হাত বদল

in hive-129948 •  3 months ago 

20241122_132359-01.jpeg

সারাদিন চেম্বারের কাজকর্ম শেষ করে অনেকটা তড়িঘড়ি করেই, রাত আটটার ভিতরেই স্থানীয় সরকারি হাসপাতালের উদ্দেশ্যে রওনা। আজ বৃহস্পতিবার, পুরো রাতটাই নির্ঘুম কাটবে।এমনিতেই মফস্বল শহর তার ভিতরে স্থানীয় সরকারি হাসপাতালে প্রতিনিয়ত রাত-বিরাতে প্রচুর রোগীর চাপ লেগেই থাকে। দেখে বোঝার উপায় নেই, এটা কি মফস্বলের ছোট হাসপাতাল নাকি মেডিকেল কলেজ।

বলছি এখন থেকে বছর সাতেক আগের ঘটনা, মাত্র তিন-চার জন ডাক্তার , অল্প সংখ্যক নার্স- মেডিকেল এসিস্ট্যান্ট-টেকনোলজিস্ট দিয়েই মোটামুটি দিব্যি স্বাস্থ্য সেবা চলতো পঞ্চাশ শয্যার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। যেহেতু ক্লিনিক্যাল কাজে কিছুটা দুর্বলতা ছিল, তাই সপ্তাহে অন্তত দুদিন ছুটে যেতাম স্থানীয় সরকারি হাসপাতালে।

একদম মাগনায় সিনিয়র কলিগদের সহযোগিতায় খুব কাছ থেকে রোগী দেখতাম। ক্লিনিক্যাল কাজগুলো কতটুকু পরিপক্ক ভাবে সেসময় আয়ত্তে নিয়ে আসতে পেরেছিলাম তা জানি না, তবে প্রায় রাতেই ভিন্ন রকমের অভিজ্ঞতা হয়েই থাকতো। ঘুরে ঘুরে হাসপাতালের বিভিন্ন ওয়ার্ডে ভর্তি রোগীদের খুব কাছাকাছি যেতাম দাঁড়িয়ে থাকতাম আর তাদের সমস্যার কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনতাম।

প্রত্যেকটা রোগী যেন ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকতো, খুব করে চাইতো যেন আরেকটু কাছে গিয়ে তাদের কথা শুনি। তেমনটা সুযোগও দিতাম, তবে কতটুকু তাদের উপকারে আসতে পারতাম তা জানতাম না, তবে প্রায়ই মাঝে মাঝে সিনিয়র কলিগদের মাধ্যমে জানতে পারতাম, অনেক রোগীই নাকি আমাকে এসে খুঁজতো। কেনো খুঁজতো তা আর কখনো জানতে চাওয়া হয়নি।

একবার সেকি অবস্থা, সিনিয়র কলিগ দুজনই রোগী দেখছিলেন জরুরী বিভাগে, ইতিমধ্যেই উপর থেকে নার্সের কল, বলছিল পুরুষ ওয়ার্ডে ভর্তি পাঁচ নাম্বার বেডের রোগীর অবস্থা ভীষণ আশঙ্কাজনক। সেসময় কত দ্রুত যে উপরতলায় ছুটে গিয়েছিলাম, তা যেন বুঝতেই পারি নি।

রোগীর কাছে যেতেই, রোগীর আত্মীয়-স্বজন যেন হাউমাউ করে ওয়ার্ডের ভিতরে কান্নাকাটি শুরু করে দিয়েছিল। দ্রুতই রোগীর কাছে গিয়ে বসে, হাত ধরে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে নাড়ির স্পন্দন দেখার চেষ্টা করছিলাম আর রোগীর লোকজনের কাছ থেকে রোগীর সমস্যা শোনার চেষ্টা করছিলাম। মূলত রোগী কথা বলার মত অবস্থাতে ছিল না, তাছাড়া হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসছিল, নাড়ির স্পন্দন ক্রমশ ধীরে দিচ্ছিল, ইতিমধ্যেই রোগীর চোখ অনেকটাই উল্টে যাওয়ার মত অবস্থা, নিচ থেকে উপরতলায় এত দ্রুত চলে এসেছিলাম যে, স্টেথোস্কোপ নিয়ে আসতে ভুলে গিয়েছিলাম।

অতঃপর সরাসরি রোগীর বুকে কান দিয়ে হৃদস্পন্দন শোনার চেষ্টা করছিলাম। সেটাও আমার কাছে খুব একটা ভালো ঠেকছিল না। এসবের ভিতরেই জানতে পারলাম, রোগী ঢাকা থেকে লোকাল বাসে করে আসছিল, পথিমধ্যে কি যেন খেয়েছিল, তারপর হঠাৎ করেই শরীরে অতিরিক্ত পানি শূন্যতার লক্ষণ দেখা দেয় এবং নিস্তেজ হয়ে যায়। অবশেষে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পরেও শিরায় স্যালাইন চলা অবস্থাতেও বেশ কয়েকবার তাকে টয়লেটে যেতে হয়েছিল।

তবে তারপরেও রোগীর তেমনটা উন্নতি হয়নি বরং রাত বৃদ্ধি হওয়ার সাথে সাথে শারীরিক অবস্থা আরও বেগতিক হয়ে গিয়েছিল । বলতে গেলে একদম প্রাণ যায় যায় অবস্থা, এ সময় তাৎক্ষণিক সঠিক চিকিৎসা খুবই দরকার। মুঠোফোনটা বের করে দ্রুত সিনিয়র কলিগকে ফোন দিলাম, জরুরী বিভাগ থেকে তারাও দ্রুত ছুটে এসেছিল।

আমাকে শুধু সিনিয়র কলিগ বলেছিল, দ্রুত একটা কলেরা স্যালাইন ব্যবস্থা করার জন্য। এটা শোনা মাত্রই, আমি যেন চেঁচিয়ে নার্সকে ডেকে কলেরা স্যালাইন আনতে বললাম এবং রোগীর শরীরে আগের যে স্যালাইনটা চলছিল তার গতি দ্রুতই বাড়িয়ে দিয়েছিলাম। অন্যদিকে রোগীর আরেক হাতে ক্যানুলা করার জন্য শিরা খুঁজতেছিলাম, তবে বারবার ব্যর্থ হচ্ছিলাম। রোগীর অবস্থা এতটাই কাহিল ছিল যে শিরা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না।

অবশেষে আমি আর সিনিয়র কলিগ, দ্রুত রোগীর হাত চেপে ধরে বহু কষ্টে শিরা বের করে তাতে ক্যানুলা সেটআপ করে, অবশেষে কলেরা স্যালাইনের উপরে স্ফিগমোম্যানোমিটার লাগিয়ে দ্রুত চাপ দিয়ে খুবই জোরে রোগীর শিরায় স্যালাইন প্রবেশ করানোর ব্যবস্থা করে ছিলাম। স্যালাইন এত দ্রুত রোগীর শিরায় প্রবেশ করছিল যে, মনে হচ্ছিল পানির ট্যাপ ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।

যাক খানিকবাদে রোগীর চেতনা ফিরে আসার পরে, রোগী বারবার বলছিল আমি এতক্ষণ ধরে আপনাদের সবকিছুই অনুমান করতে পারছিলাম, তবে কোন কিছুই মুখে বলতে পারছিলাম না। মনে হচ্ছিল, কে যেন আমার গলাচিপে ধরেছিল। মুহূর্তেই রোগীর লোকজন এবং রোগীর মুখে প্রশান্তির হাসি সকলে দেখতে পেয়ে ছিলাম। অতঃপর তাদেরকে বিদায় জানিয়ে উপর থেকে নিচতলায় এসেছিলাম।

আজ বহুদিন পরে হাত ঘড়িটা যখন নেড়েচেড়ে দেখছিলাম, তখন মুহূর্তেই সেই রাতের কথা বারবার মনে পড়ছিল। হাসপাতালে যাতায়াত আর চেম্বারে প্র্যাকটিস করার সময়ে বহুবার হাত ঘড়িটার প্রয়োজন পড়েছিল। তারপরে তো মেডিকেল প্রফেশন ইস্তফা দিলাম।

এখনো বেশ ভালো ভাবে মনে আছে, যখন শিক্ষানবিশ ছিলাম, সেই সময়ের জমানো অর্থ দিয়ে ঘড়িটা বেশ শখ করে কিনেছিলাম। দেখুন না, এতবছর পরেও ঘড়িটা এখনও প্রায় নতুনের মত আছে। দীর্ঘদিন ঘড়িটা ব্যবহার করা হয় নি। তবে প্রায়ই ভাবতাম, ঘড়িটার হাত বদল দরকার। মানে যার কাছে ঘড়িটা যাবে, সে যেন ঘড়িটার সঠিক ব্যবহার করে।

তবে সেই রকম বিশ্বস্ত মানুষ খুঁজেই পাচ্ছিলাম না। অবশেষে বহুদিন পরে গতকাল সন্ধ্যায় এক যোগ্য মানুষকে পেয়েছিলাম, যে কিনা ঘড়িটা পাওয়ার উপযুক্ত। খুব সযত্নে তার হাতে ঘড়িটা তুলে দিলাম এবং কানে কানে ফিসফিসিয়ে বললাম আজ থেকে ঘড়িটা আপনার, তবে শখের জিনিস তো একটু আগলে রাখিয়েন।

puss_mini_banner.png

Banner-22.png

ডিসকর্ড লিংক
https://discord.gg/VtARrTn6ht


20211003_112202.gif


JOIN WITH US ON DISCORD SERVER

banner-abb4.png

Follow @amarbanglablog for last updates


Support @heroism Initiative by Delegating your Steem Power

250 SP500 SP1000 SP2000 SP5000 SP

Heroism_3rd.png

VOTE @bangla.witness as witness


witness_vote.png

OR

SET @rme as your proxy

witness_proxy_vote.png

Authors get paid when people like you upvote their post.
If you enjoyed what you read here, create your account today and start earning FREE STEEM!
Sort Order:  

Upvoted! Thank you for supporting witness @jswit.

এমন শখের ঘড়িটা আপনি আরেকজনকে দিয়ে দিলেন কেন? নিজের কাছেই না হয় রেখে দিতে পারতেন বাকি জীবন। তবে মেডিকেল প্রফেশন একেবারে ছেড়ে দিয়ে আপনি ভালো করেছেন মনে হয় না।। কিছু রোগীর চিকিৎসা করতেই পারতেন ভাই। আপনি ডাক্তার মানুষ, চিকিৎসা করাই যে প্রথম ধর্ম। সম্পূর্ণ ঘটনাটি বেশ টান টান ছিল। আপনি মানুষটির প্রাণ বাঁচাতে পেরেছিলেন এটাই ঈশ্বরের আশীর্বাদ।

এমন অনেক পুরনো ঘটনা আছে দাদা, যা আমাকে মাঝে মাঝে প্রচুর ভাবায়। ঘড়িটা ইচ্ছে করেই দিয়েছি, যাতে অন্যের কাজে লাগে। মেডিকেল প্রফেশনে একদম মন সায় দেয় না দাদা।

আসলে রোগীর প্রতি ডক্টরদের আন্তরিকতা থাকলে বেশিরভাগ সময়ই ভালো কিছু হয়ে থাকে। আপনি আসলেই বেশ আন্তরিক ছিলেন সেই রোগীর ব্যাপারে। তারই ফলশ্রুতিতে সেই রোগী তাড়াতাড়ি ভালো হয়ে উঠে। যাইহোক এতো বছর ঘড়িটা যত্ন করে রাখার পর,অবশেষে হাতবদল হলো তাহলে। পোস্টটি আমাদের সাথে শেয়ার করার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ আপনাকে।

আপনার মন্তব্যের কাছে, আমি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।

এমন অনেক জিনিস আছে যা কিনা চোখের সামনে চলে এলে পুরনো স্মৃতি মনে পরে যায়।আপনার বেলায় ও তেমন কিছুই হয়েছে।তবে একটি কথা আমি সব সময় মনে করি যেকোনো সিরিয়াস পেসেন্টের কাছে কোন ডাক্তার যদি আন্তরিকতার সাথে তার সমস্যা গুলো শুনতে আগ্রহী হয় সেই পেসেন্ট অনেকটা ই সুস্থ হতে বাধ্য। বাঁচবে না মারা যাবে সেটা একান্ত ই মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের হাতে।সুন্দর আচরনের দ্বারা যদি একজন মানুষ কে বাঁচার সাহস জোগাতে পারে তা একমাত্র একজন আন্তরিক ডাক্তারই পারেন।আপনার মধ্যে সবাই হয়তো তেমন কিছুই পেয়েছিল।আর এজন্য কঠিন সময়ে আপনাকেই খুঁজেছিল।শখের আর প্রয়োজনীয় জিনিসটির হাত বদল হলো।আশাকরি সেই মানুষটি এর মূল্য বুঝবে।সুন্দর অনুভূতি গুলো শেয়ার করার জন্য অনেক ধন্যবাদ জানাচ্ছি।

শখের জিনিসগুলো যখন উপযুক্ত মানুষের হাতে যায়, তখন নিজের থেকে একপ্রকার শান্তি পাওয়া যায় আপু।

আমাদের প্রত‍্যেকটা জিনিসের সাথে এমন ঘটনা এমন অতীত জড়িয়ে থাকে। ঐ রাতের কথা পড়তে গিয়ে একটা কৌতূহল আমার মধ‍্যেও যেন কাজ করছিল। যাইহোক অবশেষে ঘড়ির জন্য যোগ্য একজন মানুষ পেয়েছেন দেখে ভালো লাগল।

আমি নিজেও খুব খুশি, ঘড়িটার যোগ্য মানুষ পেয়ে।