চুপচাপ খাওয়া শেষ করলাম। নিজের বিয়ের খাওয়া হিসেবে বিলটা আমিই মেটালাম। রেস্টুরেন্ট থেকে নেমে বড় ভাই চলে গেলেন। গাড়ি নিয়ে সোজা শ্বশুন বাড়ির দিকে যাচ্ছি। গাড়িতে প্রস্তুতিমূলক কথাবার্তা হচ্ছে।
: বাড়িতে কোনো হিন্টস দিয়ে এসেছিলে? (আমার প্রথম প্রশ্ন)
: না।
: তাঁরা চমকে যাবেন না?
ওঁ এ কথার কোনো জবাব দেবার প্রয়োজন মনে করলো না। যা হোক বাকি পথ কথা হলো না। শ্বশুড় বাড়ির সামনে নামলাম। দরজার কলিংবেল চাপার আগে তাঁর কড়া হুশিয়ারি...
: প্রথমেই সালাম করতে যাবা না; মার খেলেও কিছু বলবা না, আমি মার খেলেও চুপ।
আমার পত্রপাঠ সম্মতি জ্ঞাপন। শ্বাশুড়ি আম্মা দরজা খুললেন। আমার হাত ধরে হিড়হিড় করে টেনে শুশ্বর আব্বার রুমে প্রবেশ। পেছনে কী হয়েছে! কী হয়েছে! বলতে বলতে শাশুড়ি আম্মার অনুসরণ ও কক্ষে প্রবেশ।
(শ্বশুর-শাশুড়ির সামনে ওঁর প্রথম বক্তব্য)
: মা-বাবা, এই যে ছেলেটা দেখছো, একে কিছুক্ষণ আগে আমি বিয়ে করেছি। তোমাদের মতামত নেই, আমি জানি। কিন্তু আমার যাঁকে পছন্দ তাঁর সাথে যেহেতু আমার বিয়ে তোমরা দিচ্ছো না, তাই ব্যাপারটা প্রতিশোধ ও অভিমানমূলক বলতে পারো, তবে সুবিবেচনাপ্রসূত। আর এটুকু জেনে রেখো এই ছেলেকে বিয়ে করে আমি ভুল করিনি, কারণ সে যোগ্য এবং আমাকে সে অনেক ভালোবাসে।
শ্বশুর আব্বার হস্ত থেকে পত্রিকা ভূপাতিত হইলো। শাশুড়ি আম্মা টলায়মান অবস্থায় পাশ্ববর্তী টুলে আসন গ্রহণ করিলেন। শ্বশুর আব্বা এগিয়ে আসলেন, ও পঞ্চাশোর্ধ বলিষ্ঠ ডান হাতের চার আঙুল ওঁর গালে লেপে দিলেন। শক্তির বিনাশ নাই। কিছুটা গালে তাপশক্তি আকারে গাল লাল করে দিলো, কিছুটা শব্দ আকারে ঘর কাঁপালো, বাকিটা চাপ শক্তি আকারে ওঁকে ফেলে দিচ্ছিলো প্রায়। আমি চুক্তি মোতাবেক কাপুরুষের ন্যায় ওঁকে রক্ষা করলাম না, শুধু পড়ন্ত ওঁকে ধরে ফেললাম। সুন্দরভাবে দাঁড় করিয়ে একটু পেছনে সরে আসলাম। ভাবখান এমন, নেন এবার মারেন।
: ওঁকে নিয়ে বেরিয়ে যাও। (আমার দিকে তাঁকিয়ে শ্বশুর আব্বার হুঙ্কার)
গ্রিন সিগনাল পাওয়ামাত্র আমি সবাইকে সালাম দিয়ে ওঁকে টেনে নিয়ে হিড় হিড় করে বেরিয়ে গেলাম। গাড়িতে উঠে লক্ষ্য করলাম ওঁর লাল গালে এক ফোটা অশ্রু।
: কই যাইবেন স্যার (ড্রাইভারের প্রশ্ন)
: রমনা পার্ক
: আইচ্ছা
ত্রিশ মিনিট পর রমনা পার্কের এক বেঞ্চে বসে আছি দুজন। প্রথমে আমি-ই নীরবতা ভাঙি।
: খুব কষ্ট হচ্ছে? গাল জ্বলছে খুব?
: গালটা একটু জ্বললেও মনটা হাল্কা লাগছে। (আজব উত্তর)
: মানে?
: মনে আশংকা ছিলো খারাপ কিছু না হয়, শেষ পর্যন্ত হলো না বেঁচে গেছি।
: বুঝলাম না।
: মা হার্ট অ্যাটাক করে নাই, বাঁচছি। বুঝলে কিছু?
: এখনো তো সময় যায় নি।
: তখন না হলে এখন আর হবে না, কারণ তখন ছিলো চরম মুহুর্ত।
: অ
: অ্যাই মার্কেটে চলো।
: কেনো কী কিনবা?
: তোমার কী মনে হয়, আমি এই পার্সে করে আমার সব জামা-কাপড় নিয়ে চলে এসেছি?
: অবশ্যই না, অবশ্যই না। আফটার ইউ, মাই লেডি।
কেনাকাটা করতেছি। বিয়ের শাড়ি, শেরওয়ানি কিনতেছে না। কিনতেছে নরমাল পোষাক। থাকতে না পেরে জিজ্ঞেস করলাম।
: বিয়ের শাড়ি কিনবে না?
: বিয়ের যখন নরমাল শাড়ি পরে করেছি, বাসরও নরমাল শাড়িতেই করবো।
: এটা কী বলো, এইটা কোনো কথা হইলো? বিয়ে রাস্তায় করছি, এখন বাসরও রাস্তায় করবো? গয়নাগাটি কিনবে না?
: না, এখন টাকার দরকার হবে। তবে তুমি চাইলে একটা রিং দিতে পারো। এই সব।
: আচ্ছা চলো।
ওর পছন্দমতো একটা রিং কিনলাম, চুপি চুপি পরিয়েও দিলাম। এবার বাসায় যাওয়ার মুহুর্ত। আমি বলি....
: শোনো গাড়ি দূরে পার্ক করা থাক। আমি বাসা থেকে ঘুরে আসি। কিছু জিনিস নিয়ে আসি, আর ট্যুরের গল্প সাবমিট করে আসি।
: কতোক্ষণ লাগবে?
: বড় জোর আধাঘন্টা। তুমি আবার কোথাও যেও না।
: কী আবোল-তাবোল বকছো? আমি কোথায় যাবো?
: তা তো জানি না, তবে পাওয়ার পরই আসে হারানোর ভয়।
: দর্শন না কপচিয়ে যাও। আমি ওয়েট করতেছি।
: আচ্ছা।
বাসায় আসলাম। মা দুপুরের ভাত বেড়ে রেখেছে। আমি ট্যুরের কথা বলার পর আকাশ থেকে পড়েন। জিনিসপাতি গোছাতে গোছাতে কথা হচ্ছে।
: বলা নেই কওয়া নেই কীসের আড্ডা দিতে ট্যুরে যাবা? কই যাবা? (তার প্রথম প্রশ্ন)
: এই দক্ষিণ-পূর্ব বঙ্গ। এক্সজাক্ট জেলা ঠিক না হইলেও টাইম ঠিক হয়েছে। ১০/১৫ দিন।
: এতো দিন?
: তুমি কী বলো? এইটা কোনো দিন হইলো তুমি জানো পায়ে হেঁটে মানুষ কয় বচ্ছর ধইরা ঘুরে?
: তোর যাওয়ার দরকার নাই।
: না না যেতেই হবে, কোনো উপায় নাই। কথা দিয়া ফেলছি। ভদ্রলোকের এক কথা। আসি আল্লাহ হাফেজ।
: ভাত খাইয়া তোর বাপের লগে দেখা কইরা যা।
: টাইম নাই, বইসা আছে। (এইটা সত্যি কথা )
ব্যাগ-প্যাক ঝুলিয়ে বেশ খানিকটা এসে আশেপাশে তাকিয়ে গাড়িতে উঠলাম। এবার সোজা এবির বাসায় যাবো।
: চলো
: শোনো, তোমার এবি ফোন দিয়েছিলো। বাসায় যেতে বলেছে তাড়াতাড়ি।
: কোনো সমস্যা?
: না, তোমাকে বলেছে, বউ নিয়ে প্রথম দিনই এতো ঢ্যাং ঢ্যাং করে ঘুরে বেড়াচ্ছো কেনো?
: এইতো এখনই যাচ্ছি।
এবির বাসায় ঢুকে দেখি সে বিশাল বড় ব্যাপার-স্যাপার। তাঁর দুই শ্যালিকাকে নিয়ে এবি ভাবী ঘর সাজাচ্ছেন। ঘরে ঢুকতেই খুব আনুষ্ঠানিকভাবে গদগদভাবে ওঁকে অন্য ঘরে নিয়ে গেলেন। বলে গেলেন একেবারে দেখা হবে বাসরে। আমার জন্যেও সারপ্রাইজ ছিলো। মোর বন্ধু এ বাসায় বসে আছে। সে আমাকে আরেকটা রুমে নিয়ে গেলো। এবির দায়িত্ব পড়েছে রান্নাঘরে, বেচারা। আয়োজকদের বড় জ্বালা।
: হুনো বন্ধু, তোমারে বিয়ার পোষাক পরাইয়া দিমু। খালি আন্ডারওয়্যার পইরা খাড়াইয়া থাকো। (বন্ধুর উক্তি)
: ফাইজলামি করো? তুই এইখানে আইলি ক্যামতে?
: আরে বাসায় যাওনের সময় মন খারাপ লাগতেছিলো। খাওন হইলো না, আবার ছাইড়া আইলাম তোরে। এদিকে বাসায় বাপে বলে আমার কাজ নাকি অন্যেরে দিয়া করাইয়া ফেলছে, তাই আমার আর কাজ নাই। তোর কথা মড়ে পড়লো। সারা জীবন ব্ল্যাক পরিয়া গেলো, কিন্তু বিয়ার দিন যদি পোলাডা ব্ল্যাক শেরওয়ানি না পায়। এই দেখো বন্ধু, তোমার জন্য কালো শেরওয়ানী আনিয়াছি। একেবারে প্লেইন ব্ল্যাক। তয় পাগড়ী ব্ল্যাক পাই নাই তাই আনি নাই।
: আমি তো এ পরতে পারি না। যা পরে বিয়ে করিনি তা পরে ক্যামনে বাসর করি। তথ্যসূত্র: ওঁ। (দার্শনিক ধাঁচের উত্তর)
: এইডা কোনো ব্যাপার না, তাঁকেও বিয়ের ফরমাল ড্রেস পরানো হচ্ছে।
(এবির আগমন ও প্রথম বক্তব্য)
: শোনো ঐদিকে ঝামেলা কেমন?
: আজকে হামলা করবে না এইটা মোটামুটি সিওর। আর আমার বাসা জানে আমি এখন দক্ষিণ-পূর্ব বঙ্গের ট্রেনে।
: ভালো। তবে মোবাইল বন্ধ রাখবা না কারোর। তাহলে টেনশন বাড়বে।
: তা ঠিক বটে।
: তুমি বাসা থেকে কী কী আনছো?
: এই ব্যাগপ্যাক। এতে প্রায় সবই আছে। এবি, কালকেই চলে যাবো।
: কোথায়? হানিমুনে?
: জ্বে, তারপর আপনি এই ফাঁকে একটা বাসা আর সম্ভব হলে একটা চাকরি দেখে ফেলবেন।
: ভালো কথা মনে করেছো, তুমি এখন বৌকে খাওয়াবা কী?
: ব্যাংকে যা আছে ছয়মাস চলে যাবে। নেটের ফ্রিল্যান্স কাজটা আপাতত বাড়িয়ে দিতে হবে। আগে যা আসতো, এখন একটু বেশি আসবে।
: ওসব দিয়ে হবে না। চাকরি দেখো।
: আমিও তাই বলি। আপনি দেখেন। আমি তো হানিমুনে চাকরি খুঁজে বেড়াতে পারি না।
: তা বটে, তা বটে।
: হানিমুন থেকেই নিজের বাসায় উঠে যাবা? এ তো ভালো টাকার ব্যাপার।
: কী করবো, বউয়ের মান-সম্মানের ব্যাপার আছে না। এবি আপনে লাখ খানেক টাকা ধার দিয়েন।
: ফাইজলামি করো?
: না, ফাইজলামি না। তয় এগুলো ওঁরে নিয়া ঠিক করবো পরে। তবে আপনি রেডি থাইকেন। লাখ খানেকের ব্যাপারটা সত্যি হইবার পারে।
: হ, আমার বউরে নিয়া রাস্তায় বসি, আর তুমি আমার বাসায় উইঠা আসো। যত্তোসব, যাও মিয়া শেরওয়ানি পরো।
: জ্বে।
: তগো কথায় বাম হাত-পা কোনোডাই ঢুকাইতে পারলাম না, খালি হুইন্যাই গেলাম, আফসোস। (বন্ধুর শোকাক্তি)।
: ব্যাপারটা না। তোর শেরওয়ানি দে, পইরা নেই। (একটু চিন্তিত) আইজকা তুই এখানেই থাকবি?
: তাই মনে হইতেছে। তোরে কালকে উঠাইয়া দিয়া তারপর যামু।
: ভালো।
(এবি ভাবীর আগমন, ও প্রশ্নবাণ)
: এই যে তুমি। বিয়ে করেছো, বউয়ের জন্য কেনাকাটা তো কিছুই প্রায় করোনি।
: উই করতে দেয় নাই ভাবী। আমার দোষ নাই। হেয় কয় বিয়ের মতো সবই হবে সিম্পল। উদাহরণ: ম্যাগি নুডলস।
: এই সব ফাজলামো করতে হয় না। বিয়ে কী বারবার করে কেউ?
: হুম! (মনে মনে কইলাম, অনেকেই করে )
: থাক হুম করতে হবে না। আমি সব গুছিয়ে এনে রেখেছিলাম। তোমার ভাইয়ের কলের পর শপিং করেছি। তুমি এখন তৈরি হয়ে নাও।
: ইয়া আলী! (এবিরে পুরা পথে বসায় ছাড়ছে মনে হইতাছে)।
: আলীর কথা আসলো কেনো আবার?
: তোমার আন্তরিকতায়।
: থাক, ঢং করা লাগবে না।
(বাসর ঘরে ঢোকার সময় হয়েছে অবশেষে। যেহেতু নিয়মতান্ত্রিক বিয়ে না, তাই বাসর তুলনামূলক আগেই শুরু হচ্ছে)
পরিশিষ্ট: সবাই দোয়া করবেন। গল্পের মতো না হলেও মনে যারে চাই, তাঁরে য্যান পাই (য্যামনেই হউক না ক্যান)।
হানিমুন পার্ট জন্য অপেক্ষা করুন।