প্রিয় আমার বাংলা ব্লগের বন্ধুরা,
সমস্ত ভারতবাসী এবং বাংলাদেশের বাঙালি সহযাত্রীদের আমার আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন।
আশা করি আপনারা ঈশ্বরের কৃপায় সুস্থ আছেন, সব দিক থেকে ভালোও আছেন। আপনাদের সবার ভালো থাকা কামনা করে শুরু করছি আজকের ব্লগ।
গতকাল থেকেই পুরো হৈ হৈ রব পড়ে গেছে। বন্যা বা বর্তমান বিচারহীন পশ্চিমবঙ্গের দুরবস্থার মধ্যেও কেউ অলংকার কেড়ে নিয়েছে এমন অবস্থা হয়ে গিয়েছিল। অলংকারই বটে। কলকাতা ট্রাম। প্রায় ১৫১ বছরের ঐতিহ্য এই ট্রাম। অনেকেই যারা হা হুতাশ করছে তাদের দৈনন্দিন জীবনের সাথে হয়তো ট্রামের কোন সম্পর্কই নেই। তবুও বাঙালির ঐতিহ্য বাঙালি অহংকার। কেন এই ঐতিহ্য? সংক্ষেপে বলিনি কলকাতার ট্রামের ইতিহাস টুকু।
১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় প্রথম ট্রাম পরিষেবা চালু হয়। রুট ছিল আর্মেনিয়া ঘাট থেকে শিয়ালদহ পর্যন্ত। ভারতীয় উপমহাদেশের এটি প্রথম ট্রাম। কিন্তু তৎকালীন জীবনযাপনে যাত্রীর অভাবে এই ট্রাম বন্ধ হয়ে যায়। তবে কিছু সময়ের মধ্যেই লন্ডনের একটি কোম্পানি ক্যালকাটা ট্রামওয়েজ এর হাত ধরে আবার শুরু হয় ট্রামের জীবন। প্রথম প্রথম ট্রাম টানা হতো ঘোড়া দিয়ে তারপর স্টিম ইঞ্জিন এর সাহায্যে ট্রাম চলত। আরো পরের দিকে বৈদ্যুতিকরণ শুরু হয়। যে যুগে ট্রাম চালু হয় তখন রাস্তাতে গরুর গাড়ি চলতো ঘোড়ার গাড়ি চলতো পালকি যেত। কিন্তু বর্তমানে তো আর সেসব নেই অনেক গাড়ি ঘোরার পরিমাণ বেড়েছে। সেই ফিটন গাড়ির গতি আজ কলকাতার রাস্তায় অন্তত কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না। এদিকে রাস্তার আয়তন আর বাড়েনি। ফলত দৈনন্দিন জীবনযাপনে রাস্তায় গাড়ি ঘোড়ার চাপে জ্যামও বাড়তে থাকে। এই কারণেই দীর্ঘদিন ধরেই ট্রাম বন্ধ করে দেওয়ার পরিকল্পনায় অল্প করে ট্রাম এর সংখ্যা কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। গতকাল শুনলাম বন্ধ হয়ে যাবে। আবার আজ দেখলাম যে না পুরোটা বন্ধ হয়ে যাবে না কেবলমাত্র ময়দান এলাকাতে তিন কিলোমিটার পথে ট্রাম চলবে।
আজ থেকে প্রায় ১৬-১৭ বছর আগে আমি যখন কলকাতায় থাকতাম তখনই আমার সাথে ট্রামের বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। রোজ সকাল বেলায় ছটায় ঘুম থেকে উঠে স্নান করে রেডি হয়ে হেদুয়া বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে দাঁড়াতাম যদিও বাসের কোন অপেক্ষায় ছিল না। অপেক্ষা করতাম কখন দূর থেকে ক্যাকোফনিক রাস্তায় ঘণ্টা বাজাতে বাজাতে ট্রাম আসবে আর আমি টুক করে উঠে পড়বো। চলন্ত ট্রামে ওঠার আলাদা মজা আছে, সেই মজাটা আমি প্রায় মাছ ছয় পর থেকে নিতে শুরু করি। একে এক কথায় দুঃসাহসও বলে চলে। কলেজ যাওয়ার সময় কখনো ট্রামে ওঠা মিস হয়ে গেলেও কলেজ থেকে যখন ফিরতাম ট্রাম ছাড়া কোন গতিই ছিল না কারণ এই রাস্তাটা আটটা সাড়ে আটটার পর থেকে ওয়ান হয়ে যেত। কত লোক ফটোশুট করত ভিডিও শুটিং করত একদিন আমি জিজ্ঞেস করলাম ট্রামলাইনে কেন। আস্তে আস্তে বুঝতে শিখি ট্রামের আলাদা ঐতিহ্য আছে যা বহু বছর ধরে বিদেশি পর্যটকদের কাছেও অত্যন্ত আকর্ষণীয়। কলকাতায় যারা বেড়াতে এসে হেরিটেজ ওয়াক করে তাদের কাছে তো বটেই। কত কবিদের কবিতা এই ট্রামে বসে তৈরি হয়েছে কত প্রেমিক প্রেমিকা একসাথে প্রেম করেছে, কত প্রেমের নিষ্পত্তি ঘটেছে ট্রামের পিছন সিটে, তা কেবলমাত্র বোবা ট্রামগুলোই জানে।
যখন প্রথম শুনলাম ট্রাম একেবারে উঠে যাবে বড্ড নস্টালজিক হয়ে পড়েছিলাম। আজও কত কবির কত কবিতায় ট্রাম লাইন উঠে আসে তা কবিরা নিজেও জানেন না। কবিদের কথা বলতে গেলে সব থেকে বেশি উল্লেখযোগ্য জীবনানন্দ দাশ। তার মৃত্যুই তো ঘটেছিল ট্রামে চাপা পড়ে। যদিও সেটা দুর্ঘটনা ছিলনা আত্মহত্যা তা নিয়ে আজও কোন কিছু স্বচ্ছ নয়।
শুধু ট্রাম নয় কলকাতার রাস্তায় ট্রামলাইনটাই যেন মস্ত ইতিহাস মাথায় করে শুয়ে আছে। যুগের পরিবর্তন মানুষের পরিবর্তন সাজ পোশাক হাঁটাচলা কথা বার্তা সবমিলিয়ে কত মানুষ এলো কত মানুষ গেল এই ট্রামলাইন সবকিছুর নীরব দর্শক। এতখানি নষ্টালজিয়া কলকাতার বাঙালি কিভাবে এক লহমায় ঝেড়ে ফেলে দিতে পারে? তবে সরকারি সিদ্ধান্ত যে খুব ভুল তা নয়, বর্তমানে দ্রুততম যানবাহনের চাপে ট্রাম যেন পিছিয়ে পড়ছিল এছাড়াও ট্রাম ডিপোতে অনেকটা জায়গা পরিতক্ত হয়ে রয়েছে। মানে রোজকার ব্যবহৃত ট্রাম গুলো যেখানে থাকে সেই জায়গাটা ছাড়া বাকি অনেকটাই জায়গা জুড়ে ভাঙ্গা ট্রাম রয়েছে ঘাস গজিয়ে গেছে, গাছ গজিয়ে গেছে। ট্রাম উঠে গেলে হয়তো এই জায়গা গুলো নিয়ে কিছু ভাববে সরকার। হয়তো বা কিছুই ভাববে না৷
দেশের উন্নয়ন সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে ঘটুক এ আমিও চাই। তবে এতদিনের ঐতিহ্য এত দিনের অলংকার যা কলকাতার গর্ব, যা কলকাতাকে অন্য রূপে সাজিয়ে তোলে তা একেবারে ইতিহাস হয়ে যাবে বা মিউজিয়ামে গেলে তাকে দেখা যাবে এই জিনিসটা মেনে নিতে আমারও কোথাও কষ্ট হয়। সেক্ষেত্রে ট্রাম পরিষেবার উন্নয়ন ঘটিয়ে বিদেশে যেভাবে চালানো হয় সেভাবেই খানিকটা ব্যবস্থা নিলে হয়তো টিকে থাকবে।
কি জানি কি হবে ভবিষ্যতে আপাতত ময়দানের তিন কিলোমিটার পথে ট্রামের বাতি ধিকধিক করে জ্বলবে। হাজার খারাপের মধ্যেও এইটুকু আলো বলা চলে। এই আলোটুকু বেঁচে থাক কলকাতার বুকে এই আশায় রাখি।
বন্ধুরা, আপনারা যারা কলকাতায় আসবেন কখনো বেড়াতে অবশ্যই ট্রাম চড়বেন, ট্রামে বসার আলাদা অনুভূতি আছে। প্রায় তিন বছর রোজদিন ট্রামে চড়েছি৷ কতবার টিকিট টিকিটচেকারের সাথে গল্প করতে করতে টিকিটই কাটতে ভুলে গেছি। সব মিলিয়ে গ্রামের গন্ধই আলাদা। আপনারা সবাই প্রার্থনা করবেন এই ঐতিহ্য টিমটিম করে হলেও যেন কলকাতার বুকে জ্বলতে থাকে। আমি বিশ্বাস করি আমাদের সবার প্রার্থনা বিফলে যাবে না।
আপনাদের সবাইকে আমন্ত্রণ জানাই কলকাতার ট্রাম চড়ার জন্য।
পোস্টের ধরণ | জেনারেল রাইটিং |
---|---|
লোকেশন | পুণে,মহারাষ্ট্র |
ব্যবহৃত অ্যাপ | ক্যানভা, অনুলিপি |
৫% বেনেফিশিয়ারি এবিবি স্কুলকে এবং ১০% বেনেফিশিয়ারি লাজুকখ্যাঁককে
~লেখক পরিচিতি~
আমি নীলম সামন্ত। বেশ কিছু বছর কবিতা যাপনের পর মুক্তগদ্য, মুক্তপদ্য, পত্রসাহিত্য ইত্যাদিতে মনোনিবেশ করেছি৷ বর্তমানে 'কবিতার আলো' নামক ট্যাবলয়েডের ব্লগজিন ও প্রিন্টেড উভয় জায়গাতেই সহসম্পাদনার কাজে নিজের শাখা-প্রশাখা মেলে ধরেছি। কিছু গবেষণাধর্মী প্রবন্ধেরও কাজ করছি। পশ্চিমবঙ্গের নানান লিটিল ম্যাগাজিনে লিখে কবিতা জীবন এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি৷ ভারতবর্ষের পুনে-তে থাকি৷ যেখানে বাংলার কোন ছোঁয়াই নেই৷ তাও মনে প্রাণে বাংলাকে ধরে আনন্দেই বাঁচি৷ আমার প্রকাশিত একক কাব্যগ্রন্থ হল মোমবাতির কার্ণিশ ও ইক্যুয়াল টু অ্যাপল আর প্রকাশিতব্য গদ্য সিরিজ জোনাক সভ্যতা।
কমিউনিটি : আমার বাংলা ব্লগ
আমার বাংলা ব্লগ পরিবারের সব্বাইকে আমার আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন৷ ভালো থাকুন বন্ধুরা। সৃষ্টিতে থাকুন।
Upvoted! Thank you for supporting witness @jswit.
Downvoting a post can decrease pending rewards and make it less visible. Common reasons:
Submit
ট্রাম নিয়ে আপনার লেখাটা পড়ে একটু খারাপই লাগছে। এটা গতকাল আমি দেখেছি স্যোসাল মিডিয়ায়। ট্রাম কলকাতার একটা ঐতিহ্য। আমার ইচ্ছা ছিল কখনও কলকাতা গেলে ট্রামে উঠব। কিন্তু সেই আশার সমাপ্তি এখানেই। ব্যাপার টা খুবই খারাপ লাগছে। ট্রাম চলাচল একেবারে বন্ধ হয়ে গেল।
Downvoting a post can decrease pending rewards and make it less visible. Common reasons:
Submit
একেবারে বন্ধ হয়নি৷ ময়দানের ওখানে তিন কিলোমিটার চলবে। তবে একে প্রায় বন্ধই বলা চলে৷ খুবই দুঃখজনক৷ সমস্ত বড় বড় দেশে ট্রাম কত চলে। আমাদের বন্ধ হয়ে যাবে৷ 😔
Downvoting a post can decrease pending rewards and make it less visible. Common reasons:
Submit
https://x.com/neelamsama92551/status/1838995791798833159?t=ydxO1QdDnvialzlEgUZAoA&s=19
Downvoting a post can decrease pending rewards and make it less visible. Common reasons:
Submit