মাঝখানে বেশ কিছু কারণে আমি অনিয়মিত হয়ে পড়েছিলাম,তবে দীর্ঘ সময় পর আমি আবার এখানে কাজ শুরু করছি। বেশি কথা না বাড়িয়ে আজকের গল্প শুরু করি।
আজকে বলবো আমার নিজের শহর নিয়ে কিছু কথা। আমার শহরের নাম কৃষ্ণনগর। প্রাণের শহর কৃষ্ণনগর, রাজার শহর কৃষ্ণনগর- বিভিন্ন ভালোবাসার নামে পরিচিত আমার এই শহর। আমার এই শহরের নাম উঠলে যে কথাগুলি অবশ্যই থাকবে তা হল জগৎ বিখ্যাত মাটির পুতুল, সরপুরিয়া এবং সরভাজা মিষ্টি,ডি.এল.রায়,বাঘা-যতীন,ক্ষুদিরাম বোস, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় এরকম প্রচুর নাম উঠে আসবে,প্রচুর ইতিহাসও উঠে আসবে। তাই আমি সেসব দিকে যাচ্ছি না। কৃষ্ণনগর শহরের সাথে আরো একটা জিনিস ওতপ্রোতভাবে জড়িত,আর তা হল জগদ্ধাত্রী পুজো। এই জগদ্ধাত্রী পুজোর ইতিহাস বা প্রচলন নিয়ে নানান তর্ক-বিতর্ক রয়েছে। অনেকেই এই পুজোর পেছনে থাকা আসল ঘটনা জানেন না, আবার কেউ কেউ আছে তারা সবটাই জানেন।
তবে আমি আজকে কোন তর্কবিতর্কের মধ্যে যাবো না, এই শহরের একজন নাগরিক হয়ে সামান্য যে কয়েকটি বিষয় না জানলেই নয় সেগুলি আপনাদের সামনে তুলে ধরছি। আশা করি তাতে অনেকের ভুল ধারণা দূর হয়ে যাবে এবং আপনারা যারা জগদ্ধাত্রী সম্পর্কে কিছুই জানেন না তারাও অনেক কিছু জানতে পারবেন। তাহলে এখন আমি মূল গল্পে আসি।
সালটা ছিল ১৭৫৪। তখন বাংলার নবাব আলীবর্দী খাঁ। কৃষ্ণনগর শহরে মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় তার প্রজাদের নিয়ে বসবাস করতেন। মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র তার প্রজাদের খুবই ভালোবাসতেন। তাদের সমস্ত দেখাশোনা করতেন ,কারোর শরীর খারাপ বা অসুখ-বিসুখ হলে মহারাজ নিজে অর্থ দিয়ে ওষুধের ব্যবস্থা করে তাদের সুস্থ করে তুলতেন ।খুবই গরীব ঘরের লোকজনদের মহারাজ নিজে চাল-ডাল অথবা অর্থ দিয়ে সাহায্য করতেন, সপ্তাহে সপ্তাহে পুরো শহর ঘুরে প্রজাদের সুবিধা ও অসুবিধার কথা শুনতেন। এক কথায় প্রজাদের সাথে একাত্মভাবে মিশতেন।
এরকম একটা সময় হঠাৎ নবাব আলীবর্দী খাঁ, মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র কে বঙ্গেশ্বরের কাছে(বর্তমানে মুর্শিদাবাদ) করাবন্দী করেন। মূলত মহারাজ কর দিতে না পারায় নবাব তাকে বন্দী করেন। ইতিহাস ঘাটলে জানা যায় সেই সময়ের প্রায় ৯ লাখ টাকার কাছাকাছি কর মহারাজ দিতে অক্ষম ছিলেন, যার বর্তমান বাজার মূল্য কয়েক কোটি টাকা। তো যাই হোক, যে যে কারণেই হোক মহারাজ সেই কর দিতে অক্ষম ছিলেন। মহারাজ যেহেতু তার প্রজাদের খুবই ভালবাসতেন ,বিপদ-আপদে সবসময় তাদের পাশে থাকতেন তাই তার প্রজারা তার প্রতিদান দেওয়ার চেষ্টা করলেন।প্রজারা নিজে সেই টাকার বেশ কিছুটা জোগাড় করে মহারাজকে মুক্ত করতে তৎপর হয়। কিন্তু নবাব পুরো কর না পাওয়া পর্যন্ত কিছুতেই মহারাজকে মুক্তি দিতে রাজি নয়, এই সময় রবার্ট ক্লাইভ এর একান্ত অনুরোধে অবশেষে মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র মুক্তি পায়।
এরপর মহারাজ সেই জেল থেকে জলপথে কৃষ্ণনগরের উদ্দেশ্যে রওনা দেন। তখনই ঘটে আশ্চর্য একটি ঘটনা। মহারাজ দেখতে পান যে নদীর জলে মা দুর্গার মূর্তি পড়ে রয়েছে এবং দূর থেকে ঢাকের আওয়াজ আসছে, অর্থাৎ দুর্গাপুজোর বিসর্জন হয়ে গেছে। তখন মহারাজ অত্যন্ত কষ্ট পান। আসলে মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র নিজে খুব বড় করে এবং যত্ন সহকারে, ভালবেসে, মন থেকে দেবী দুর্গার আরাধনা করতেন। কিন্তু সেই বছর তিনি কারাবন্দি থাকায় দেবী দুর্গার পূজা করতে পারেননি। সেই দুঃখে ভরা ক্লান্ত মনে মহারাজ বাড়ি ফেরার আনন্দ ভুলে গভীর কষ্টে কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগলেন,"হে মা দুর্গা, তুমি কেন আমার হাতে পুজো নিলে না! কি এমন পাপ করেছি আমি!", এ সমস্ত নানাবিধ কথা। এমন ভাবে নৌকাতেই তিনি কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়েন। মহারাজ ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখেন, ছোট্ট এক কুমারী একটি ঘোড়ার মতো দেখতে সিংহের পিঠে এক পা ভাঁজ করে বসে আছে।তাঁর চার হাতে রয়েছে শঙ্খ,চক্র,তীর,ধনুক। সেই ভাবে বসে সেই কুমারী মহারাজকে বলছে," ঠিক এক মাস পর, শুক্ল নবমীতে তুই আমার পুজো করবি। সপ্তমী,অষ্টমী, নবমী, এই তিন দিনের পূজো তুই আমাকে একই দিনে করবি। তাহলেই মা রাজরাজেশ্বরীর পুজো হবে এবং সেভাবেই আমি তোর পূজা গ্রহণ করবো।" এই বলে সেই কুমারী বিদায় নিয়ে নেয়।
এরপরদিন সকালবেলা এই ঘটনা মহারাজ তার কুলুঃপুরোহিত কে বলেন। কুলুঃপুরোহিত সমস্ত ঘটনা বিশদে শুনে আপন মনে মন্ত্র আওড়াতে আওড়াতে প্রণাম করে মহারাজকে বললেন, সেই ছোট্ট কুমারীই হলেন মা জগদ্ধাত্রী, যা দেবী দুর্গার এক রূপ। উপনিষদে এইরূপই 'হৈমবতী' নামে পরিচিত।
মহারাজ সেই শুনে এক মুহূর্ত দেরি না করে শিবচন্দ্রকে ডেকে স্বপ্নে দেখা সেই কুমারীর সম্পূর্ণ বর্ণনা দিলেন, এবং বললেন ঠিক ঐ রকম ভাবে একটি মূর্তি গড়তে। মহারাজ ঠিক করলেন মূর্তি না হওয়া অব্দি তিনি বাড়ি ফিরবেন না। অর্থাৎ মহারাজ একবারে মায়ের পুজো করে তবেই বাড়িতে ঢুকবেন।
সেইমতো সঠিক সময়ের মধ্যে সেই মূর্তি তৈরি হলো এবং মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র সেই মূর্তি নিয়ে তার বাড়ির ঠাকুর মন্দিরে এসে শুক্লপক্ষে নবমীতে মায়ের পূজা করেন, তারপরে বাড়িতে প্রবেশ করেন।
ঠিক এই ভাবেই শুরু হয়েছিল মা জগদ্ধাত্রী দেবীর পূজা।
কলকাতার পার্শ্ববর্তী অঞ্চল চন্দননগরে মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের খুব প্রিয় এক বন্ধু থাকতেন, যার নাম ইন্দ্রনারায়ন চৌধুরী।
এই রাজা ইন্দ্র নারায়ণ মহারাজের অনেক পুরনো দিনের বন্ধু ছিলেন এবং মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের সকল সুখ-দুখের সময় তিনি পাশে থাকতেন। তাই ঠিক তার পরের বছর অর্থাৎ ১৭৫৫ সালে মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের অনুরোধে রাজা ইন্দ্রনারায়ণ চৌধুরী ও জগধাত্রী পুজো শুরু করেন।
এই বিষয়টি নিয়ে আজও অনেকের মধ্যে নানান মতবাদ তর্কবিতর্ক চলে। কেউ কেউ বলে জগদ্ধাত্রী পূজার প্রচলন সর্বপ্রথম কৃষ্ণনগরে হয়, আবার কেউ কেউ বলেন জগদ্ধাত্রী সর্বপ্রথম চন্দননগরে হয়।
আপনারা যারা আমার এই লেখাটি আজকে পড়ছেন আশা করি তাদের মধ্যে জগদ্ধাত্রী পুজোর প্রচলন নিয়ে কোন সন্দেহ বা মতভেদ থাকবে না।
দুই শহরেই খুব ভালোভাবে জগদ্ধাত্রী পূজা পালিত হয়। তবে চন্দননগরের সাথে কৃষ্ণনগরের মূল পার্থক্য হল, চন্দননগরে সপ্তমী অষ্টমী নববী এবং দশমী। এই চার দিন ধরে পূজো হয়। আর কৃষ্ণনগরে শুধুমাত্র একদিন অর্থাৎ নবমীর দিনই সপ্তমী,অষ্টমী এবং নবমীর পূজা হয়।
তবে বর্তমানে বেশ কয়েক বছর হল কৃষ্ণনগরে জগদ্ধাত্রী পুজো বেশ ধুমধাম করে পালিত হচ্ছে। একদিনের পুজোটাকে শহরবাসী ক্রমশ দুইদিন থেকে তিনদিনে নিয়ে চলে গেছে। বর্তমানে কৃষ্ণনগরে অনেক গুলি বারোয়ারী বড়ো করে জগদ্ধাত্রী পূজা করে, সেখানে কারোর মূল আকর্ষণ থাকে থিম, কারোর লাইট, কারোর প্রতিমা। এছাড়াও আনুষাঙ্গিক অনেক বিষয় থাকে সেগুলি আমি আমার অন্য পোস্টে আলোচনা করব।
প্রসঙ্গতঃ, মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র যেহেতু খুব ভালবেসে পূজা করতেন তাই তিনি তার প্রজাদের মধ্যেও এই পূজার প্রচলন শুরু করেন। তিনি নিজে আর্থিকভাবেও বেশ কয়েকটি জায়গায় জগদ্ধাত্রী পূজার জন্য সাহায্য করতেন, যাতে তার মতো করে তার পুজোরাও জগধাত্রী পুজোটাকে খুব ভালোভাবে পালন করতে পারে। সেই থেকে আজও কৃষ্ণনগর রাজবাড়িতে জগদ্ধাত্রী পূজা হয়ে আসছে। যে পুজোর বয়স আড়াইশো বছরেরও কিছু বেশি।
নিচে আমি কয়েকটি ছবি দিচ্ছি, যেগুলি কৃষ্ণনগর রাজবাড়ির পূজা। এই ছবিগুলোর সবকটি চলতি বছরের জগদ্ধাত্রী পূজার ছবি। আপনারা মা জগদ্ধাত্রীর এই রূপ লক্ষ্য করলে দেখবেন, এখানে মা জগদ্ধাত্রীর বাহন সিংহ নয়। তার শরীরটা সিংহের মতো হলেও মুখটা আসলে একটি ঘোরার মতন। এবং তিনি তার বাহনের পিঠে এক পা ভাজ করে এবং এক পা ঝুলিয়ে বসে আছেন।মায়ের চার হাতে শঙ্খ,চক্র,তীর, ধনুক রয়েছে। এই প্রতিমা আকারেও খুব বৃহৎ নয়। এসবের একটাই কারণ। আসলে মা জগদ্ধাত্রী ঠিক এই ভাবেই অর্থাৎ কুমারী রূপে মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রকে স্বপ্নে দেখা দিয়েছিলেন,আর মহারাজ ঠিক সেভাবেই মূর্তি তৈরি করিয়ে পুজো শুরু করেন এবং আজও ঠিক এই ভাবেই রাজবাড়ীতে পুজো হয়ে আসছে।
●( সম্পূর্ণ লেখাটি আমার ছোটবেলা থেকে শুনে আসা বিভিন্ন গল্পের মাধ্যমে জানা। যেহেতু এর সঙ্গে অনেক ইতিহাস জড়িয়ে রয়েছে, তাই হয়তো অনেক তথ্য এখানে নাও থাকতে পারে অথবা কিছু ভুলও থাকতে পারে। যদি কোন ভুল থাকে তাহলে অবশ্যই আমাকে জানাবেন আমি তা সংশোধন করে নেব। এই বিষয়টির ওপর আমি আলাদাভাবে কোন চর্চা না করে লিখেছি। যদি এই বিষয়ে সম্পর্কে কেউ আরো কোন তথ্য জানেন, তাহলে অবশ্যই তিনি তার মত প্রসন করতে পারেন।)
আপনার পোস্টের মাধ্যমে জগদ্ধাত্রী পূজা প্রবর্তনের ইতিহাস সম্পর্কে জানতে পেরেছি। পোস্টটি পড়ে খুব ভালো লাগলো। আপনি খুব সুন্দর ভাবে আমাদের মাঝে পুরো ইতিহাস তুলে ধরেছেন। আপনার পুজোর প্রতিমার ফটোগ্রাফি গুলো খুব ভালো ছিল। এত চমৎকার পোস্ট শেয়ার করার জন্য আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ জানাই।
Downvoting a post can decrease pending rewards and make it less visible. Common reasons:
Submit
অনেক ভালো লাগলো জেনে যে আমার পোস্টের মাধ্যমে আপনি এই পূজার ইতিহাস সম্পর্কে জানতে পারলেন।ধন্যবাদ আপনাকে, আর অনেক শুভেচ্ছা।
Downvoting a post can decrease pending rewards and make it less visible. Common reasons:
Submit
সত্যি বলতে ভাই আমি নিজেও তোমাকে বলে বোঝাতে পারবো না এই পোস্টটা আমার কতটা ভালো লেগেছে। তুমি জানো আমি মায়ের কতখানি ভক্ত এবং মাকে কতটা বিশ্বাস করি। ইতিহাসের সত্যি মিথ্যা জানিনা । তবে মা আছেন এবং আমাদের সবাইকে তার কৃপায় রেখেছেন এটাই সবথেকে বড় কথা। সারা জীবন মনে থাকবে তোমার আজকের এই পোষ্টের কিছুটা সারাংশ। আর মায়ের পুজোতে যাওয়ার তো একটা ইচ্ছা আছেই। মা যেন খুব তাড়াতাড়ি আমার এই মনবাঞ্ছা পূর্ণ করেন 🙏🙏
জয় মা 🙏
Downvoting a post can decrease pending rewards and make it less visible. Common reasons:
Submit
মা তো অবশ্যই আছেন।কোনো না কোনো ভাবে তিনি তোমাকে,আমাকে,আমাদের দেখছেন।
তুমি চিন্তা কোরোনা, মা -ই তোমাকে তাঁর পুজোতে নিয়ে আসবে।
Downvoting a post can decrease pending rewards and make it less visible. Common reasons:
Submit