( পর্ব - ১ ) আমার শৈশব ।। পুরুলিয়ার দিনকাল ( ১০% লাজুক ভাই এর জন্য বরাদ্দ )

in hive-129948 •  2 years ago  (edited)

image.png

image source

কি লিখবো বলুন তো ? মানে ঠিক কি লেখা যায়, দুদিন সিস্টেম খুলিনি। আজকেও ইচ্ছে হচ্চিল না কিন্তু কিছু মেইল চেক করার জন্য বাধ্য হয়েই খুললাম। তারপর এটা লিখতে বসলাম। এখন কি লিখবো বুঝতে পারছি না। দিন তিনেক তো কলেজের প্রেম গুলো লিখছিলাম, এখন সেটাও ভালো লাগছে না, একবার ভাবলাম স্কুল দিনের কথা লিখি। কিন্তু লিখবো কি, নিজের লাথ খাবার গল্প কারই বা ভালো লাগে লিখতে ।

আচ্ছা একটা সত্যি কথা বলি আজ, আমার না একটা পোষা বাঘ আছে জানেন, এই এত্ত বড় একটা কেঁদো বাঘ, বেশ লেজ নাড়িতে হালুম হালুম করে। খেতে দিয়ে দুধ ভাত খাই। খাওয়া হয়ে গেলে চৌকাঠে বসে বেশ গোঁফ চাটে। মানে একটা বেড়াল যা যা করে এই ব্যাটাও ঠিক সেই কাজ গুলোই করে। এবার আপনারা ভাববেন তাহলে তো বেড়াল এটা। আমি বাঘ বলে চালাচ্ছি। কিন্তু না সত্যিই এটা বাঘ। আমার জন্য সবকিছু করতে পারে, লেজ নাড়ানো থেকে শুরু করে কারোর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়া সবকিছু। সব মানে সব।

সেই ছোট্ট বেলা যখন স্কুলে পড়তাম, সামারের ছুটিতে স্কুল বন্ধ, পাক্কা দেড় মাস বাড়িতে । দুপুর বেলা খাওয়া দাওয়ার পর আমার ইচ্ছে হতো বাইরে ঘুরতে যাবার, তক্ষুনি মা চোখ বড় বড় করে চুপ চাপ শুয়ে পড় বলে এক রাম ধমকানি দিত। আমার ভেতরের বাঘটা তখন গর্জন করতে শুরু করতো। প্রতিবাদে ফেটে পড়ত। কিন্তু মায়ের সামনে দেখেছি বাঘ কেন, ড্রাগনও কেমন যেন ভেজা বেড়ালের মত হয়ে যেত।
সব বন্ধুরা দেখতাম দুপুরে খাবার পর গ্রামের এক কোনাতে একসাথে গোল করে বসে খেলা করতো, কখনো জঙ্গলে পিয়াল কুড়োতে যেত। কখনো কাল বৈশাখী এলে আম কুড়োনো। আমি জানালা দিয়ে দেখতাম শুধু। যাবার অনুমতি ছিল না। রাগে ফেটে গিয়ে মায়ের ওপর অভিমান করতাম। বিকেল বেলা কথা বন্ধ। বন্ধ মানে জাস্ট বন্ধ, কথায় বলবো না শালা, কোণদিন কথা বলবো না। কিন্তু সন্ধ্যে হলেই সামনের তালগাছ দুটো কেমন যেন হয়ে যেত। বেশ বুঝতে পারতাম ওদুটো আর তালগাছ নাই, দিব্যি নড়াচড়া করছে। একজনের আবার একটা এক্সটড়া ঠ্যাংও গজিয়েছে। দেখব না দেখব না করেও বার বার চোখ চলে যেত ওদিকেই। বেশ বুঝতে পারতাম গাছ দুটো চলাফেরা করছে। একজন তো একটু এগিয়েও আসছে মনে হতো মাঝে মাঝেই, সকাল বেলা অবশ্য গাছের মতই থাকতো।

ঠাম্মি বুঝতে পারতো মনে হয়। মাঝে মাঝেই রাতে খাবার পর শুয়ে শুয়ে ঠাম্মিকে বলতাম ব্যাপারটা। মন দিয়ে শুনতো তারপর বলতো ওই গাছ দুটোতে নাকি সত্যিই ভুত আছে। ছোট বেলা ঠাম্মি যখন আমার মত ছিল তখন ঠাম্মিও দেখেছে। আর তাল গাছ দুটোর পাশেই এই ঝাঁকড়া কয়েকটা গাছ ছিল। একটা হিজল, খান তিনেক তমাল আর কয়েকটা পিয়াল গাছ। একটু দুরেই জঙ্গল শুরু। রাতের বেলা জানালা খুলতাম না ওদিকের।

জঙ্গলে অবশ্য আমাকে মোটামুটি ক্লাস এইট না ওঠা অবধি ঢুকতে দিত না, তারপর মাঝে মাঝে যেতাম। যত বড় হয়েছি জঙ্গলের ভেতরে ঢোকার পরিধি বেড়েছে, আর জঙ্গল ছোট হয়েছে আসতে আসতে, দুটোই সমান তালে। এখন পুরুলিয়ার জঙ্গল বলতে আর কিছুই নেই। কিছু শাল সেগুন আর পিয়ালের ঝোপ ছাড়া।

তো হ্যা যা বলছিলাম, ছোট বেলাতে আমাকে ছাড়তো না ঠিকই কিন্তু ইয়া বড় একটা জানালা ছিল আমাদের। পুরোনো দিনের গ্রামের মক্কেলদের কোঠা বাড়ি যেমন হয়। এই বড় বড় জানালায় পরদার ফাঁক দিয়ে ধু ধু পুরুলিয়ার আকাশ দেখা যেত সেই ছোটনাগপুর ওবধি। মাঝে কত কত যায়গা, সিংভুম, বড়াভুম , মল্লারপুর , বান্দোয়ান , দুয়ারসিনি আরো কত কত । নামই জানতাম না। বাবা মাঝে মাঝে গল্প করতো তখন শুনতাম।

তো সেই জানালায় পা ঝুলিয়ে বসে আমি আমার বাঘ টার সাথে গল্প করতাম। সে কি গল্প, বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে, গল্প আর থামে না, মায়ের ওপর রাগটাও ততক্ষণে কমে যেত একটু। অবশ্য সন্ধ্যে সন্ধ্যে হলেই মা যেই একটা বর্নভিটা নিয়ে আসতো ততক্ষনে রাগ আবার শুরু হয়ে গেছে। অবশ্য ততক্ষনে আমার অনেক যায়গা ঘোরাও হয়ে গেছে, সিংভুম ছাড়িয়ে ওদিকের বিহার বর্ডার, এদিকের বাকুড়া সব ঘুরে নিয়েছি। সাথে বাঘটাও থাকে সবসময়। মাঝে মাঝে বিদেশ যেতাম, তখন টিভি আসেনি আমাদের গ্রামে। রেডিও চলতো খুব। রেডিওতে আর দাদুর রেকর্ডে গান শুনতাম মেরা জুতা হ্যায় জাপানী। পাতলুম হিন্দুস্থানী।

মাঝে মাঝে জাপান যেতাম, দাদুর মুখে শুনেছি ওরা নাকি জাপানি তাই জাপানিতেই কথা বলে। বাংলা হিন্দির মত না। আমি বাংলার সাথে হিন্দি পাঞ্চ করেও তাদের সাথে কথা বলার চেস্টা করতাম। কিন্তু বুঝতে পারতাম না তারা কি বলছি।

এভাবেই একদিন দেখতাম দুম করে ছুটি শেষ হয়ে গেছে। কি রাগ আমার, আবার স্কুলে যেতে হবে। এবার বাড়ি ফিরবো সেই পুজোর সময়। মাঝে লম্বা ৪ মাসের বোর্ডিং স্কুল। তবে স্কুল আমার ভালোই লাগে। অনেক বন্ধু আছে কিন্তু যাবার আগে মন খারাপ লাগে, চলে গেলে আর মন খারাপ হত না দেখতাম।

তারপর আর কি, মা দেখতাম বাস্কো গুছিয়ে চান করিয়ে গালে একটা চুমু খেয়ে বাবার হাতে ধরিয়ে দিত। ব্যাস আমিও গুটি গুটি বাবার সাথে সোজা স্কুল। স্কিলে গিয়ে খারাপ লাগতো না , কিন্তু বড্ড ঠাম্মা আর দাদুর জন্য মন খারাপ করতো। শুনেছি এই স্কুলটাই আমার বাবা কাকা দাদু সবাই পড়াশুনো করেছে, তখন অবশ্য বোরডিং ছিল না , ডে স্কুলের মতই ছিল। কিন্তু এখন আমরা এসে যাওয়াতে স্কুলটা বোর্ডিং হয়ে গেছে।

বাড়ি থেকে স্কুল বেশ কয়েক ঘন্টা লাগতো আমার। বাবার সাথে গল্প করতে করতে যেতাম তারপর বাবা স্কুলে পৌঁছে আমাকে ওয়ার্ডেনের হাতে জমা করেই লুকিয়ে লুকিয়ে হাতে নগদ একশ টাকা দিত। আর চোখ পাকিয়ে বলতো মা কে বলবি না একদম, বললে আর দেব না। আমিও সোনা ছেলের মত বাবার থেকে টাকাটা নিয়ে সবথেকে কঠিন যে চেইন সেটা খুলে তার ভেতর ঢুকিয়ে চেন বন্ধ করে দিতাম। তারপর একটু পড়েই বাবা চলে যেত বাড়ি। আমার একটুঁ একটু মন খারাপ হত ঠিকই কিন্তু ততক্ষনে বাকি বন্ধুরাও এসে গেছে। আর মন খারাপ হতো না। ব্যাস আর কি । এরপর বাড়ি থেকে কে কি চকলেট এনেছে সেই গল্প আর আর কার বাড়িতে বলেছে বড় হলেই একটা সাইকেল কিনে দেবে সেই গল্পে দিন শেষ। পরের দিন থেকে ক্লাস শুরু।

( চলবে )

Authors get paid when people like you upvote their post.
If you enjoyed what you read here, create your account today and start earning FREE STEEM!