বুক রিভিউঃ নিকোলাই গোগলের ওভারকোট।

in hive-129948 •  2 months ago 

আসসালামুআলাইকুম। কেমন আছেন আপনারা? আজ আমি আপনাদের সাথে একটি বই নিয়ে আলোচনা করবো। ঠিক পুরো বই না। বইয়ের একটি গল্প। গল্পটা একটা পুরো উপন্যাসই। কিন্তু আয়তনে ছোট হওয়ায় লেখক এটি গল্প হিসাবেই রূপ দিয়েছেন। প্রকাশকও একই পথে হেঁটেছেন। গল্পটির নাম - ওভারকোট, যা লিখেছেন ইউক্রেনের লেখক নিকোলাই গোগল৷ বই সম্পর্কে সামান্য একটু তথ্য শেয়ার করছি শুরুতে।


pexels-pixabay-159711.jpg

Photo by Pixabay

বইয়ের নামশ্রেষ্ঠ গল্প
গল্পের নামওভারকোট
লেখকনিকোলাই গোগল
অনুবাদকঅরুণ সোম
সম্পাদনাশহিদুল আলম
প্রকাশনাবিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র

লেখক সম্পর্কে

রুশ সাহিত্যে নিকোলাই গোগোলের নাম যথেষ্ট সমাদৃত। ব্যক্তিজীবনে উনি নাকি খুবই হতাশাগ্রস্ত আর মৃত্যু নিয়ে ভীত ছিলেন। এসব অবশ্য বইতেই জেনেছি। গোগল কিশোর বয়সে বাবাকে হারান। ভাগ্য অন্বেষণে নানান দেশ ঘুরে জার রাজতন্ত্রে একটি সরকারি চাকরিও লাভ করেন। কিন্তু মাত্র ৪৩ বছর বয়সে তার মৃত্যু হয়।

ঘটনা

এই গল্পের মূল চরিত্র আকাকি আকাকিয়েভিচ। পেশায় সরকারি কোন এক দপ্তরের নকলনবিশ ছিলেন। আকাকি এতটাই উপেক্ষিত ছিলেন যে লেখক চাইলে তাকে বাদ দিয়েও পুরো গল্পটা আমাদের সামনে তুলে ধরতে পারতেন। তাতে এতটুকুও অভাববোধ হতো না তার। নগণ্য মানুষের জীবনই ফুটিয়ে তুলেছেন এই চরিত্রের মাধ্যমে। আকাকি যেন আমাদের খুবই পরিচিত কেউ। যেন প্রতিদিনই এমন কাউকে আমরা দেখি। কিন্তু অতি তুচ্ছ বলেই আকাকিরা আমাদের নজরে পড়েনা।

আকাকি ছিলো একা মানুষ। পুরোদস্তুর নিঃসঙ্গ এক লোক। যে যৎসামান্য বেতন পেত, তাতে যেরকম বাসা সাধ্যে কুলায় তেমন এক বাসায় ভাড়া থাকতো। বন্ধুবান্ধব নেই কোন। অফিসেও তার কোন সঙ্গী নেই। উপরন্তু, সে ছিলো তার সহকর্মীদের হাসির খোরাক। অফিসে তাকে নিয়ে সারাক্ষণই হাসি-তামাশা চলত। সে কখনও প্রতিবাদ করতনা। কেবল যখন কৌতুকোচ্ছলে তার গায়ে হাত দিত তখনই কেবল বলতঃ

আপনারা আমাকে অপমান করছেন কেন?

সঙ্গী ভালো লাগতো না বলে এবং সাধ্যও ছিলো না বলে বিয়ে করা বা সঙ্গীর কথাও সে ভাবেনি কোনদিন। প্রতিদিন অফিসে যেত, নকল করত, ফিরে আসতো, খেয়ে ঘুমাতো। এই ছিল তার নিত্য রুটিন। কিন্তু একটি অযাচিত ঘটনা ঘটে তার জীবনে। যাতে গল্প এগিয়ে যায় আরেকটু। তা হচ্ছে, তার পুরানো ওভারকোটটা ফেঁসে যায়। রাশিয়ার তীব্র কনকনে শীতের সাথে পেরে উঠছিল না তা। জীর্ণ এই ওভারকোট মেরামতেরও যোগ্য ছিলো না। বাধ্য হয়েই নতুন ওভারকোট বানার প্রয়োজন হয় তার।

কিন্তু তার যে বেতন, তাতে হুট করেই একটা ওভারকোট তৈরি তার পক্ষে সম্ভব ছিলোনা। দীর্ঘ ছ'মাস পরিচিত দর্জির সাথে তার চলে সলাপরামর্শ। কিভাবে কি করবে, কেমন কাপড় লাগবে, কলার কোন কাপড়ের হবে এসব নিয়ে ব্যপক আলোচনা চলে তাদের মাঝে। ব্যয় মেটাতে একবেলা আহারও কমিয়ে ফেলে সে। অপ্রত্যাশিত বেশি বোনাসও পেয়ে যায় সে। সর্বপরি, তিন-চার মাসের প্রচেষ্টায় সে নতুন একটি ওভারকোটের মালিক হয়। নতুন ওভারকোট তাকে ভিন্ন এক আবহ দেয়৷ ওভারকোট নিয়ে সে বেশ খুশি হয়। মনেহয় যেন সে এটির জন্য এতদিন অপেক্ষায় ছিল। একদম সকালে, অফিসে যাওয়ার আগে দর্জি তার কাছে ওভারকোটটি নিয়ে আসে। প্রবল আপ্লুত হয়ে সে তা গায়ে জড়িয়ে অফিসে যায়। মুহূর্তেই রটে যায় এ খবর। সবাই ছুটে আসে দেখার জন্য৷ খুব প্রশংসা করে। বায়না ধরে নতুন ওভারকোট উপলক্ষে তাদেরকে আপ্যায়ন করার। আকাকি পড়ে যায় ভীষণ বিপদে। এখন কি করবে সে?

তাকে উদ্ধার করে অফিসের এক কর্মকর্তা। ঘোষণা দেয়, সেই অফিসারই তার হয়ে সবাইকে খাওয়াবে। সেদিন ছিল তার জন্য আবার বিশেষ দিন৷ আকাকিকেও দাওয়াত করা হয়। সন্ধ্যায় অনেক দ্বিধাদ্বন্দে থেকেও শেষ পর্যন্ত যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় সে। অফিসার বাস করত শহরের উন্নত এলাকায়। আকাকি ওই অঞ্চলে এর আগে যায়নি। তার সাধ্যও ছিলো না, প্রয়োজনও ছিলো না। গোলক ধাধার মত লাগে সব তার কাছে। পার্টিতে গিয়ে আরও বেকায়দায় পড়ে সে। এমন পার্টিতে সে আগে কখনও আসেনি। নিজেকে নিঃসঙ্গ অনুভব করে সে। ফিরে আসতে চেয়েও কর্তার অনুরোধে আসেনি। কিন্তু একসময় সবাইকে না জানিয়ে চুপিচুপি কেটে পড়ে।

গোগল যে অঞ্চলে থাকতো তা যে অন্ধকারচ্ছন্ন ছিল, তা হয়ত আপনারা বুঝে গেছেন। আর এটাই কাল হয়ে যায় তার জন্য। এই গভীররাতে তাকে একা পেয়ে দুই ছিনতাইকারী এসে তার শখের নতুন ওভারকোটটি ছিনিয়ে নিয়ে যায়। বিমর্ষ আকাকি কি করবে বুঝতে পারেনা। জীবনে প্রথম অফিস কামাই দেয় সে। বাড়িওয়ালার পরামর্শে থানায় যায় অভিযোগ নিয়ে। বুঝতে পারে, তার শখের ওভারকোট খোঁজার চেয়ে অন্য কাজে পুলিশের আগ্রহ বেশি। অফিসের লোক পরামর্শ দেয় কোন মান্যগণ্য ব্যক্তির কাছে যেতে।

সেখানে গিয়ে আরেক তিক্ত অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয় সে। নিচ ও নগণ্য মনে করে তাকে দিনের পর দিন ঘুরাতে থাকে কেরানিরা। দেখাই পায় না সে। একদিন নিজের সরকারি চাকুরির পরিচয় দিয়ে তাদের ভয় পাইয়ে দেয় সে। সহজেই মান্যগণ্যর দেখা পায়। কিন্তু সে যে আকাকি। উপেক্ষিত একজন। নিতান্ত মন্দভাগ্য নিয়ে বেচে থাকা একজন। সেদিন মান্যগণ্যের এক বন্ধু এসেছিল দেখা করতে। সেই বন্ধুকে নিজের ক্ষমতা দেখানোর জন্য তিনি চড়ে বসেন আকাকির উপর। তীব্র ধমকের চোটে আকাকি অপ্রকৃতস্থ হয়ে যায়। এতটাই যে সে শয্যাসঙ্গী হয়ে যায়। এমত অবস্থায় দুদিন পরই তার মৃত্যু হয়। বাড়িওয়ালা এবং গুটিকয়েক প্রতিবেশি ছাড়া আর কেউই খবর পায়নি তার মৃত্যুর। অফিসের লোকেরাও জানতোনা তা। আকাকি অনেকদিন অফিসে আসেনি কেন, এজন্য খোঁজ নিতে গেলে জানতে পারে তা নিদারুণ মৃত্যুর কথা। দুনিয়া থেকে বিদায় নেয় উপেক্ষিত একজন, সবার অগোচরে।

অবশ্য আকাকি সেন্ট পিটার্সবার্গের মানুষের মনে আতংক ছড়িয়ে দিতে পেরেছিল তার মৃত্যুর পর। কিভাবে তা আর আমি এখানে বলবো না। সেটা আগ্রহী পাঠক বই পড়েই জানা উচিৎ বলে মনে করছি।

আমার মতামত

ওভারকোট একজন নিরীহ মানুষের গল্প। গল্পের কোথাও তাকে নায়ক হিসাবে দেখানো হয়নি। তার এমন কোন কাজ ছিলো না, যাতে মনে হতে পারে পৃথিবীকে সে কিছু দিয়েছে। বরং, এমন একজন মানুষ ছিলো আকাকি, যে পৃথিবীতে না আসলেও কিছুই হতো না। একজন তুচ্ছ মানুষ হিসাবেই সে জীবন অতিবাহিত করেছে। কিন্তু এমন মানুষরাই তাদের কর্মস্থলে তুলনামূলক চালাক, বুদ্ধিমানদের কাছ থেকে কেমন আচরণ পায় তা আমাদের ভাবায়। নিজেকে বড় দেখানোর জন্য এমন নিরীহ মানুষদের সাথে মান্যগণ্যদের আচরণ আমাদের মানবতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। থেকেও যেন নেই, এরা আমাদের দৃষ্টির আড়ালেই থাকে। তাদের সুবিধা অসুবিধা আমাদের ভাবায় না। যা একজন মানুষ হিসাবে কখনই কাম্য নয়। নিকোলাই গোগলের অসামান্য এক গল্প এই ওভারকোট।


IMG_5055.jpg

আমার সম্পর্কে
আমি মুহাম্মদ সাব্বির আকিব। জন্মসূত্রে একজন বাংলাদেশি। জেলাঃ চাঁদপুর, থানাঃ ফরিদগঞ্জ। থাকি ঢাকা জেলার সাভার উপজেলার আশুলিয়া থানাধীন দক্ষিণ গাজীরচট নামক স্থানে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে রসায়নে স্নাতক (সম্মান) সম্পন্ন করেছি। বর্তমানে একটি ফার্মেসিতে ফার্মাসিস্ট হিসাবে কর্মরত রয়েছি। বিবাহিত এবং আল্লাহ একটি পুত্র সন্তানের জনক করেছেন, আলহামদুলিল্লাহ।
Authors get paid when people like you upvote their post.
If you enjoyed what you read here, create your account today and start earning FREE STEEM!