একটি পরীক্ষার জন্য আমার দুর্গাপুর যাওয়া, যার এক্সাম সেন্ট্রার ছিল আসানসোলে। যখন জানতে পারলাম পরীক্ষাটি আসানসোলে পড়েছে তখনই ঠিক করলাম আগের দিন আসানসোল বা তার কাছাকাছি কোথাও চলে যাব, যাতে পরদিন সকালে খুব সহজেই এক্সাম সেন্টারে যাওয়া যায়। যেমন ভাবা তেমনি কাজ। হঠাৎ করে বন্ধু অতনুর কথা মনে পড়ল যার বাড়ি দুর্গাপুরে। তাই অতনুর সাথে কথা বলে ট্রেনের টাইমিং দেখে যাওয়া এবং আসার টিকিট কেটে নিয়েছিলাম ফোন থেকেই। যাওয়ার জন্য নৈহাটি থেকে শিয়ালদহ-আসানসোল সুপারফাস্ট ট্রেনের টিকিট বুক করি। যেহেতু পরীক্ষা দিয়ে ঐদিন কলকাতা ফিরবো তাই আসানসোল থেকে শেওড়াফুলি পর্যন্ত হাওড়াগামী ব্ল্যাক ডাইমন্ড এক্সপ্রেস ট্রেনের টিকিট বুক করি। দুটো টিকিটই ফোন থেকে বুক করলাম আইআরসিটিসি অ্যাপ থেকে। পরীক্ষার দশ দিন আগেই আমার টিকিট কাটা হয়ে গেলো।
এরপর যথাসময়ে আমি বহরমপুর স্টেশন থেকে পরীক্ষার আগের দিন যাত্রা শুরু করি। দুর্গাপুর যাওয়ার জন্য গত মাসের ২১ তারিখ দুপুর ১.০০ টার ট্রেন ধরেছিলাম। ঠিক ছিল বহরমপুর থেকে ট্রেন ধরে প্রথমে আমি কৃষ্ণনগর নামব তারপর কৃষ্ণনগর থেকে কৃষ্ণনগর-শিয়ালদহ লোকাল ধরে নৈহাটি স্টেশনে নামব। নৈহাটি থেকে শিয়ালদহ-আসানসোল সুপারফাস্ট ট্রেন ধরে সোজা পৌঁছে যাব দুর্গাপুর। সেইমতো ট্রেনে উঠে পরলাম। যথারীতি দুপুর ২.৫০ নিগাদ পৌঁছে গেলাম কৃষ্ণনগরে। এর শুরু হল বিপত্তি।
কৃষ্ণনগর স্টেশন
লোকেশন
কৃষ্ণনগর স্টেশনে নেমেই শুনতে পেলাম রানাঘাটের আগে ওভার হেডের তার ছিড়ে যাওয়ায় ট্রেন চলাচল বন্ধ আছে। আপ ট্রেনগুলি পায়রাডাঙ্গা স্টেশনে দাঁড়িয়ে আছে। এইভাবে প্রায় ঘন্টাখানেক কৃষ্ণনগর স্টেশনে কৃষ্ণনগর লোকাল এর জন্য অপেক্ষা করতে থাকলাম। শেষমেষ দুপুর ৩.৪৫ নাগাদ সিদ্ধান্ত নিলাম বাসে করে কল্যাণী অথবা নৈহাটি পৌঁছাব।
সেইমতো কৃষ্ণনগর স্টেশন থেকে বেরিয়ে একটি টোটো ধরলাম ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়ক যাওয়ার জন্য। কিছুক্ষণের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম জাতীয় সড়কের ধারের বাসস্টপে। সেখানে ৫ মিনিট অপেক্ষা করার পর মায়াপুর থেকে কলকাতা গামী একটি বাস পেয়ে উঠে পড়লাম। বিকেল ৪.০৫ নাগাদ সেখান থেকে রওনা হলাম কল্যাণীর উদ্দেশ্যে। প্রায় দু'ঘণ্টা পরে ফুলিয়া বাইপাস হয়ে আমি পৌঁছালাম কল্যাণী মোড়ে। আমার মতোই কলকাতা যাওয়ার কথা ছিল প্রশান্ত (প্রশান্ত রায়) কাকুর। যার সাথে কৃষ্ণনগর স্টেশনে টোটোতে উঠে আলাপ। কাকুর রাত ৮.৫০ এ আলিপুরদুয়ার যাওয়ার ট্রেন আছে শিয়ালদহ স্টেশন থেকে। পেশায় সেল্স ম্যানেজার প্রশান্ত কাকু জরুরি কাজে বাড়ি ফিরবেন। তাই আমরা দুজনেই একই সাথে বাসে উঠেছি আবার একই সাথেই কল্যাণী মোড়ে নামি। সেখান থেকে একটি টোটো রিজার্ভ করে আমি, প্রশান্ত কাকু আর একটি ছেলে তিনজনে মিলে চললাম কল্যাণী স্টেশনের দিকে। প্রায় আধ ঘন্টা পর আমরা পৌঁছালাম কল্যাণী স্টেশনে। সেখান থেকে শান্তিপুর লোকালে চেপে ৬:৫০ নাগাদ আমি পৌঁছালাম নৈহাটি স্টেশনে। নামার আগে কাকুকে বিদায় ও আগামী যাত্রীর শুভেচ্ছা জানালাম, সাথে ফোন নম্বরও বিনিময় করলাম।
নৈহাটি স্টেশনে যখন পৌঁছালাম ততক্ষণে দুর্গাপুর যাবার সব এক্সপ্রেস ও সুপারফাস্ট ট্রেন চলে গেছে। তাই বাধ্য হয়ে দুবার লোকাল ট্রেন বদলে আমাকে বর্ধমান পর্যন্ত যেতে হবে। যেমন ভাবা তেমন কাজ। তখনই মোবাইলে দেখে নিলাম ব্যান্ডেল যাওয়ার ট্রেন কখন। দেখলাম সন্ধ্যা ৭.১৫ তেই একটি নৈহাটি - ব্যান্ডেল লোকাল রয়েছে। তাই দৌঁড়ে গিয়ে নৈহাটি স্টেশনের টিকিট কাউন্টার থেকে বর্ধমান পর্যন্ত টিকিট কাটলাম। টিকিট কাটতে কাটতে দেখলাম নৈহাটি-ব্যান্ডেল লোকাল ততক্ষণে চলে এসেছে দুই নম্বর প্ল্যাটফর্মে। টিকিট কাউন্টার থেকে বেরিয়ে কিছুটা দৌঁড়ে প্ল্যাটফর্মের উল্টো দিক দিয়ে ট্রেনে উঠলাম। তবে কিছুতেই উঠতে পারছিলাম না ট্রেনে। ট্রেনের ভিতরে দাঁড়িয়ে থাকা দাদা আমাকে গায়ের জোরে টেনে উপরে তুললেন। তারপর সেই ট্রেনে করে পৌঁছালাম হুগলি নদী পেরিয়ে ব্যান্ডেল স্টেশনে।
ব্যান্ডেল স্টেশন
লোকেশন
আগেই মোবাইলে দেখে নিয়েছিলাম লিংক ট্রেনগুলি। ভেবে রাখলাম রাত ৯টার মধ্যে বর্ধমান পৌঁছে ৯.১৫ এর বিভূতি এক্সপ্রেসে চেপে দুর্গাপুর যাব। তাই ৭.৩৫ নাগাদ ব্যান্ডেল পৌঁছে পূর্ব পরিকল্পনা মতো ৭.৫১ এর ব্যান্ডেল-বর্ধমান লোকাল ট্রেন ধরলাম সাত নম্বর প্লাটফর্ম থেকে তিন নম্বর প্লাটফর্মে গিয়ে। ট্রেন যখন বর্ধমানের দিকে ছুটে চলেছে তখন জানতে পারলাম ট্রেনটি আদৌ ৭.৫১ এর গেলপিং বর্ধমান লোকাল নয়, এটি ৭.৩৩ এর বর্ধমান লোকাল, যেটি প্রায় ২০ মিনিট লেটে চলছে। লোকাল ট্রেনটি যত বর্ধমান স্টেশনের দিকে এগোতে থাকে ততই খালি হতে থাকে। বর্ধমানের কয়েকটি স্টেশন আগে গোটা কম্পার্টমেন্টে মাত্র তিনজন ছিলাম।
ফাঁকা বর্ধমান লোকাল
এই স্টেশনের আগেই ট্রেন দাঁড়িয়ে ছিল।
আমি অনেক আগে একটা গল্প পড়েছিলাম তাতে রাতের বর্ধমান লোকালে নাকি গলাকাটা ভূত দেখা যায়। এমন যখন ভাবছি তখন হঠাৎ ফোন বেজে উঠল, ফোনের অপর প্রান্তে ভেসে উঠলো আমার স্ত্রীর গলা। কোথায় পৌঁছেছি জানিয়ে ফোন রেখে দিলাম। ট্রেনটি শক্তিগড় স্টেশনের আগে হঠাৎই মাঝপথে দাঁড়িয়ে পরলো। আমি দেখতে থাকলাম দুপাশ থেকে ক্রমাগত ট্রেন যাতায়াত করছে কিন্তু আমাদের ট্রেনটা একভাবে দাঁড়িয়ে আছে। প্রায় ২০ মিনিট ট্রেনটি দাঁড়িয়ে ছিল ঐ নির্জন স্থানে। ট্রেনটি পরে যখন শক্তিগড় স্টেশনে পৌঁছালো তখন মনে পড়লো এই স্থানের জিভে জল আনা বিখ্যাত ল্যাংচার কথা। আমি প্রায় ০৯:৩০ নাগাদ বর্ধমান স্টেশনে পৌঁছায়।
রাতের বর্ধমান স্টেশন
আমাদের বর্ধমান লোকালটি দাঁড়ালো পাঁচ নম্বর প্লাটফর্মে। সেখান থেকে ছুটে এক নম্বর প্লাটফর্মে সেখানে গিয়ে জানতে পারি, বিভূতি এক্সপ্রেসটাও চলে গেছে অনেকক্ষণ। মোবাইলে দেখি শেষ ট্রেন দেখাচ্ছে রাজেন্দ্রনগর টার্মিনাল এক্সপ্রেস। রাত ৯.৩৮ নাগাদ ট্রেনটি বর্ধমান স্টেশনে এসে পৌঁছালো। আমার ট্রেন শিয়ালদহ-আসানসোল সুপারফাস্ট ট্রেনটি বর্ধমান ছেড়ে গেছে প্রায় দু'ঘণ্টা আগে। তাই এই বর্ধমান - দুর্গাপুর যাত্রাপথটুকু টিকিট ছাড়াই যাত্রা করব ভেবে নিয়ে উঠে পরলাম রাজেন্দ্রনগর এক্সপ্রেস ট্রেনে। কারণ বর্ধমান ঢুকে টিকিট কাটার আর সময় পাইনি। এরপর একটি জেনারেল কামড়ায় উঠে কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরির পর একটি বসার জায়গা পেলাম।
এক অজানা অচেনা ব্যক্তির সাথে গল্প করতে করতে জানতে পারলাম তার নাম মনোজ পান্ডে। তিনি চলেছেন দেশের বাড়ি ঝাঁঝার উদ্দেশ্যে। মনোজদার সাথে অনেক বিষয়ে অনেক গল্প করলাম। গল্প করতে করতে ঘন্টাখানেকের মধ্যে দুর্গাপুর পৌঁছে গেলাম। দুর্গাপুর যখন পৌঁছালাম তখন ঘড়িতে বাজে রাত ১০.৪০। আমার পৌঁছানোর কথা ছিল রাত ৮.০৫ নাগাদ। অথচ সেখানে পৌঁছালাম ২ ঘন্টা ৩৫ মিনিট পরে। স্টেশনে পৌঁছে অতনু কে ফোন করলাম। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর গাড়ি নিয়ে অতনু এলো। তারপর ওর গাড়িতে করে মিনিট ১৫-২০ এর মধ্যে ওদের বাড়িতে পৌঁছে গেলাম। এইভাবে শেষ হল আমার দুর্গাপুর যাওয়ার সফর।
যাত্রাপথে বিধ্বস্ত আমি
অবশেষে দুর্গাপুর পৌঁছালাম
একটা তার ছিড়ে যাওয়ার জন্য কতটা দুর্ভোগ পোহাতে হলো।তাও ভাল শেষ পর্যন্ত পৌছাতে পেরেছিলেন।শক্তিগড়ের ল্যাংচার কথা গোপালভাড় থেকে জেনেছিলাম।আশা করি পরীক্ষা ভাল হয়েছে।শুভ কামনা রইল।
Downvoting a post can decrease pending rewards and make it less visible. Common reasons:
Submit
ধন্যবাদ। ভাগ্যিস বুদ্ধি করে বাসে কল্যাণী যেতে পেরেছে ছিলাম। আর আধঘন্টা লেট করলে কোনো ট্রেন পেতাম না। তাহলে যেতেই পারতাম না। পরীক্ষা আশানুরূপ হয়নি।
Downvoting a post can decrease pending rewards and make it less visible. Common reasons:
Submit
সত্যিই অনেক বড় একটি জার্নি শেষ করেছেন আপনি। আমি এরকম ভূতের গল্প অনেক পড়েছে এবং দেখেছি। আপনি পৌঁছানোর কথা অনেক আগেই কিন্তু পৌঁছেছেন অনেক দেরিতে। আশা করি পরীক্ষা ভালো হয়েছে। ট্রেন জার্নি সকলের পছন্দ করে। আমার কাছে তো ভীষণ ভালো লাগে। শেষ পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছেন।
Downvoting a post can decrease pending rewards and make it less visible. Common reasons:
Submit
ধন্যবাদ আপনাকে। হ্যাঁ ট্রেন জার্নি আমার খুব পছন্দের। আর রাতের বর্ধমান লোকাল এতটাই ফাঁকা যে ভুত থাকা অসম্ভব নয়। তবে পরীক্ষা আশানুরূপ হয়নি।
Downvoting a post can decrease pending rewards and make it less visible. Common reasons:
Submit
সত্যি বলতে পরীক্ষার সেন্টার দূরে পড়লে ভীষণ সমস্যা হয়। এই দিকটায় সরকার একটু নজর দিতে পারে। তোর বাড়ি থেকে অনেকটা দূর হয়ে গেছে রে। আর এরকম ফাঁকা ট্রেনে সত্যিই অনেক ভৌতিক ঘটনা নাকি ঘটে। ভালোই হয়েছে সঙ্গ পেয়ে গেছিলি একজনের।
Downvoting a post can decrease pending rewards and make it less visible. Common reasons:
Submit
হ্যাঁ খুবই অসুবিধা। লোকাল ট্রেন না থাকলে আমি ঐদিন আর যেতে পারতাম না। বর্ধমান লোকাল আমি ইচ্ছে করেই আমার ঐ সহযাত্রীর কামরায় উঠেছিলাম। কারণ ওনাকে দেখে মনে হচ্ছিল উনি রেলের লোকোপাইলট। পরে কথা বলে বুঝলাম আমার অনুমান সঠিক।
Downvoting a post can decrease pending rewards and make it less visible. Common reasons:
Submit