QWuxAAkWX8iy55cDyLQMmixxBjRCHLY6iMvDqgWQXyeinoLTe3.png

C3TZR1g81UNaPs7vzNXHueW5ZM76DSHWEY7onmfLxcK2iPJrqKcZJETAdA7YZhepGeLmDVmitykwcE4ZY727f2tSpfY4knMyeojpyP93CptPsV8DDQHMKLJ.png

1000205505.png

Authors get paid when people like you upvote their post.
If you enjoyed what you read here, create your account today and start earning FREE STEEM!
Sort Order:  

Upvoted! Thank you for supporting witness @jswit.

image.png

8cde6146-940b-4fe1-9ec4-1e8bbff1df5b.jpeg

9143b140-99b3-4fbe-ba5e-5b59ca079db0.jpeg