তরুণ বয়সে কাজী নজরুল ইসলাম
উনিশশো বাহাত্তর সালের ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে কলকাতায় এলেন সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান। সেই সফরে ব্রিগেডের ময়দানে তার ভাষণ লোকগাঁথার অংশ হয়ে আছে, তবে ওই একই যাত্রায় তিনি আর একটি অবিস্মরণীয় পদক্ষেপও নিয়েছিলেন।
বাহাত্তর সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ভারতে রাষ্ট্রীয় সফরে শেখ মুজিবকে রাষ্ট্রীয় অতিথির মর্যাদায় রাখা হয়েছিল কলকাতার রাজভবনে, যেটা পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপালের বাসভবন।
পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল তখন এ এল ডায়াস, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী প্রথমে কথাটা তাঁর কাছেই পাড়লেন।
নজরুল গবেষক ও প্রাবন্ধিক বাঁধন সেনগুপ্ত বিবিসিকে সেই ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে :
"শেখ মুজিব মি ডায়াসকে বললেন, দেখুন আপনাদের কাছে আমার একটা অনুরোধ আছে। এই শহরেই থাকেন কাজী নজরুল ইসলাম - তিনি যেমন আপনাদের কবি, তেমনি আমাদেরও কবি।"
"আমাদের ভাষা এক, সংস্কৃতিও এক। কবি নিজেও আগে বহুবার ঢাকায় এসেছেন। তো এবারে আমরা চাই কবিকে ঢাকায় নিয়ে গিয়ে ধুমধাম করে তাঁর জন্মদিন পালন করতে।"
নজরুলের 'বিদ্রোহী' কবিতাটি একশো বছর আগে যেভাবে লেখা হয়েছিল
"এ এল ডায়াস সব শুনেটুনে বললেন, অতি উত্তম প্রস্তাব - এমন তো হতেই পারে আমরা না হয় পালা করে কবির জন্মদিন পালন করলাম, একবার ঢাকায় আর পরেরবার কলকাতায়!"
"তবে দিল্লিই পারবে এই অনুমতি দিতে, ফলে আপনি বরং সরাসরি মিসেস গান্ধীর সঙ্গেই কথা বলুন। পরদিনই মুজিবও ঠিক সেটাই করলেন", বলছিলেন মি সেনগুপ্ত।
শুধু প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে কথা বলাই নয়, এরই মধ্যে রাজভবনে কাজী নজরুল ইসলামের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গেও দেখা করলেন শেখ মুজিব।
কবির দুই পুত্র, কাজী সব্যসাচী ও কাজী অনিরুদ্ধকেও তিনি জানিয়ে রাখলেন বাংলাদেশ সসম্মানে নজরুলকে নিয়ে গিয়ে সংবর্ধনা দিতে চায়।
কেমন আছেন দুখু মিয়ার গ্রামের মানুষ
কবিকে নিয়ে কূটনীতি
এরপরই শুরু হল এক নজিরবিহীন কূটনৈতিক তৎপরতা - তিন দশক ধরে বোধশক্তিহীন, নির্বাক এক কবিকে ভিনদেশে পাঠানো নিয়ে চিঠি-চালাচালি, শলা-পরামর্শ আর ভাবনা-চিন্তা।
ফেব্রুয়ারি থেকে মে - এই কয়েকমাসে নজরুলকে বাংলাদেশে পাঠানো নিয়ে দুই দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী, আবদুস সামাদ আজাদ ও শরণ সিংয়ের মধ্যেও বেশ কয়েকদফা পত্রবিনিময় হয়েছিল।
তবে দিল্লি সেগুলো আজও 'ডিক্লাসিফাই' করেনি।
প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী আবার মতামত চাইলেন পশ্চিমবঙ্গের তখনকার মুখ্যমন্ত্রী ও তাঁর অত্যন্ত আস্থাভাজন কংগ্রেসি নেতা সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের।
কবি নিজে সিদ্ধান্ত নেওয়ার অবস্থাতেই নেই, ফলে দূত পাঠিয়ে প্রধানমন্ত্রী কথা বললেন কবির পরিবারের সদস্যদের সঙ্গেও।
'নজরুলকে হিন্দু কবি হিসেবে তুলে ধরা হচ্ছে'
বাংলাদেশে ভারতের সাবেক রাষ্ট্রদূত ভিনা সিক্রির কথায়, "শেষ পর্যন্ত মৈত্রী আর বন্ধুত্বেরই জয় হল। দুটো দেশের মধ্যে যে পারস্পরিক প্রীতি ও শ্রদ্ধার সম্পর্ক, সেটার ভিত্তিতেই শেখ মুজিবুর রহমানের অনুরোধ ভারত মেনে নিল।"
"তবে এটাও ঠিক, দিল্লি ভেবেছিল কবির এই যাত্রাটা হবে সাময়িক - তিনি আবার কিছুদিন পরে ফিরে আসবেন।"
"কাজী নজরুল ইসলাম বা তাঁর পরিবারের সদস্যদের বাংলাদেশের নাগরিকত্ব দেওয়া হবে বা তাঁকে একদিন সেখানে জাতীয় কবির মর্যাদায় ভূষিত করা হবে - এগুলো কিন্তু তখন জানা ছিল না, আর ভাবাও হয়নি।"
তবে আজও নজরুলকেই বাংলাদেশ ও ভারতের মৈত্রীর সেরা নিদর্শন বলেই মনে করেন মিস সিক্রি, কারণ "নবীন একটি দেশে তার বন্ধু প্রতিবেশী একজন কবিকে পাঠাচ্ছে - এমন দ্বিতীয় কোনও নজির বিশ্বে আছে বলে আমার জানা নেই!"
ভারতের প্রবীণ রাজনীতিবিদ, পার্লামেন্টারিয়ান ও সাবেক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সৌগত রায় আবার মনে করেন, প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সিদ্ধান্তটাই ছিল এখানে আসল ব্যাপার।
সেই আমলের দাপুটে এই কংগ্রেস নেতা বিবিসিকে বলছিলেন, "ইন্দিরার সম্মতিটাই ছিল মূল কথা। উনি চেয়েছিলেন বলেই নজরুলকে ঢাকায় পাঠানো গিয়েছিল - এর মধ্যে কোনও ভুল নেই। বাকি ফ্যাক্টরগুলো গৌণ।"
পরিবারের মধ্যে মতভেদ?
নজরুলকে ঢাকায় পাঠানো ঠিক হবে কি না, তা নিয়ে কবির পরিবারের সদস্যদের মধ্যেই মতবিরোধ ছিল বলে অনেক নজরুল গবেষকই জানিয়েছেন।
বর্ষীয়ান নজরুল বিশারদ ড. বাঁধন সেনগুপ্ত যেমন সরাসরি বলছেন, "কবির ছোট ছেলে কাজী অনিরুদ্ধ চাননি বাবাকে ঢাকায় নিয়ে যাওয়া হোক। কিন্তু বড় ছেলে কাজী সব্যসাচীর আবার এ ব্যাপারে তুমুল উৎসাহ ছিল।"
স্ত্রী প্রমীলার মৃত্যুর পর (১৯৬২) কবি তখন থাকতেন কলকাতার পদ্মপুকুর এলাকার ক্রিস্টোফার রোডে কাজী সব্যসাচীর পরিবারের সঙ্গেই।
বিবিসি বাংলার জরিপে শ্রেষ্ঠ বাঙালি: ৩- কাজী নজরুল ইসলাম
কাজী অনিরুদ্ধর কন্যা ও নজরুলের নাতনি অনিন্দিতা কাজীও কিন্তু অস্বীকার করছেন না যে তার বাবা ও জেঠু এই বিষয়টা নিয়ে ঠিক একমত হতে পারেননি।
অনিন্দিতা কাজী এখন থাকেন আমেরিকার নিউ জার্সিতে।
সেখান থেকেই তিনি বিবিসিকে বলছিলেন, "আসলে কী, আমার বাবা (কাজী অনিরুদ্ধ) ছিলেন একটু শান্ত, মিতবাক ও টিমিড প্রকৃতির মানুষ। উল্টোদিকে জেঠু (কাজী সব্যসাচী) ছিলেন দাপুটে মানুষ - আর বড় ভাই হিসেবে পরিবারে তাঁর মতামতটাই প্রাধান্য পেত।"
"অনেকের মনেই এই প্রশ্নটা জাগতে পারে, মাত্র দিন সাতেকের জন্য ঢাকায় গিয়ে দাদু (কাজী নজরুল) কেন পাকাপাকিভাবে সেখানে থেকে গেলেন?"
"আসলে কী হয়েছিল, দিনকয়েক পর শেখ মুজিব যখন জেঠুর কাছে জানতে চাইলেন তারা কী করবেন, তখন জেঠু বললেন কবি তো ঢাকায় বেশ ভালই আছেন, চিকিৎসাতেও বেশ সাড়া দিচ্ছেন মনে হচ্ছে - তো উনি থাকুন না কেন?"
"আসলে ঢাকায় চিকিৎসার যে সুযোগ-সুবিধাগুলো পাওয়া যাচ্ছিল, কলকাতায় সেটা পাওয়া যাবে না বলেই জেঠুর মনে হয়েছিল", বলছিলেন অনিন্দিতা কাজী।
কবির নাতনি অনিন্দিতা কাজী
নজরুল ইসলামের পরিবারের যে শাখাটি তাঁর জন্মস্থান চুরুলিয়া বা তার আশেপাশে এখনও বসবাস করেন, তারই একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য সঙ্গীতশিল্পী সোনালি কাজী।
সোনালি কাজী মনে করেন, কবিকে ঢাকায় পাঠাতে তাঁর পরিবার রাজি হয়েছিল প্রধানত উন্নত চিকিৎসার আকর্ষণে।
বিবিসিকে তিনি বলছিলেন, "একটা জিনিস ভাবুন, তিরিশ বছর ধরে একটা মানুষ নির্বাক, তাঁর মস্তিষ্ক কাজ করছে না। কলকাতার ডাক্তাররাও একরকম জবাব দিয়ে দিয়েছেন।"
"এই অবস্থায় একটি নতুন দেশের প্রধানমন্ত্রী বলছেন তাঁরা যথাযোগ্য মর্যাদায় কবিকে নিয়ে যাবেন এবং ভাল করে চিকিৎসা করাবেন। তখন কবির পরিবার যদি তাঁর কথায় আস্থা রাখে, তাহলে কি তাদের দোষ দেওয়া যায়?"
তবে ভারতের সাবেক কূটনীতিবিদ ও রাষ্ট্রদূত চন্দ্রশেখর দাশগুপ্ত আবার এই ব্যাখ্যার সঙ্গে একমত নন।
সে সময় ঢাকার ভারতীয় দূতাবাসে কর্মরত মি. দাশগুপ্ত বলছিলেন, "দেখুন সেই সত্তরের দশকে ভাল চিকিৎসার জন্য লোকে ঢাকা থেকে কলকাতায় আসত।"
"ফলে কলকাতার চেয়ে উন্নততর চিকিৎসা পাওয়া যাবে বলে কবিকে ঢাকায় পাঠাতে পরিবার রাজি হয়ে গেল, এটা ঠিক আমার কাছে বিশ্বাস্য মনে হচ্ছে না", বিবিসিকে বলছিলেন তিনি।
বাঁধন সেনগুপ্ত আবার মনে করেন, আর্থিক কারণটাও এখানে বড় ভূমিকা পালন করে থাকতে পারে।
"তিরিশ বছর ধরে নজরুলের তখন কোনও রোজগার নেই। ভারত সরকারের চারশো রুপি আর পূর্ব পাকিস্তান সরকারের আড়াইশো রুপি মাসোহারাই ভরসা। এর ওপর বহু বছর ধরে কবির আর তাঁর স্ত্রীর চিকিৎসা, ওষুধপত্রের খরচ!"
"ফলে রাষ্ট্রীয় সম্মানে যখন কবিকে বন্ধু দেশ সব খরচ দিয়ে নিয়ে যেতে চায়, পরিবারের তাতে রাজি হওয়াটাই তো স্বাভাবিক", বলছিলেন মি সেনগুপ্ত।
টাইপ: চৌর্যবৃত্তি।
এ ধরনের পোস্ট আমার বাংলা ব্লগ কমিউনিটি Allow করে না। নতুন ইউজার হওয়ার কারণে শুধুমাত্র আপনার পোস্ট Mute করা হচ্ছে। পরবর্তীতে আবার একই ধরনের কাজ করলে আপনার একাউন্ট কমিউনিটি থেকে ব্যান করা হবে।
কমিউনিটির নিয়মাবলী ভালোভাবে পড়ে নিন
https://steemit.com/hive-129948/@rme/last-updated-rules-of-amar-bangla-blog-community-16-aug-22
যে কোন বিষয়ে জানার প্রয়োজন হলে আমাদের সাথে Discord এ যোগাযোগ করুন।
Discord server link: https://discord.gg/ettSreN493
Source:
https://pataka24.com/%E0%A6%95%E0%A6%B2%E0%A6%95%E0%A6%BE%E0%A6%A4%E0%A6%BE-%E0%A6%A5%E0%A7%87%E0%A6%95%E0%A7%87-%E0%A6%95%E0%A7%80%E0%A6%AD%E0%A6%BE%E0%A6%AC%E0%A7%87-%E0%A6%B8%E0%A7%8D%E0%A6%A5%E0%A6%BE%E0%A7%9F/
Downvoting a post can decrease pending rewards and make it less visible. Common reasons:
Submit