প্রথম বার কলকাতায় ঠাকুর দেখা। (10 % @shy-fox এবং 5% @abb-school এর জন্য বরাদ্দ)

in hive-129948 •  2 years ago 

নমস্কার, আশা করি সকলে খুব ভালো আছেন।

আমি কদিন আগেই দুর্গা ঠাকুরদেখা নিয়ে একটা পোস্ট করেছি। এবার আমি আমার প্রথমবার কলকাতার ঠাকুর দেখার অভিজ্ঞতা নিয়ে পোস্ট করছি। আমার মামা বাড়ি কলকাতায় হওয়া সত্ত্বেও আমি কখনো কলকাতায় দুর্গাপুজোয় ঠাকুর দেখতে যাইনি। যদিও কলকাতার দুর্গাপুজো খুবই বিখ্যাত। সম্প্রতি ইউনেস্কো দ্বারা ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ হিসেবে স্বীকৃতিও পেয়েছে। ঠাকুর দেখতে না আসার কারণ ছিল মূলত হাঁটার ভয়। কলকাতায় ঠাকুর দেখতে গেলে আপনাকে অনেক অনেক হাঁটতে হবে।

গত জানুয়ারিতে আমার বিয়ে হয়। আমার শ্বশুর বাড়িও কলকাতায়। তাই এবার পঞ্চমীর দিন আমি, আমার স্ত্রী, আর বাবা-মা মিলে কলকাতায় যাই। অবশ্য যাওয়ার প্রধান উদ্দেশ্য ওর মাসী বাড়ি ও মামার দুর্গাপুজো দেখা। পঞ্চমীর দিন বিকেলবেলা আমি ও আমার স্ত্রী শ্বশুর বাড়ির আশেপাশের কয়েকটি ঠাকুর দেখি। আর ঠিক করি পরদিন অর্থাৎ ষষ্ঠীর দিন আমরা কলকাতার কয়েকটি নামকরা পুজো কমিটির ঠাকুর দেখতে যাব।

কলকাতায় ঠাকুর দেখা মানেই হেঁটে হেঁটে ঠাকুর দেখা, আর আমার বাবা মা এই ধকলটা নিতে পারবে না। তাই তাদের বাড়িতে রেখেই আমরা দুজন মিলে ঠাকুর দেখতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নি। সেইমতো পরদিন সকাল 11 টা নাগাদ আমরা বাড়ি থেকে বেরিয়ে একটি টোটো করে কয়েক মিনিটের মধ্যে চলে আসি দক্ষিণেশ্বর মেট্রো স্টেশনে। তারপর লিফ্ট দিয়ে উপরে উঠে দেখি লোকে লোকারণ্য। মেট্রোর প্রতিটি টিকিট কাউন্টারে দীর্ঘ লাইন। স্মার্ট কার্ড রিচার্জ করার মেশিনের সামনেও দেখি বেশ ভিড়। টিকিট কাউন্টারের ভিড়ের তুলনায় সে ভিড় ছিল তুলনামূলক কম। তাই সিদ্ধান্ত নিলাম দুজনের মেট্রো স্মার্ট কার্ড রিচার্জ করে মেট্রো ধরব। প্রায় আধঘন্টা লাইনে দাঁড়িয়ে আমার এবং আমার বউয়ের স্মার্ট কার্ড দুটি রিচার্জ করে উঠে গেলাম প্লাটফর্মের দিকে। সঙ্গে সঙ্গে উঠে পরলাম দাঁড়িয়ে থাকা একটি মেট্রোতে। মেট্রোটি ততক্ষণে প্রায় ভরে গেছে। ট্রেনটি যত এগোতে থাকে যত ততই ভিড় হতে থাকে। তবে সেন্ট্রাল স্টেশনে এসে বেশ খানিকটা খালি হয়ে যায়। তাই সহজেই আমরা শোভাবাজার - সুতানটি স্টেশনে নামতে পারি।

IMG_20221001_122848.jpg

শোভাবাজার রাজবাড়ি

আমাদের উদ্দেশ্য ছিল প্রথমে শোভাবাজার রাজবাড়ি, তারপর আহিরীটোলা, বেনিয়াটোলা, কুমারটুলি পার্ক, কুমারটুলি সর্বজনীন, বাগবাজার সর্বজনীন এই পুজো গুলো দেখব। কলকাতায় এত দুর্গাপুজো হয় যে একদিনে সব দেখে শেষ করা সম্ভব নয়।

যেমন ভাবনা তেমন কাজ। স্টেশন থেকে দুই নম্বর গেট দিয়ে বেড়িয়ে মোড়ের মাথায় আসতেই এক পথচারীর কাজ থেকে জেনে নিলাম শোভাবাজার রাজবাড়ি কোনদিন। মোড় থেকে সোজা ডান দিকের রাস্তা ধরে এগোতেই চোখে পড়ল উৎসাহী ছেলে মেয়েদের ভিড়। আরো কিছুটা এগোতেই বাম দিকে চোখে পড়ল বিখ্যাত শোভাবাজার রাজবাড়ি। জানা যায় পলাশীর যুদ্ধের বছর অর্থাৎ 1757 সাল থেকে এই পুজো হয়ে আসছে বংশ পরম্পায়।

IMG_20221001_122802.jpg

শোভাবাজার রাজবাড়ির প্রবেশ পথ

IMG_20221001_122949.jpg

IMG_20221001_122959.jpg

IMG_20221001_123054.jpg

IMG_20221001_123058.jpg

IMG_20221001_123104.jpg

লোকেশন

গেট দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করতেই সাদা রঙের দোতলা বাড়ি চোখে পড়ল। মাঝে রয়েছে খোলা আঙানা, যার চারদিক ঘিরে রয়েছে বাড়ি, ঢোকার এবং বেরোনোর জন্য দুটো গেট রয়েছে। মাঝখানের ফাঁকা জায়গার উত্তরে রয়েছে দুর্গা দালান। এখানকার মাতৃ প্রতিমা সাবেকি ও সুন্দর। বাড়ির ভেতরের ফাঁকা জায়গায় সবাই যে যার মত ছবি তুলতে ব্যস্ত। আমরাও বেশ কয়েকটি ছবি তুলে সেখান থেকে বেরিয়ে এলাম।

বেড়িয়ে আসতে চোখে পড়লো সামনেই অপর একটি রাজবাড়ি। শোভাবাজার রাজবাড়ির অপর একটি বাড়ি যেটি গোপীনাথ বাড়ি নামে বিখ্যাত। ভেতরে প্রবেশ করতে দেখলাম সেখানেও দুর্গাপুজা হচ্ছে। প্রতিমার সাজসজ্জার শেষ সময়ের কাজ চলছে। সেই একই ধরনের সাবেকি দোতলা বাড়ি, অতীব সুন্দর তার কারুকার্য। একটা নস্টালজিক ব্যাপার রয়েছে এই শতাব্দী প্রাচীন পুরনো সেই বাড়ি এবং সেখানকার পুজোকে ঘিরে। এই বাড়িতেই রয়েছে গোপীনাথজির মন্দির।

IMG_20221001_123733.jpg

IMG_20221001_123813.jpg

গোপীনাথ বাড়ি

IMG_20221001_123829.jpg

লোকেশন

রাজবাড়ীর প্রতিমা দেখে আমরা এগিয়ে গেলাম সেই মোড়ের দিকে। তারপর সেই মোড়ের প্যান্ডেল ও প্রতিমা দেখে অটো চড়ে দুজনে চললাম আহিরীটোলার দিকে। খানিক পরে পৌঁছালাম আহিরীটোলায়। এখানে বিভিন্ন রকম বাদ্যযন্ত্র ও গানের বিভিন্ন সামগ্রী নিয়ে সুন্দর একটি প্যান্ডেল তৈরি করা হয়েছে। সেই প্যান্ডেলের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে প্রতিমাটিও তৈরি করা হয়েছে। এটি কলকাতার একটি নামকরা দুর্গাপুজো।

IMG_20221001_125725.jpg

আহিড়ীটোলা

IMG_20221001_125742.jpg

IMG_20221001_125926.jpg

IMG_20221001_125932.jpg

লোকেশন

এখান থেকে আমরা হেঁটে হেঁটে এগিয়ে চললাম বেনিয়াটোলার দিকে। পথের মাঝে পরলো আহিরটোলা যুবকবৃন্দ পূজা প্যান্ডেল। সেখানে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে তাঁতির বাড়ি। তাদের কিভাবে জীবন কাটে সেটা এখানে তুলে ধরেছে। প্রতিমাও সেই থিমের সাথে সামঞ্জস্য রেখে তৈরি করেছে।

IMG_20221001_130910.jpg

IMG_20221001_130924.jpg

আহিড়ীটোলা যুবকবৃন্দ

IMG_20221001_131022.jpg

IMG_20221001_131028.jpg

IMG_20221001_131050.jpg

লোকেশন

এরপর এখান থেকে আমরা যাব বেনিয়াটোলা কিন্তু রাস্তা হারিয়ে আমরা চলে গেলাম কুমোরটুলির দিকে। অনেকক্ষণ ধরে হাঁটার পর আমরা পৌঁছে গেলাম কুমোরটুলি পার্ক সার্বজনীন পূজা কমিটির প্যান্ডেলের সামনে। এখানে প্লাইউড এবং স্টিলের থালা দিয়ে প্যান্ডেল তৈরি করা হয়েছে। মন্দিরের ভিতরে প্রবেশ করতেই মনে হল যেন সমুদ্রের ভেতরে প্রবেশ করেছি। সমুদ্রের ভেতরে যেমন ডুবুরি নামে, মাছেরে ঘুরে বেড়াই তেমন একটা পরিবেশ তৈরি করা হয়েছে। দেখে মনে হচ্ছে যেন সমুদ্রের ভেতরে থাকা একটি গুহার ভেতরে আমরা পৌঁছে গেছি। ভেতরটা খুব সুন্দর করে গোছানো হয়েছে, যা সত্যিই অসাধারণ।

IMG_20221001_132641.jpg

কুমারটুলি পার্ক

IMG_20221001_133019.jpg

IMG_20221001_133141.jpg

লোকেশন

এখান থেকে বেরিয়ে আমরা চললাম করলাম কুমোরটুলি সর্বজনীন দুর্গোৎসব পূজা কমিটির মন্দির ও প্রতিমা দর্শন করতে। এখানে চলার পথে আশেপাশে চোখে পরলো কুমোরটুলির মৃৎশিল্পীদের নানান কারখানা, যেখানে নানান প্রতিমা নির্মিত হচ্ছে। ছোট বড় নানা রকমের মাতৃ প্রতিমা তৈরি করছেন মৃৎশিল্পীরা। সূর্যের তাপ ছিল ভীষণ, হাঁটতে হাঁটতে বারবার গলা শুকিয়ে আসছিল। এখানে চলার পথে এতটাই তৃষ্ণার্ত হয়ে পড়ি যে রাস্তার ধারে থাকা দোকান থেকে আমরা দুজন দুই লেবু জল কিনে খেতে বাধ্য হই। লেবু জল খেয়ে আবার নতুন উদ্যমে হাঁটা শুরু করি।

হাঁটতে হাঁটতে অবশেষে পৌঁছে যাই কুমারটুলি সর্বজনীন পুজো কমিটির মন্দির প্রাঙ্গণে। এই পুজো কমিটির এ বছরের থিম কুমোরটুলির শিল্পীদের নামে উৎসর্গকৃত। এখানে তাদের নাম নানা ভাবে প্যান্ডেলের নানা জায়গায় তুলে ধরা হয়েছে। এভাবে খুব সুন্দর মায়ের মন্দির তৈরি করা হয়েছে। মাতৃ প্রতিমাও সকলের খুব দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে।

IMG_20221001_134803.jpg

IMG_20221001_134916.jpg

কুমারটুলি সর্বজনীন

IMG_20221001_134947.jpg

IMG_20221001_135134_1.jpg

IMG_20221001_135206.jpg

IMG_20221001_135443.jpg

লোকেশন

হেঁটে হেঁটে ঠাকুর দেখতে দেখতে আমাদের দুজনের পা এত ব্যথা হয়ে যায় যে আর হাঁটতে পারি না। শেষে কাছের গঙ্গার ধারে থাকা বিশ্রামাগারে আমি ও আমার স্ত্রী প্রায় আট ঘন্টা বসে বিশ্রাম নি। তারপর জল পান করে দুজনে হাঁটা শুরু করি।

এবার আমাদের গন্তব্য বাগবাজার সর্বজনীন পুজো কমিটি। হাঁটতে হাঁটতে কুমারটুলি মোড়ের মাথায় এসে একটি অটো ধরে খুব তাড়াতাড়ি পৌঁছে গেলাম বাগবাজার সর্বজনীন পুজো কমিটির মন্দিরের কাছে। অটো থেকে নেমে ভাড়া মিটিয়ে দুজনে চললাম মন্দির দর্শন করতে। এখানে বেশ খানিকটা ফাঁকা জায়গা নিয়ে গড়ে উঠেছে পুজো প্যান্ডেল। প্যান্ডেলের পাশে সুন্দর মেলা বসেছে। নাগরদোলার সাথে রয়েছে অনেক দোকানপাট। সুন্দর একটা পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। ঠাকুর দেখতে আসা দর্শনার্থীদের অনেক কিছু কেনাকাটা করতেও দেখা গেল। প্যান্ডেল দর্শন করে আমরা প্রবেশ করলাম প্যান্ডেলের ভেতরে। আমি আগে থেকেই জানতাম এখানকার মাতৃ প্রতিমা বেশ বড় হয়, তবে কতটা বড় তার আন্দাজ ছিল না। এসে দেখলাম প্রায় ৩০ ফুট উঁচু একচালার অতি সুন্দর মাতৃ প্রতিমা। প্রতিমা ঠাকুর দর্শন করে আমরা বাইরে বেরিয়ে এলাম এবং মাঠে দাঁড়িয়ে আগের কেনা আমুল কুল দুটি খেয়ে নিলাম।

IMG_20221001_143423.jpg

IMG_20221001_143452.jpg

বাগবাজার সর্বজনীন

IMG_20221001_143837.jpg

IMG_20221001_143740.jpg

লোকেশন

এরপর এগিয়ে চললাম বাগবাজার বাটা মোড়ের দিকে। যাওয়ার পথে নব বাগবাজার ও তাল বেতাল পুজো কমিটির ঠাকুর ও প্যান্ডেল দর্শন করলাম। দুটো প্রতিমাই অসাধারণ সুন্দর। তাল বেতাল এর প্রতিমা শিল্পী চন্দননগরের অনুপ পাল। তাই প্রতিমার আদল সেখানকার বিখ্যাত জগদ্ধাত্রী প্রতিমার মতো।

IMG_20221001_145322.jpg

IMG_20221001_145401.jpg

IMG_20221001_145452.jpg

নব বাগবাজার

IMG_20221001_145929.jpg

IMG_20221001_145959.jpg

তাল বেতাল

এরপর অনেকখানি হেঁটে ক্লান্ত অবসন্ন হয়ে পৌঁছালাম বাগবাজার বাটার মোড়ে। সেখানে পৌঁছে তৃষ্ণা দূর করতে প্রথমে এক বোতল জল কিনলাম। তারপর দুই গ্লাস আখের রস খেয়ে বাসে উঠলাম দক্ষিণেশ্বরে যাওয়ার উদ্দেশ্য। শরীর এতটাই ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল যে সিঁথির মোড়ের দুটো নামকরা পুজো প্যান্ডেল দেখার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছিলাম। সাড়ে চারটে নাগাদ আমরা দুজনে দক্ষিণেশ্বরে পৌঁছালাম। আমার প্রথম বার কলকাতার ঠাকুর শেষ হল এভাবেই।

Heroism_Second.png

আশা করি সকলের খুব ভালো লাগবে। সকলে ভালো থাকবেন।

Banner(1).png

ক্যামেরা
ফটোগ্রাফার
ভিভো জেড ১ প্রো
@pap3

3jpR3paJ37V8JxyWvtbhvcm5k3roJwHBR4WTALx7XaoRovUdcufHKutmnDv7XmQqPrB8fBXG7kzXLfFggSC6SoPdYYQg44yvKzFDWktyjCspTTm5NVQAdTm7UoN34AAMT6AoF.gif

🏵️ ধন্যবাদ 🏵️

E8fRY4dhuR5sTLZsFHQGy2Dnv1izoNa9kDDwNf6SWjwUiF4nkVKP1PC25WhWdSqY9SQf2TJzmqgxFMWjuNkHw5XsLARCErjQCJttWSghQw.HWK2gGpEFGB8xQqyomTH1nvn7CPz2SMnooXwX61WyzcpU63uoNSxy8gfgvGdwRzK9nB2bEQrLPQvvnQVp6n6xDEV7NQgpdcANjWF3XJwB2tbgXcKKDcWfvHLG6.png

Authors get paid when people like you upvote their post.
If you enjoyed what you read here, create your account today and start earning FREE STEEM!
Sort Order:  

প্রথমবারের মতো ঠাকুর দেখার অনুভূতি উপরে অনেক ভালো লাগলো। আপনি ঠাকুর দেখার সুন্দর ফটোগ্রাফি করে আমাদের সাথে শেয়ার করেছেন।
আপনার জন্য শুভকামনা রইল

সুন্দর কমেন্ট করে আমাকে উৎসাহিত করার জন্য অনেক অনেক ধন্যবাদ ভাইয়া।