১৬ আষাঢ় ১৪২৮
প্রসঙ্গঃ হারিয়ে যাচ্ছে নবান্ন উৎসব
গ্রামীণ জনপদে দিগন্ত বিস্তৃত ফসলের মাঠ আছে কিন্তু কৃষকের ঘরে নেই নবান্নের আমেজ। গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী নবান্ন উৎসব কালের আবর্তে হারিয়ে যাচ্ছে। সিকি শতাব্দী পূর্বেও নবান্নের ধান কাটার উৎসবে মুখরিত হত গ্রামের প্রতিটি আঙিনা। গ্রামীণ জনজীবনে নবান্ন উৎসব এখন শুধুই স্মৃতি।
হেমন্তকালে মাঠে মাঠে দেখা যায় দিগন্তবিস্তৃত সোনালী ধানের ক্ষেত। হেমন্ত বাংলার গ্রাম হেমবরনী। কমলা রোদে উজ্জ্বল সোনালী ধানের গুচ্ছ। এসময় ধান সোনালী রং ধারণ করে। পাকা ধানের সোনালী রং দেখে কৃষকের মন আনন্দে ভরে যায়। এ ঋতু মমতাময়ী কৃষকের ঘরে দেয় সোনালী ধানে। হৈমন্তী ধানের মিষ্টি গন্ধে আমোদিত হয় চারিদিক। ঢেঁকির তালে আর ধান ভানার গানে নবান্নের উৎসবে মেতে ওঠে গ্রামবাসি।
চিরাচরিত রীতি ও প্রথা অনুযায়ী আমন ধান কাটার পর অগ্রায়ন মাসের প্রথম বৃহস্পতিবার নবান্ন উৎসব পালিত হতো এবং পুরো অগ্রাহন মাস জুড়ে তা চলতো। গ্রামবাসী খুব ধুমধামের সাথে নবান্ন উৎসব পালন করতেন। কৃষকের ধরে তখন খুশির আমেজ বইতো- নতুন ধান হবে নবান্ন। এ উপলক্ষে গাঁয়ের বঁধুরা গুড়, নারকেল, কলা, দুধ প্রভৃতির সঙ্গে নতুন আতপ চাল মিশিয়ে ক্ষীর রান্না করতেন।
কৃষকেদের প্রধান ফসল আমন ধান ঘরে তোলার উৎসব হলো নবান্ন। অতীতে নবান্ন ছিলো গ্রাম বাংলার কৃষক সম্প্রদায়ের অন্যতম প্রধান পার্বণ। কৃষক সাধারনের কাছে নবান্ন উৎসব ছিলো অত্যন্ত আকর্ষণীয় ও আদরণীয়। গ্রামের ঘরে ঘরে নবান্নের বিশেষ খাবার পরিবেশিত হতো। ক্ষীর, পায়েস, পিঠা, পুলি, মুড়ি খৈ, মাছ, মাংস ও রকমারি শাকসবজি দিয়ে গ্রামবাসী রসনা তৃপ্তি করতেন। প্রতিবেশী ও স্বজনদের মধ্যে ক্ষীর আদান-প্রদান চলতো। নবান্ন উপলক্ষে গ্রামে খেলাধুলা ও গানবাজনার আসর জমত। নবান্নের পূর্বে গ্রামীণ মহিলারা বাড়ির উঠানে আলপনা আঁকতেন, ঘরদোর লেপা দিতেন। পূর্বে নবান্নের দিনে সকালে কৃষকেরা গোসল করে জমিতে ধান কাটতে যেতেন। নবান্নের ধান মাড়াই করার স্থানে লেপা দেওয়ার পর কাঠের পিঁড়া বা তক্তা বসানো হতো। পিঁড়ার সামনে এঁড়ে গরুর সামান্য গোবর, কিছু সরিষা দানা রাখতেন। এ ধানকে খুব সতর্কতার সাথে মাড়াই করে ঝাড়া হতো।
ধান কাটা, মাড়া, সিদ্ধ করা, শুকানো সবকাজ একদিনেই সম্পন্ন করার নিয়ম ছিলো। নবান্নের ধান এক রোদে শুকাতে হয়, বাসি করা যায় না। নতুন ধানে চাল দিয়ে তৈরি ক্ষীর খাওয়ার মজাটাই ছিলো আলাদা। নবান্ন উৎসবের দিনে নতুন বধুরা শীতের কাপড় চোপড় ( কাঁথা, কম্বল, সোয়েটার, চাদর প্রভৃতি) মাটির তৈরি কুঠি থেকে বের করতেন। নবান্নের পূর্বে যতই শীত পড়ূক না কেন গ্রামবাসী শীতের কাপড় বের করতেন না। শীতকাল শেষে ফাল্গুন মাসে গ্রামের মহিলারা যাবতীয় শীতবস্ত্র ধুয়ে পরিস্কার পরিচ্ছন্ন করে কুঠির মধ্যে সংরক্ষন করতেন।
নবান্ন উৎসব গ্রামবাংলার ঐতিহ্য বহন করে। সোনালি পাকা আমন ধানের মৌ মৌ গন্ধে কৃষকের মন ভরে ওঠে। গ্রামের ঘরে ঘরে আনন্দের বন্যা বইতো। এ এক অপূর্ব আনন্দ! শিশু-কিশোর থেকে শুরু করে ধনী গরিব সকলের জন্য। অবস্থাপন্ন কৃষকরা গরিব ও ভূমিহীন কৃষকদের কাজের বিনিময়ে নবান্নের ধান দিতেন। এ উপলক্ষে গ্রামে গরু মহিষ জবাই করা হতো। ধনী গরিব সবাই মাংস ভাগ বাটোয়ারা করে নিতেন। গ্রামবাসী মিলেমিশে নবান্নের আয়োজনে মেতে উঠতেন। কমবেশি প্রত্যেক বাড়িতেই আত্মীয়-স্বজনের সমাগম হতো। গ্রামবাসী একে অন্যের বাড়িতে নবানের উৎসবে যোগ দিতেন। ছোটবেলায় দেখেছি আমাদের গ্রামে খুব জাঁকজমকের সাথে নবান্ন উৎসব পালিত হতো। অগ্রহায়ণ মাসের প্রথম শুক্রবার গ্রামবাসী মসজিদে ক্ষীর দিতেন। জুম্মার নামায শেষে উপস্থিত মুসল্লিদের ক্ষীর বিতরণ করতে করতে বিকেল হয়ে যেতো।
রাতে কবিগানের আসর বসতো। পূর্বে কৃষকদের প্রধান খাদ্যশষ্য ছিলো আমন ধান। বর্তমানে আমনের জায়গা দখল করে নিয়েছে ইরি-বোরো ধান। উচ্চফলনশীল জাতের হাইব্রিড ধানের আগ্রাসনের কারণে নবান্ন উৎসব হারিয়ে যাচ্ছে।
আমার দাদী আছিয়া বেগম ( ৬৫ ) এর দেওয়া তথ্যমতে , নবান্নের দিনে নয় প্রকার খাদ্য খেতে হয় বলে এর নাম নবান্ন। পূর্বে গ্রামের প্রায় প্রত্যেক বাড়িতে ৯ পদের খাদ্য রান্না করা হতো। এগুলো হলোঃ ক্ষীর, ছোলা-মুড়ি, মাষকালাইর ডাল ( ভাতের সাথে), আমিলা (চালকুমড়ার সাথে গুড় ও তেঁতুলের টক দিয়ে প্রস্তুতকৃত ব্যঞ্জন বিশেষ), মটরশাক-সরিষাশাক, তিন চাউলি (চালের ক্ষুদ ভিজিয়ে দুধ কলা চিনি দিয়ে প্রস্তুত মিষ্টান্ন জাতীয় খাদ্য), মাংস, মাছ, এবংমূলা-বেগুন-শিম প্রভৃতি শীতকালীন শাকসবজি। নবান্ন উপলক্ষে গ্রামের মহিলারা নতুন নতুন জামাকাপড় এবং বিভিন্ন ধরনের অলংকার দিয়ে সাজগোজ করতেন।
নবান্ন শ্রেণীহীন এক অসাম্প্রদায়িক উৎসব। নবান্ন উৎসব বাঙালি জাতিকে ঐক্য ভ্রাতৃত্ব ও আত্মীয়তার বন্ধনে আবদ্ধ করে। নবান্নের পরশে মানুষ সংস্কৃতিবান হয়। নবান্ন উৎসব বাঙালির জনজীবনে অনাবিল আনন্দ, সুখ ও সমৃদ্ধি বয়ে আনুক এ প্রত্যাশা সবার।
গ্রামীণ উৎসব নবান্ন এত সুন্দরভাবে ফুটে তোলার জন্য ধন্যবাদ।
Downvoting a post can decrease pending rewards and make it less visible. Common reasons:
Submit
সময় নিয়ে পড়ার জন্যে আপনাকে ধন্যবাদ।
Downvoting a post can decrease pending rewards and make it less visible. Common reasons:
Submit
আমাদের বাড়িতেও অনেক আগে এমন উৎসব মূখর পরিবেশ তৈরি হত। সত্যিই দিনগুলো মিস করি।
Downvoting a post can decrease pending rewards and make it less visible. Common reasons:
Submit
হ্যা ভাইয়া,
কত সুন্দর ছিলো আগের দিনগুলো, সময়ের সাথে সাথে ও কালের বিবর্তনে হারিয়ে যাচ্ছে।
Downvoting a post can decrease pending rewards and make it less visible. Common reasons:
Submit
সময়ের পরিবর্তনে সবকিছু পরিবর্তিত হয়ে যাচ্ছে। যাইহোক ভাল লিখেছেন ধন্যবাদ আপনাকে।
Downvoting a post can decrease pending rewards and make it less visible. Common reasons:
Submit
ধন্যবাদ আপু পড়ার জন্যে।
Downvoting a post can decrease pending rewards and make it less visible. Common reasons:
Submit
অনেক সুন্দর একটি পোস্ট করেছো। আসলে যতদিন গড়াচ্ছে ততদিনে এই ঐতিহ্য গুলো হারিয়ে যাচ্ছে।
Downvoting a post can decrease pending rewards and make it less visible. Common reasons:
Submit
হ্যা চাচ্চু। ঠিক বলেছো।
Downvoting a post can decrease pending rewards and make it less visible. Common reasons:
Submit
আসলে কালের বিবর্তনে সবকিছু বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। যাইহোক নবান্ন উৎসব নিয়ে ভালো লিখেছেন দাদা।
Downvoting a post can decrease pending rewards and make it less visible. Common reasons:
Submit
ধন্যবাদ দিদি, সময় নিয়ে পড়ার জন্যে।
Downvoting a post can decrease pending rewards and make it less visible. Common reasons:
Submit
গ্রামীণ ঐতিহ্য এবং বাস্তবতা তুলে ধরার জন্য ধন্যবাদ
Downvoting a post can decrease pending rewards and make it less visible. Common reasons:
Submit
ধন্যবাদ ভাই, সময় নিয়ে পড়ার জন্য!
Downvoting a post can decrease pending rewards and make it less visible. Common reasons:
Submit