জীবনে যেসব জিনিস প্রথমবারের মতো পাওয়া হয় তার একটা আলাদা অনুভূতি সব সময় কাজ করে। আজ থেকে ১৫ বছর আগেও মোবাইল সেভাবে সহজলভ্য ছিল না সবার কাছে। আমি যে সময় থেকে মোবাইল ব্যাপারটা বুঝতে শিখেছি সেই সময় মোবাইলের প্রচুর দাম ছিল । আমি সর্বপ্রথম আমার পরিবারে মোবাইলের ব্যবহার দেখেছি ২০০৮ সালে। নোকিয়া ১৬০০ মডেলের মোবাইলটি প্রথমবারের মতো বাবা আমাদের বাড়িতে কিনে নিয়ে আসে। আমার সাথে ঘটেছিল প্রথমবার মোবাইল দেখার অনুভূতি যা অসাধারণ ছিল কিন্তু তখনও মোবাইল হাতে পাওয়ার অনুভূতি আমি পাইনি কারণ আমার নিজস্ব মোবাইল ছিল না তখন। আমি প্রথমবারের মতো নিজের হাতে মোবাইল পাই ২০১২ সালে এসে। সেই সময়টিতে আমি স্কুল পড়ুয়া ছাত্র। ২০১২ সালে যখন আমি আমার মোবাইল টি হাতে পাই সেটা কিন্তু আমাকে আমার পরিবারের লোক কিনে দেয়নি। আমি অল্প অল্প করে টাকা জমিয়ে এই মোবাইলটি কিনেছিলাম । সেই সময় নতুন ফোন কেনার সামর্থ্য আমার ছিল না কারণ আমি কোন কিছুই করি না তাছাড়া আমার নিজের কোন ইনকামের সোর্সও ছিল না। তাই আমি অল্প অল্প করে টাকা জমিয়ে আমার এক বন্ধুর কাছ থেকে সেকেন্ড হ্যান্ড একটি মোবাইল কিনেছিলাম । এই মোবাইলটির মডেল ছিল নোকেয়া ২৭০০ ক্লাসিক ।
আমি যখন স্কুলে যেতাম আমার হাতেগোনা দু-তিনটি বন্ধুর কাছেই সেই সময় শুধু মোবাইল থাকতো । আর স্কুলে যেহেতু মোবাইল আনা নিষেধ ছিল সেই সময় তাই তারা স্কুলে মোবাইল নিয়ে গিয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে ব্যবহার করতো। তাদের কাছে মোবাইল ফোন দেখে আমারও মোবাইল ফোন ব্যবহার করার ইচ্ছা জেগেছিল ।তারপর থেকেই অল্প অল্প করে টাকা জমানো শুরু করেছিলাম। টাকা জমানোর পদ্ধতি ছিল অন্যরকম সেই সময় নিজের পুরনো বই বিক্রি করে, খাতা বিক্রি করে, হাত খরচের টাকা জমিয়ে ২৯০০ টাকা জমিয়ে ছিলাম। সেই টাকা থেকে এই সেকেন্ডহ্যান্ড মোবাইলটি আমি ২৫০০ টাকা দিয়ে প্রথমবারের মতো কিনেছিলাম আমার এক বন্ধুর কাছ থেকে। প্রথমবারের মতো যখন এই মোবাইলটি আমার হয়ে গেল আমার তো আনন্দের শেষ নেই কিন্তু এই আনন্দ বাড়ির কারো সাথে আমি শেয়ার করতে পারবো না কারণ বাড়ির কাউকে না জানিয়ে এই মোবাইলটি আমি নিজের টাকায় কিনেছি। বাড়িতে এসে আনন্দ চেপে রেখে আমি আমার মোবাইলটিকে লুকিয়ে রেখে দিই। ছোটবেলা থেকেই আমার একটি অভ্যাস ছিল সেটি হল সব সময় আমি আমার রুমের দরজা বন্ধ করে রেখে দিতাম যা আমার জন্য অনেকটা সুবিধা হিসেবে কাজ করতো। আমি সেদিন তাড়াতাড়ি স্কুল শেষ করে এসে স্নান করে খাওয়া দাওয়া না করেই রুমের দরজা আটকে বসে পড়ি মোবাইল নিয়ে। কি কি রয়েছে কি কি করা যায় সবকিছু মিলিয়ে খুবই কৌতুহলী হয়ে উঠি আমি। সেই সময়ে বেশ জনপ্রিয় ছিল নোকিয়া ২৭০০ ক্লাসিক মডেলটি। এই মোবাইলে দুই মেগাপিক্সেলের ক্যামেরা ছিল এবং যা মোটামুটি সেই সময়ের হিসেবে ভালো ফটোই ক্যাপচার করত। আমি সেই সময় আমার বই-খাতার ফটো, টেবিলের ফটো, রুমের ফটো নিজে নিজে প্রথমবারের মতো করি আমার প্রথম কেনা মোবাইল দিয়ে।
মোবাইল কেনার সাথে সাথে আমার কাছে কিন্তু কোন সিমের ব্যবস্থা ছিল না তাই সেদিন আমার অন্য এক বন্ধু তার একটি সিম আমাকে ব্যবহার করতে দিয়েছিল কিছুদিনের জন্য । সেই সিমে অল্প কিছু টাকা ছিল আর সে আমাকে দেখিয়ে দিয়েছিল ইন্টারনেট কি করে ব্যবহার করতে হয়। আমি বাড়িতে এসে সামান্য ইন্টারনেটের ব্যবহার করেছিলাম তাও ওয়ালপেপার দেখার জন্য। ওটাই ছিল প্রথম আমার ইন্টারনেট ব্যবহার করা আমার প্রথম মোবাইলে। যাই হোক সেই সময় আমার সেই বন্ধুকে কল করে মিউজিক ডাউনলোড করা শিখেছিলাম। দু একটি গান ডাউনলোড করেও প্রথমবারের মতো শুনেছিলাম আমি আমার নিজের মোবাইলে। প্রথমবার জীবনে মোবাইল হাতে পাওয়ার অনুভূতি শুধু আমার মাঝেই ছিল আমি কারো সাথে সেই সময় শেয়ার করতে পারিনি কারণ সেই সময় যদি আমি মোবাইল কিনেছি বাড়িতে জানাতাম তাহলে মোবাইলসহ আমাকে বাড়ি থেকে বের করে দিত। আনন্দের সাথে দুঃখের আবির্ভাব ঘটতো তাহলে তখন। যাইহোক সেইদিন আনন্দের সাথে অল্প অল্প ভয়ও কাজ করছিল কেউ মোবাইলটি দেখে নিলে আমার জন্য অনেক চাপের সৃষ্টি হয়ে যাবে। তারপরও সেই দিন যে আনন্দ হয়েছিল তাও ছিল অসাধারণ, সম্পূর্ণ নতুন এবং ফ্রেশ । হাতে মোবাইলটি আসার পর নিজেকে অনেক বড় বড় মনে হচ্ছিল এবং ভিতরে ভিতরে একটু গর্ব হচ্ছিল আমিও একজন মোবাইলের মালিক এখন। আকাশের চাঁদ হাতে পাওয়ার মত ব্যাপারটি ঘটেছিল সেই সময় আমার সাথে । প্রথমবার মোবাইল হাতে পেয়ে মনের ভিতর নাচ শুরু হয়ে গেছিল যা হয়তো কাউকে দেখাতে পারছিলাম না , বলতেও পারছিলাম না কিন্তু আমার ভিতরে ভিতরে সবকিছু ঘটে যাচ্ছিল। সেই দিন বিকালে আমি খাওয়ার কথা ভুলে গেছিলাম তারপর বাড়ির লোকজনের অনেক ডাকাডাকির পরে মোবাইল বন্ধ করে আমি অল্প করে খেয়ে নি। আনন্দে সেদিন পেট ভরে খাবারও আমি খেতে পারিনি মোবাইল পেয়ে পেটের খিদে চলে গেছিল । যাইহোক কোনরকম ভাবে সামান্য কিছু খেয়ে নিজের রুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিয়ে মোবাইল নিয়ে আবার কাজে লেগে পড়ি ।
জীবনের এই প্রথম মোবাইলটি আমি অনেক বছরই ব্যবহার করেছি। লাস্ট ২০১৫ সাল পর্যন্ত আমি এই মোবাইলটি ব্যবহার করেছিলাম তারপরে সামান্য কিছু প্রবলেম চলে এসেছিল মোবাইলে তখন থেকে আর ব্যবহার করা হয়নি কিন্তু আমি এই জীবনের প্রথম মোবাইলটি স্মৃতি হিসেবে এখনো আমার কাছে রেখে দিয়েছি। ধ্বংসাবশেষ অবস্থায় রয়েছে মোবাইলটি কিন্তু জীবনের প্রথম মোবাইল বলে কথা তাই এখনো রেখে দিয়েছি আমার কাছে। এই মোবাইলটি ঘিরে কৈশোরের হাজারো স্মৃতি জড়িয়ে রয়েছে আমার।