সাইকেল একটি সভ্যতার নাম - জেনারেল রাইটিং

in hive-129948 •  10 days ago 

প্রিয় আমার বাংলা ব্লগের বন্ধুরা,


সমস্ত ভারতবাসী এবং বাংলাদেশের বাঙালি সহযাত্রীদের আমার আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন।


Messenger_creation_931404945477844.jpeg

[সোর্স](মেটা এ আই)







আশা করি আপনারা ঈশ্বরের কৃপায় সুস্থ আছেন, সব দিক থেকে ভালোও আছেন। আপনাদের সবার ভালো থাকা কামনা করে শুরু করছি আজকের ব্লগ।



কাঁচা রাস্তায় দু'চাকার জীবন মানেই সাইকেল। ভোরের ক্রিং ক্রিং থেকে রাতের ঘটাং ঘটাং৷ জীবনের সাইকেল শাখানদীর মতো ছড়িয়ে ছিল নানান দিকে৷ আমরা যারা আশির দশকের তারা প্রত্যেকেই দেখেছি সাইকেলের প্রকট থেকে প্রচ্ছন্ন হয়ে যাওয়ার অভিমুখ৷ ভোরবেলায় বাড়ির রোজগেরে পুরুষরা বেরিয়ে পড়তেন সাইকেলে চেপে, তারপর পড়ুয়াদের পড়তে যাবার ভিড়, বেকারি কাকু, বাসনওয়ালা মায়ের স্কুলে যাওয়া থেকে শুরু করে প্রত্যেকের বাড়ি ফেরা; প্রায় সব মিলিয়ে সাইকেলকে বলাই যায় বৈষম্য ভুলিয়ে দেওয়ার গোপন চাবিকাঠি।

বাবা প্রায়ই গল্প করেন, ওনার টিনেজে কয়েকজন বন্ধু মিলে সাইকেলে করে দীঘা গিয়েছিলেন৷ দীঘা আমাদের বাড়ি থেকে প্রায় ১০০ কিলোমিটারের ওপরে৷ লুকিয়ে বাড়ির চাল বিক্রি করে দেখতে গিয়েছিলেন সমুদ্র। সেই সাইকেল যখন আমি দেখি তখন জীবন্ত জীবাশ্মের মতো দাঁড়িতে থাকত দালানের খুঁটিতে, শরীর এলিয়ে। আর বাকিগুলোর মধ্যে মা'রটা ছিল সব থেকে বেশি যত্নের৷ আমার কোন সাইকেল ছিলো না। ছোট ট্রাইসাইকেল চড়েছি কিনা তাও মনে নেই।

বিকেলবেলা কিংবা সকাল ফুরিয়ে যাওয়া বেলায় মিছিল বেরোতো কিছুদিন ছাড়া ছাড়াই। নানান রাজনৈতিক দল হেঁটে কিংবা প্যাডেল চেপে শোনাতেন দিন বদলের আশ্বাস দেওয়া স্লোগান৷ সাইকেল তখন ধুলো মাখতে ব্যস্ত৷ উত্তর না দিতে পারলেও পিছু হটেনি। জোড়া জোড়া পায়ের সাথে মিলে পার করেছে পথের বাঁক৷ এই সব পথ আর বাঁক পেরোতে গিয়ে সাইকেলই যেন একটা মস্ত পথ দিয়ে গেল। যে পথ বয়ে আনত বরফদাদুকে৷ বরফদাদু গরমের দিনে বরফদাদু আর শীতের দিনে গরুর গাড়ির চাকা। না না চাকা বিক্রি করতেন না৷ গরুর গাড়ির চাকার মতো দেখতে চিপস বিক্রি করতেন যার ভেতর লাল খয়েরি রঙের বাদাম ভাজা থাকত। দাদু হাতে করে প্যাকেট এগিয়ে দিতে দিতে শোনাতেন গরুর গাড়ির গল্প৷ সে সময় ওটাই ছিল টাটকা ইতিহাস। আজ সেসব কথা মনে করলে দেখতে পাই ঋতু পরিবর্তনের সাথে জীবিকা পরিবর্তনের সহজ সমানুপাত। সংসার কিংবা পেটের জ্বালার থেকে বড় বোধহয় আর কিছু নেই৷

মা'র সাইকেল নিয়ে দাদা পড়তে যেত৷ ফিরতে রাত হতো বলে ডায়নামো লাগিয়েছিল৷ একদিন সন্ধের পর দাদা বলল "চল বোন ম্যাজিক দেখাবো" হাতে করে প্যাডেলটা জোরে ঘোরাতেই লাইট জ্বলল। আমার কাছে যেটা সত্যিই ম্যাজিকের থেকে কম কিছু না৷ সাইকেল কতখানি ম্যাজিক মোমেন্ট জানিনা সওয়ারিগুলো সত্যিই ম্যাজিক্যাল। ওই দুটো প্যাডেলে পা চেপে কত অসাধ্য সাধনই না করত৷ মা প্রায়ই বলতেন সাইকেল হলো ব্যালেন্স৷ ঠিক জীবনের মতো৷ সরু সরু দুটো চাকা নিজেদের অক্ষের ওপর ঘুরতে ঘুরতে কত মানুষের দিন যাপন ব্যালেন্স করেছে সে কথা ফুরোবার না৷

তবে আমি আর সাইকেল যেন রক্তমুখী। যতবার প্যাডেলে পা দিয়েছি ততবার বুঝেছি ব্যালেন্স করে টিকে থাকার মানুষ আমি নই। শেষ যে বার চালিয়েছিলাম একটা দ্বীপে। বাড়ি ফিরেছিলাম ইমার্জেন্সি গাড়িতে৷ বাকিটা দীর্ঘ উপন্যাস৷ আজও মনে হয় ব্যালেন্স করাটা সত্যিই সহজ না। সামনের জনকে পাশ কাটিয়ে নিজেকে সামলে এগিয়ে যাওয়া কিংবা মুখোমুখি জনের দিকে হাসি বিনিময় করে নিজের নিজের রাস্তায় এগিয়ে যাওয়া। সবটাই যেন দাবার বোর্ডের মতো সুডৌল ছক। হাজার চেষ্টা করেও ছকে আনতে পারিনি নিজেকে। তাই বেমানান তকমা ঝুলিয়ে পা-গাড়িকেই সাইকেল আখ্যান দিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলি৷

ব্যবহার কমলেও সাইকেল জীবাশ্ম না৷ রাস্তাঘাটে এখনও দেখি কাকভোরে আরোহীরা বেরিয়ে পড়েছেন দূর দূর পথ পেরোতে৷ লাইট জ্বলা থেকে গিয়ার দেওয়া৷ প্রযুক্তির উৎকর্ষতা এখানেও ছাপ ফেলে গেছে৷ সন্ধে হলেই কচিকাচারা নানান রঙের সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়ে৷ সাইকেল এখন প্রয়োজনের থেকেও বেশি খেলার সাথী; জন্মদিনে বা বিশেষ অনুষ্ঠানের অভিজাত উপহার৷ একসময়ের অপরিহার্য বাহন প্রযুক্তির উন্নয়নের ঠেলায় কোণঠাসা হয়েও চেষ্টা করছে নিজেকে টিকিয়ে রাখতে৷ ঠিক যেন বাড়ির বৃদ্ধ গুরুজন৷

তাহলে কি সাইকেল একজন বুড়ো হয়ে যাওয়া পথ? যা যুগের পরিবর্তন দেখতে দেখতে নিজের সৌন্দর্য বুকে এগিয়ে চলে। কিংবা ফুরিয়েও না ফুরোনো কাল। সে যাই হোক কিংবা যে যেভাবে ভাবুক একটু গুছিয়ে নিলে সাইকেল যেন নিজেই একটা আস্ত সভ্যতা।
1000205476.png


1000216462.png

পোস্টের ধরণজেনারেল রাইটিং
কলমওয়ালানীলম সামন্ত
মাধ্যমস্যামসাং এফ৫৪
লোকেশনপুণে,মহারাষ্ট্র
ব্যবহৃত অ্যাপক্যানভা, অনুলিপি


1000216466.jpg


১০% বেনেফিশিয়ারি লাজুকখ্যাঁককে


1000192865.png


~লেখক পরিচিতি~

1000162998.jpg

আমি নীলম সামন্ত। বেশ কিছু বছর কবিতা যাপনের পর মুক্তগদ্য, মুক্তপদ্য, পত্রসাহিত্য ইত্যাদিতে মনোনিবেশ করেছি৷ বর্তমানে 'কবিতার আলো' নামক ট্যাবলয়েডের ব্লগজিন ও প্রিন্টেড উভয় জায়গাতেই সহসম্পাদনার কাজে নিজের শাখা-প্রশাখা মেলে ধরেছি। কিছু গবেষণাধর্মী প্রবন্ধেরও কাজ করছি। পশ্চিমবঙ্গের নানান লিটিল ম্যাগাজিনে লিখে কবিতা জীবন এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি৷ ভারতবর্ষের পুনে-তে থাকি৷ যেখানে বাংলার কোন ছোঁয়াই নেই৷ তাও মনে প্রাণে বাংলাকে ধরে আনন্দেই বাঁচি৷ আমার প্রকাশিত একক কাব্যগ্রন্থ হল মোমবাতির কার্ণিশইক্যুয়াল টু অ্যাপল আর প্রকাশিত গদ্য সিরিজ জোনাক সভ্যতা



কমিউনিটি : আমার বাংলা ব্লগ

আমার বাংলা ব্লগ পরিবারের সব্বাইকে আমার আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন৷ ভালো থাকুন বন্ধুরা। সৃষ্টিতে থাকুন।

🌾🌾🌾🌾🌾🌾🌾🌾


1000205458.png

2Q7GP48zf6pRECgLhs5T7oM7cjsx5ovagFpaKKKfY16EFN5pHzaHPqv9Uq8h9Rqf3LQgMfuGE3v51aM85Ti2k9WvfchoJpEWisj68U97yH...emgGuBkUtUrTjjGPoQFLShbZAgVkmHAuy4ptwsUiEKJ2yfrBghm5yn7bKv7p3542mq4wDxSyg3ozBqbjj4Pwx2x1uBfiULmZiZmsfXaQXggLysJERic3f9fqn5.png

Screenshot_20250228_230650_X.jpg

1000205505.png

Authors get paid when people like you upvote their post.
If you enjoyed what you read here, create your account today and start earning FREE STEEM!
Sort Order:  

Upvoted! Thank you for supporting witness @jswit.

image.png

1000407642.jpg

1000407641.jpg

1000407640.jpg

সাইকেল শুধু একটা বাহন নয়, যেন এক পুরো যুগের প্রতিচ্ছবি।গল্পের ভাঁজে ভাঁজে পুরোনো দিনের সাইকেল-স্মৃতি এত সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে যে মনে হলো, একবার সময়কে উল্টে ফিরে যাই সেই দিনগুলোতে। জীবন, পরিবর্তন, টিকে থাকার লড়াই সবকিছুই যেন এই দু’চাকার সাথে জুড়ে গেছে। সত্যিই, সাইকেল শুধু চলার মাধ্যম নয়, বরং এক আস্ত গল্প, এক আস্ত সভ্যতা।

আহা কী মিষ্টি করে বললেন আপনি আপু। বড় ভালো লাগল পড়ে। সাইকেল আজকাল তো দেখাই যায় না। এ সবই আমার স্মৃতির পাতা থেকে লেখা। আপনার ভালো লেগেছে জেনে খুশি হলাম।

মধ্যবিত্ত জীবনের স্বপ্নের একটা সিঁড়ি হিসেবেও বিবেচিত হয় সাইকেল, আমি নিজেও সাইকেলে চেপে কলেজ করেছি, চলতে চলতে রোজ কত স্বপ্নের অনুভূতি নিয়ে খেলা করেছি। তবে হ্যা, আপনার মা কিন্তু দারুণ বলেছেন, সাইকেল সত্যি জীবনের ব্যালেন্স। জীবনকে গতিশীল রাখার ব্যালেন্স, লক্ষ্যে এগিয়ে যাওয়ার ব্যালেন্স। ভালো লাগলো কথাগুলো পড়ে। অনেক ধন্যবাদ।

এখন সাইকেল দেখাই যায় না৷ শহরে বাচ্চারা কেনে শখে৷ আমাদের কত স্মৃতি সাইকেল নিয়ে। যদিও আমার নিজের কোন সাইকেল ছিল না৷ সাইকেল কেন পা গাড়ি ছাড়া কোন বাহনই নেই। হা হা

আপনি পড়লেন খুব ভালো লাগল ভাইয়া৷ 🌷🌷 ধন্যবাদ নেবেন।

এখন সাইকেল হলো বাচ্চাদের খেলার সাথী। তবে তাদের এই খেলার সাথী ব্যালেন্স করতে শেখায় রাস্তার উচু নিচু পথ কিভাবে চলেতে হবে। তবে জীবনে ব্যালেন্স করা শিখায় কিনা তা বলা কঠিন, যা আন্টি বলেছেন।আমার আব্বাকেও দেখেছি অফিসে যেতেন সাইকেল চেপে। আর শ্বশুর বাড়িতে এখনো আমার দেওর তার সাইকেলটি রেখে দিয়েছেন স্মৃতি হিসাবে। তবে পরিবেশ বান্ধব এই যানটি আবার নতুন রুপে ফিরে এসেছে কিছু কিছু সংগঠনের কল্যানে। বেশ ভালো লাগলো আপনার লিখাটি পড়ে।

সাইকেল জীবনে ব্যালেন্স করতে শেখায় না আপু। সাইকেল ব্যালেন্স করে চালাতে হয়। আর ঠিক সেরকমই জীবনের পথেও মানুষকে ব্যালেন্স করে চলতে হয়। দুটোরই ব্যালেন্স হারালে পতন ঘটতে পারে৷ জীবনের সঙ্গায় সাইকেল হল রূপক।

সাইকেল নিয়ে আমাদের প্রত্যেকেরই অনেক স্মৃতি। ধন্যবাদ আপু।