জীবনের ব্যস্ততায় যে ছোট ছোট কথা-রা আড়ালে চুপটি মেরে বসে থাকে। অথচ এ জীবনে তারা-ই মেঘের কোলে সুদর্শনের উড়ে যাওয়ার মতোই এক স্বপ্নময় স্নিগ্ধ-শান্তি ও আনন্দ নিয়ে আসে। আজ তাদের নিয়েই কথা হলো।
আমাদের অভিমানগুলো তুলোর মত নরম ছিল। একটা ফোলা-বেলুনের ওপর যতটুকু ভরসা করা যায়, আমাদের রাগগুলোর স্থায়িত্তর ওপর ততটুকু ভরসা করা যেতনা। আমাদের চাহিদা আকাঙ্খা ছিল ছোট্ট বিড়াল ছানার হৃদয়ের মতন সহজ। আমাদের মন খারাপ করতো একটা খেলনা গাড়ির জন্যে। না পাওয়ার আগে অব্দি সেটাই চিন্তার বিষয় হিসেবে প্রাধান্য পেত। তারপর পেয়ে গেলে কত খুশি। হৃদয়ের কলস আনন্দ-জলে উগলে উঠতো। বেশ কিছুদিন সেটা ব্যতীত আর কিছু চাওয়ার থাকতো না।
ছোটবেলায় খুব বেশি খেলনা সামগ্রী আমি পায়নি। আমার সেরকম বিশেষ কিছু মনে পড়েনা। অতিরিক্ত প্যাম্পার্ড আমার ছেলেবেলায় কোনোকালেই ছিলনা। যদি কিছুটা পেয়ে থাকি সে আমার দাদীর থেকে। স্মৃতি ঘেঁটে দেখলে দু একটা উপহার আমার চোখের সামনে ভেসে ওঠে, যেগুলো আমার কাছে ভীষণ মূল্যবান ছিল। তারমধ্যে ছিল একটা ছোট্ট মাটির ছাগল। দু ' টাকা দিয়ে আমার দিদি মেলা থেকে কিনে এনে দিয়েছিল। গলায় দড়ি বেঁধে সে ছাগল আমি টেনে নিয়ে বেড়াতাম দিন-রাত। রাতে ছাগলটা নিয়ে ঘুমিয়ে পড়তাম। তারপর একদিন কাঠের বড় বাক্সের ওপর থেকে ছাগল পড়ে দু'খান হয়ে গেল। সেকি আর কম দুঃখ!
আরেকটা উপহার ছিল আমার বড় প্রিয়। এই প্রিয় নিয়ে দু একটা কথা আমাকে বলতেই হয়। সে হল - প্রিয় কি এমনি এমনিই হয়? হয়না। নাহলে আমরা সব কিছুই মনে রাখতম। আরো হয়তো অনেক কিছুই পেয়েছি, সেগুলো হয়তো দামিও ছিল খুব। কিন্তু মনে নেই। ভালোবাসার হিসেব অন্যরকম। আলাদা। তাই দিদির দু টাকার কিনে দেওয়া মাটির ছাগলকে ভুলতে পারিনা। বরং বলতে ভালো লাগে ওটাই আমার সব থেকে প্রিয় উপহার। দিদি নিজেও ছোট। কোথা থেকে কিভাবে জোগাড় করা দুটো পয়সা থেকে ভাইয়ের জন্য মাটির ছাগল কিনে নিয়ে এসেছে। এমন উপহার যে কোটি টাকা দিয়ে পাওয়া যায়না, সেতো আমি জানি।
আরেকটা উপহার, যেটা বলছিলাম তা হল একটা জামা। সত্তর টাকার একটা ফুলহাতা কমলা রংয়ের জামা। দিয়েছিল আমার এক দাদা। আমার পিসির ছেলে। আমার মনে পড়ছে দাদা তখন কলেজে পড়ত। প্রথম-বর্ষই হবে হয়তো। সে নিজেই বেকার। তবে আমাকে সে জামা কিনে দেবে, যে ভাবেই হোক। জানি বাড়ি থেকে পাওয়া সামান্য হাত খরচটুকু দিয়ে সে জামা কিনে দিয়েছিল। তাই এই উপহারগুলো কোনোদিনই ভোলা যায়না।
দাদা আমাকে মাঝে মাঝেই ঘুরতে নিয়ে যেত। চকলেট কিনে দিতো। চুইংগাম। এসকল কিছু। একদিন দেখলাম দুটো কলা কিনলো। আমার হাতে একটা দিয়ে বলল খা ভাই। কলাটা একটু কাঁচা ছিল। দাদা দোকানদারের দোষ দিয়ে বললো লোকটা ঠকালো আমাদের। তারপর বললো একটু কষ্ট করে খেয়েনে ভাই। ফেলিস না। টাকা দিয়ে কেনা।
সেদিন বুঝেছিলাম দাদা উপহারের জামাটা অনেক কষ্ট করেই কিনে দিয়েছে আমায়। তারপর কতদিন কতবছর চলে গেছে। দাদা নিজেও ভুলে গেছে হয়তো সব। কিন্তু আমি ভুলিনি। আমার প্রিয় উপহার কখনোই ভুলিনি।
আমাদের বয়স বেড়েছে। শরীরের। মনের। আমাদের আকাঙ্খা বেড়েছে। চাওয়া বদলেছে। আমরা প্রতিদিন একটু একটু করে পুরনো হয়ে যাচ্ছি। বা নতুনও হয়ে যাচ্ছি। কত হেরফের। কত বদল। আমাদের এই আশ্চর্য চলে যাওয়ার পথে এরকমই কিছু কিছু স্মৃতি থেকে যাক। সাথে থাক। সাথে যাক।
বন্ধুরা আজ এই অব্দি রইল। আগামী কাল নতুন একটি লেখা আবার হাজির হবো। ততক্ষণ ভালো থাকুন। সুস্থ থাকুন। ধন্যবাদ।