দ্বীনের জন্য সাহাবায়ে কেরামের কুরবানী আর আমাদের উদাসীনতা

in hive-129948 •  2 years ago 

আমার নিজের প্রতি ধিক্কার, 'আমি তো শুধু পেতে চাই! আমি লোভী! প্রচন্ড লোভ আমার! আমি মুসলিম কিন্তু লোভাতুর আমার মন! এই দ্বীনের জন্য আমি একটা কাটার আঘাতও সয়ে দেখিনি! কারও একটুখানি কটু কথা আমাকে শুনতে হয়নি! গালিগালাজ শুনিনি কোনো দিন! নির্যাতন-নিপীড়ন-বয়কটের সম্মুখীন তো কখনোই হতে হয়নি আমাকে!'। নিজের প্রতি ধিক্কার আসে বারবার।

মন ছুটে যায় ইতিহাসের পাতায়। সাড়ে চৌদ্দশ বছর আগের সেই সোনালী অতিত! আমাকে ভাবিয়ে তুলে, গভীর রাতে পৃথিবী যখন ঘুমের রাজ্যে স্বপ্নে বিভোর, তখন কে যেন মনে করিয়ে দেয় বারংবার।
ইসলামের রক্তস্নাত দিনগুলো ভেসে ওঠে চোখের সামনে। আহ! কেমন ছিলেন প্রিয় নবীজী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! কেমন ছিলেন তার প্রিয় সহচর সাহাবায়ে কেরাম রাদিআল্লাহু তা’আলা আনহুম! কেমন ছিল তাদের মহান জীবন! কেমন ছিল তাদের ত্যাগের নজরানা!
সাহাবি হযরত কারাবা রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহুর একটি ঘটনা- মক্কা নগরী থেকে হিজরত করে মদিনায় সবেমাত্র ফিরে এসেছেন তিনি। সাথে ছিল শিশু সন্তান বাশির। মক্কা থাকার সময় স্ত্রীকে হারিয়েছেন। অন্যান্য সাহাবায়ে কেরামের সাথে মক্কার চিরচেনা নিজের বাড়িঘর, আত্মীয়-স্বজন, ধনসম্পদ সব ছেড়ে মদিনায় হিজরত করেতে হয় তাকে। তার অপরাধ ছিল, সে এক আল্লাহ তাআ'লার প্রতি ঈমান এনেছেন । অবিশ্বাসীদের সীমাহীন নিপীড়নে প্রিয় জন্মভূমি মক্কা ত্যাগ করতে বাধ্য হন কারাবা রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহু। মায়ের স্নেহ, মায়া ও ভালবাসা থেকে বঞ্চিত একমাত্র অবুঝ সন্তান বাশিরকে বুকে ধরে পথ চলতে থাকেন। অবশেষে পৌঁছে যান মদিনায়। পেয়ে যান প্রিয় রাসূলের সান্নিধ্যে।

প্রিয় রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সান্নিধ্যলাভ ছিল সাহাবায়ে কেরামের কাছে সবচে' ভালোলাগার ভালবাসার বিষয়। পিতা-পুত্র দুজন বেশ ভালই দিন কাটাচ্ছিলেন রাসূলে কারিম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সান্নিধ্যে। কিন্তু কিছু দিনের মধ্যেই ডাক আসে জিহাদের ময়দানে যাওয়ার জন্য। দ্বীনের মশাল প্রজ্জ্বলনের জন্য এই জিহাদে! কালিমার পতাকাকে উড্ডীয়ন করার জিহাদ! তিনিও শামিল হতে চান সে জিহাদে। যাবার জন্য অনুমতি প্রার্থনা করেন আল্লাহর রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে। আল্লাহর রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কারাবা রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহুর ঐকান্তিক ইচ্ছা ও আগ্রহ দেখে অনুমতি দেন। অতঃপর সকল প্রস্তুতি শেষ করে, দলের সাথে তিনিও বেড়িয়ে গেলেন জিহাদের ময়দানে। পেছনে থেকে গেলেন একমাত্র মা হারা সন্তান! বুকের মানিক, প্রাণপ্রিয় শিশু বাশির। ছোট্ট বাশির বাবার সাথে জিহাদের সঙ্গী হতে পারলেন না। তিনি আল্লাহর রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে থেকে গেলেন। সারা দিন রাসূলের সাথে থাকেন। রাসূলের সাথে সাথেই কেটে যেতে থাকে শিশু বাশিরের দিনগুলো। বাশির আনন্দে হাসেন, খেলা করেন। রাসূলের সাথে যেন তার যুগ যুগান্তরের আত্মীয়তা।

মাসখানিক কেটে যায়। হঠাৎ একদিন নবীজীর কাছে খবর এলো- জিহাদের ময়দান থেকে ফিরে আসছে সেই দলটি। মদিনার কাছাকাছি চলে এসেছে। মাতৃহারা ছোট্ট বাশিরও শুনলেন। ছোট্ট শিশু বাশির জানেন, এই দলেই তার বাবাও আছেন এবং সেও ফিরে আসবেন। মা হারা শিশু বাশির বাবার বিচ্ছেদে কাতর। দীর্ঘদিন অপেক্ষার পরে যখনই শুনেছেন, বাবা আসতেছেন, দৌঁড়ে চলে গেলেন মদিনার দিকে। বাবাকে এগিয়ে নিয়ে আসবেন। স্বাগত জানাবেন বাবাকে। বাবার গলা জড়িয়ে ধরবে। বাবাও এত দিন পরে তাকে কাছে পেয়ে খুশি হয়ে যাবেন। একবুক আশা নিয়ে বাশির অপেক্ষা করছে পাহাড়ের পাদদেশ হয়ে চলে আসা রাস্তায়। দীর্ঘসময় পরে একটি দল এল। বাশিরের চোখের সামনে দিয়ে মদিনার দিকে প্রবেশ করছে দলটি। বাশিরের একজোড়া চোখ শুধু তার বাবাকে খুঁজছে। পাচ্ছে না। দলের ভেতরে তার বাবাকে চোখ পড়লো না। নিজের চোখকে অবিশ্বাস হচ্ছে বাশিরের। মনে হচ্ছে তার দেখার ভুল। তিনি দৌঁড়ে আবার দলটির সামনে এসে আবার একে একে দলের শেষ ব্যক্তিটি পর্যন্ত সবাইকে ভালো করে লক্ষ্য করলেন। কিন্তু তার পিতা নাই! তিনি পেলেন না তার বাবাকে।
বাবাকে না পাওয়ার ব্যাথায় বিধ্বস্ত শিশু বাশিরের মন! বাবাকে কোথাও খুঁজে পাচ্ছেন না! অব্যক্ত বেদনায় অধির অপেক্ষায় ব্যাকুল বাশিরের কচি মন। ঘুরেফিরে একই প্রশ্ন- বাবা কোথায় ? ছোট্ট শিশুর মাথায় যেন সমস্ত আকাশ ভেংঙে পড়েছে ! বিষন্ন-বোধির শিশু বাশির ধীর পায়ে মদিনার দিকে এগুচ্ছেন। হঠাৎ যেন সামনে এসে দাঁড়ালেন একজন! মুখোমুখি! হাটা বন্ধ হয়ে গেল বাশিরের! কোন এক প্রাচীর যেন থামিয়ে দিল তার পথচলা! উপরের দিকে তাকালেন বাশির! এতো আল্লাহর রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! বাশিরকে কোলে তুলে নিলেন! কান্নাবিজড়িত কন্ঠে বাশির জিজ্ঞেস করল, 'হে আল্লাহর রাসূল, আমার বাবা কোথায়?'

রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোনো উত্তর দিলেন না। সে তো জানেন, তার বাবা আর কোনো দিন ফিরে আসবেন না। শিশু বাশিরের এই কঠিন প্রশ্নের কি উত্তর দিবেন! তিনি যে জগতের সবচেয়ে কোমল হৃদয়ের অধিকারী! তিনি যে রহমাতুল্লিল আলামীন! তাঁর হৃদয় তো ফেটে চৌচির!

কান্নাজড়িত কন্ঠে ছোট্ট বাশির আবার শুধালেন, 'হে রহমাতুল্লিল আলামীন, আমার বাবা কোথায়? বাবাকে তো খুঁজে পেলাম না দলটিতে!'

আল্লাহর রাসুল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তখন বাশিরের দিকে তাকাতে পারছিলেন না। তিনি তাঁর চেহারা মোবারক অন্যদিকে ঘুরিয়ে নিলেন। অবুঝ ছোট্ট শিশু বাশিরের অশ্রুসিক্ত চোখ।বাশির আবার ঘুরে তাঁর চেহারার সামনে এসে আবার প্রশ্ন করলেন- আমার বাবা কোথায়?

আল্লাহর রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই অবুঝ শিশুকে কী উত্তর দিবেন! নিজেরও যে আজ অশ্রুভেজা চোখ! এই অবুঝ শিশুকে তিনি কী বলে শান্তনা দেবেন? কি কথা বলে প্রশান্তির পরশ বুলিয়ে দিবেন অসহায় এই ইয়াতিম শিশুকে!

আল্লাহর রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর চোখে পানি দেখে শিশু বাশির এক নিমিষেই সব বুঝে ফেললেন! চিৎকার দিয়ে বলে উঠলেন- 'আযহাবতু বিল বুকা-।' 'আহ! আজ আমি চির অসহায় হয়ে গেলাম! এত দিন মাতা ছিল না! আজ বাবাও হারিয়ে গেল।

আল্লাহর রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, 'বাশির, আমা আন তাকূ-না তারদান, আইয়াকূ-না আয়িশাতা উম্মাকা ওয়া রসূলাল্লাহি আবাক?' 'বাশির, আয়িশা যদি তোমার মা হয়ে যান আর আমি যদি তোমার বাবা হই- তুমি কি এতে খুশি হবে না?' আল্লাহর রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পবিত্র জবানে এই কথা শুনে ছোট্ট বাশিরের কান্না থেমে গেল।

আহ! এভাবেই শত সহস্র বাশিরদের বিরহ বেদনার রক্ত পিচ্ছিল, দীঘল দরিয়া পাড়ি দিয়ে দ্বীন ইসলাম এসে পেীঁছেছে আমাদের দ্বারে দ্বারে, ঘরে ঘরে। আমাদের হৃদয়ে যে নিভূ নিভূ তাওহিদের বহ্নিশিখা প্রজ্জ্বলিত, এর পেছনে রয়েছে এমনই অজস্র ত্যাগ এবং কুরবানির অসংখ্য নজরানা। আমরা যদি এই দ্বীনের প্রতি আর একটু আন্তরিক হতাম! দ্বীনের হুকুম আহকামগুলোর প্রতি সামান্য দরদ এবং দায়বদ্ধতা রাখতাম! আামাদের বাস্তব জীবনে মেনে চলার চেষ্টা করতাম! আজ সেটা নেই বলেই আমাদের উপরে এত খবরদারি! বিশ্বময় মুসলিমদের এত অধ:পতন, আমাদের মধ্যে দ্বীনের জজবা নেই! দ্বীনের প্রতি কোনো দরদ-দায় নেই! মায়া-মমতা-মহব্বত কিচ্ছু নেই! যদি থাকতো পৃথিবীটা আরও অনেক সুন্দর হতো! অন্যায়-অপরাধ-অবিচার এর মাত্রা জ্যামিতিক হারে বৃদ্ধি পেত না!
একেকজন সাহাবীর ত্যাগের ঘটনা স্মরন হলে নিজের প্রতি অলক্ষেই প্রশ্ন জেগে ওঠে মনের ভেতর থেকে, 'হায়! আমিও মুসলমান! আমার তো কোনো ত্যাগ নেই, আমি তো কিছু হারাইনি! আমি স্বজন হারাইনি! বাড়ি-ঘর-জন্মভূমি ছেড়ে আমাকে হিজরত করতে হয়নি অচেনা নতুন জনপদে!' এই দ্বীনের জন্য আমি একটা কাটার আঘাতও সয়ে দেখিনি! তাই আমার নিজের প্রতি ধিক্কার আসে, 'আমি তো শুধু পেতে চাই! আমি মুসলিম কিন্তু লোভাতুর আমার মন!

আল্লাহ পাক আমাদের ক্ষমা করুন। সাহাবায়ে কেরামের মহান জীবনের আলোকচ্ছটা থেকে কিছুটা হলেও বুঝার তাওফিক প্রদান করুন। আমীন।

(ইসলামিক ঘটনা অবলম্বনে রচিত।)

মোঃ আজিজুর রহমান
সিনিয়র প্রভাষক
ঢাকা প্রফেশনাল কলেজ।

Authors get paid when people like you upvote their post.
If you enjoyed what you read here, create your account today and start earning FREE STEEM!
Sort Order:  

যেখানে সেখানে যেভাবে সেভাবে পোস্ট করা মোটেও ঠিক নয়। পোস্ট করার আগে নিয়ম কানুন জেনে তারপর পোস্ট করা ভালো। আর আশা করছি বিষয়টি বুঝতে পেরেছেন ধন্যবাদ ।