"টেনশন নিও না বাবা। সব ঠিক হইয়া যাইবো। তোমার বাপও ঠিক তোমার মতই এই রকম টেনশন করেছিল সেই দিন।"
"রহিম চাচা, আপনি আবারো ওই লোকের কথা আমার সামনে তুলেছেন?"
"লোকটা যেমনি হোউক, সে তোমার বাপ হয়। এই কথাটা যেদিন ভুলে যাবে, সেই দিনই মনে করবা তোমার বিপদ শুরু।"
"সে তো কত আগেই ভুলে গিয়েছি।"
আমি রহিম চাচার থেকে মুখ ফিরিয়ে ফ্লোরের দিকে তাকিয়ে ফিস ফিস করে কথাটি বললাম।
"আর তোমার পতনও সেই দিন থেকেই শুরু হয়েছে বাবা।"
রহিম চাচার এই কথাটা শুনে আমার কান জ্বলে যাচ্ছিল। আমি তৎক্ষণাৎ দাঁড়িয়ে গেলাম রহিম চাচাকে কিছু বলার জন্য। কিন্তু আমার মুখ খোলার আগেই সে উল্টো পথে হাঁটা দিল। নেহাতই মুরুব্বী লোক, তা না হলে এই রাতুল কারো ধার ধারে না।
রহিম চাচা যাওয়ার পর হাসপাতালে বিছিয়ে রাখা চেয়ারগুলোর একটিতে আগের মতোই বসে পড়লাম। ভেতরে আমার সন্তানসম্ভবা স্ত্রীর সিজার চলছে। মাত্র ৮ মাসেই তার প্রসব বেদনা শুরু হওয়ায় জরুরী ভিত্তিতে তাকে সিজার করানো হচ্ছে। ডাক্তার বলেছে প্রচুর রক্তক্ষরণ হচ্ছে রক্তের ব্যবস্থা করে রাখতে। ডোনার পাইনি, তাই বাধ্য হয়েই টাকা দিয়ে রক্ত কিনতে হয়েছে আমার। রক্তের ব্যাগ দুটো শক্ত করে ধরে আছি হাতে। মোট ৪ ব্যাগ রক্ত এনেছিলাম। এই চার ঘণ্টায় দুই ব্যাগ খরচ হয়েছে, আরো দুই ব্যাংক আমার হাতে রয়েছে।
অপারেশন থিয়েটার থেকে ডাক্তার এবং নার্সদের দ্রুত পদচারণা আমার মনের ভয় আরো বাড়িয়ে দিচ্ছিল। আমি যখন ডাক্তার এবং নার্সদের পদচারণা দেখতে ব্যস্ত ছিলাম, ঠিক তখনই আমার কাঁধে হাত রেখে পাশে বসলেন রহিম চাচা।
"ভয় পাইতাছো বাবা? ভয় পাইও না। আমি কইলাম না, তুমি যেদিন হইবা সেইদিন তোমার বাপেও এই রকম চিন্তা করছে। আর আমিও ঠিক নেই এমনেই তোমার বাপেরে সান্তনা দিছি। তুমি আর কী ভাইঙ্গা পড়ছো, ভাইঙ্গা পরছিল তো তোমার বাপে। কি কান্দাটাই না কানছিল সাহেবে সেদিন। হাসপাতালে মানুষজন তার কান্দন দেইখা অবাক হইয়া গেছিল।"
"এত কেঁদেছে বাবা, কী কারনে?"
"তুমি জন্মের পর দশ মিনিট নিঃশ্বাস নেও নাই। কান্দো নাই, এইজন্য।"
"এজন্য আবার কান্না করা লাগে নাকি!"
"রাতুল, বাপ তো হও নাই এখনও। পোলাপানের প্রতি বাপের যে ভালোবাসা এইডা চোখে দেখা যায় না, কিন্তু অনুভব করা যায়। আগে বাপ হও, তখন বুঝবা সন্তানের লাইগা তাগো কী দরদ।"
"তবুও চাচা হাসপাতালে মধ্যে কান্নাকাটি করা কি ঠিক? এজন্যই তো ওনাকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসছি। খালি ব্যাকডেটেড কথাবার্তা। যেনো আমরা এখনো আদি যুগে পড়ে আছি। হাসপাতালের মতো একটা পাবলিক প্লেসে কি কান্না করা যায় নাকি! আমার কি খারাপ লাগছে না? আমি কি করে কান্না করবো লোক দেখানোর জন্য?"
"বাপের আর সন্তানের ভালোবাসার মধ্যে কোন পাবলিক প্লেস লাগেনা রাতুল। লাগে হুদা ভালোবাসা। তুমি টেনশন নিও না। আল্লাহ যা করে ভালোর লাইগাই করে।"
কথা শেষ করে রহিম চাচা চলে গেল। আমি রক্তের ব্যাগ দুটো শক্ত করে ধরে বসে আছি। ছয় মাস আগে বাবাকে রেখে এসেছি বৃদ্ধাশ্রমে। আমার ওয়াইফ নীলার সাথে তার একদমই মিলতো না। প্রতিদিন কোনো না কোনো কিছু নিয়ে তাদের দুজনেরই কথা কাটাকাটি হতো।
বাবাও না, আজব একটা লোক। সেদে সেদে ঝগড়া করতে আসে সে। নীলা না হয় একটু বাজার করতে বলে, সেজন্য কি ওকে কথা শোনানো যায়? তিনি তো এমনেও ঘরে বসে থাকে। বাজার সদাই করে দিলে কী এমন হয়ে যায়? প্রতিদিনই বাজার নিয়ে ঝগড়া আর ঝগড়া। উনি আবার চুপচাপ বসতে পারে না। কিছু না কিছু ওনার খাওয়াই লাগে। সকালে একবার চা খেলেই তো হয়ে যায়। সন্ধ্যায় কি আবার চা খাওয়া লাগে নাকি? চায়ের জন্য কত ঝগড়াঝাঁটি! এইতো বৃদ্ধাশ্রমে দিয়ে আসার দুই দিন আগেই তো, নিলা সন্তানসম্ভবা জেনেও নীলাকে একটু খাবার বেড়ে দিল না। নীলা ঘুমিয়ে আছে, তাকে ডাক দিয়ে একটু খেতে বলবে, এই সময়টুকু তার হয় না।
সেদিন ঘুমের মধ্যে নীলার হাত লেগে তার পাশে থাকা খাবারের ট্রেটা ফ্লোরে পড়ে যেতেই আচমকা ওর ঘুম ভেঙে যায়। এটা কি আদৌ ঠিক হয়েছে বাবার? না হয় রাগের মাথায় নীলা একটু গালাগাল করেছে। এত দামী সেট ভেঙে গেলো, আবার তার খাবারও হলো না। সেই জন্য কি তিনি আমাকে তার বাড়িঘরের হুমকি দিতে পারে?
হ্যাঁ আমিও না হয় ওনার সাথে একটু রাগারাগি করেছিলাম। তাই বলে তিনি আমাকে বাড়ির খোটা দিতে পারে না। আমিও সেয়ানা কম না, তার টিপসই ব্যবহার করে হাতিয়ে নিয়েছি তার সবকিছু! এখন ঝগড়া করুক বৃদ্ধাশ্রমে যেয়ে।
.
.
"রাতুল সাহেব, আমাদের আরো দুই ব্যাগ রক্ত লাগবে।"
আমি তড়িঘড়ি করে আমার হাতে থাকা রক্তের ব্যাগগুলো নার্সের হাতে দিয়ে দিলাম।
"সিস্টার, কী খবর নীলার?"
"সেটা ডাক্তার একটু পরে আসলেই তার কাছে জিজ্ঞেস করে নিবেন।"
রক্তের ব্যাগটা হাতে নিয়ে হনহনিয়ে অপারেশন থিয়েটারের দিকে হাটা দিল নার্স। আমি দেওয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে চেয়ারে বসে চোখ বন্ধ করে রইলাম।
নীলা, ফাতেমা ইয়াসমিন নিলা। আমার সাথে পরিচয় ইউনিভার্সিটিতে। দুজনে একসাথে পড়ালেখা শেষ করে জব নিয়ে নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে তারপর বিবাহ করেছি। নীলার পরিবার আমাকে বেশ ভালো পেত। মা মারা যাওয়ার পর বাবা আমাকে সেই ক্লাস সিক্স থেকে এই পর্যন্ত এনেছে। নীলাকেও সে শুরুতে ভালো পেতো। কিন্তু কেন জানি নীলার প্রতি সে বিয়ের পর উদাসিন হয়ে যায়। বিয়ের দুই দিন পরেই তাদের দুজনের মধ্যে মনোমালিন্য সৃষ্টি হয়। বাবাকে তো কিছু বলতে পারি না, তাই রাগ দেখাতাম নীলার সাথে। আর মেয়েটাই বা কী করবে?
সারাদিন জব করে এসে কি রান্নাবান্না করা যায়? যতটুকু করে ততটুকুই তো বাবার খাওয়া উচিত। কিন্তু না, বাবার সকালে একবার চা লাগবে, আবার সন্ধ্যায় চা লাগবে, সময়মতো খাবার লাগবে। এসব করার জন্য কি নীলা এই বাসায় এসেছে?
বাবাও না। তাকে তো নীলার ব্যাপারটাও দেখতে হবে। ও তো ঘরে বসে নেই। সারাদিন অফিস শেষে সেও তো ক্লান্ত হয়। তারও তো জীবন। বাসায় আসতে না আসতেই চায়ের তলব পাঠানো হয় তার কাছে।
.
.
"রাতুল, হ্যালো মিস্টার রাতুল?"
ডাক্তার সাহেবের ধাক্কাধাক্কিতে আমার ঘুম ভেঙে গেল। ঝটপট উঠে দাঁড়াতেই তিনি আমার কাঁধে হাত রেখে বললেন,
"বিচলিত হবে না রাতুল। শান্ত হও, ধৈর্য্য রাখো। আমার সাথে একটু প্রাইভেটলি কথা বলতে হবে তোমার। আমার আমার রুমে চলে আসো।"
ডাক্তার তরিকুলের চেহারাটা ভালো ঠেকলো না আমার কাছে। কেমন যেন হতাশা ফুটে উঠেছে তার চেহারায়। মনে সাহস নিয়ে তার সামনের চেয়ারটিতে বসলাম।
"তোমার সন্তান খুব ক্রিটিকাল কন্ডিশনে আছে। চার ঘন্টার বেশি সময় ব্যয়ের পরেও কিছুতেই নরমাল ডেলিভারি করা যাচ্ছে না।"
"আপনারা না বললেন সিজার করবেন?"
"আর ইউ ম্যাড রাতুল? কিছুদিন আগেই তোমার ওয়াইফের কিডনি ড্যামেজ হয়েছে। পাশাপাশি তার লিভারের প্রবলেম। এছাড়াও তার হার্টে প্রব্লেম আছে। সিজার করলে তো খুব রিস্ক হবে।"
"আর না করলে?"
"তাহলেও রিস্ক।" ধীরে বললেন ডাক্তার তরিকুল।
"প্লিজ আঙ্কেল, আমার সন্তান এবং নীলাকে বাঁচিয়ে তুলুন। দয়া করুন। ওরাই যে আমার এই জীবনের একমাত্র সঙ্গী।"
"প্লিজ রাতুল কন্ত্রল ইউরসেলফ। তোমাকে একটা এগ্রিমেন্টের সই করতে হবে।"
"কীসের এগ্রিমেন্ট?"
"যদি অবস্থা বেগতিক হয়ে যায় তাহলে আমরা সিজার করতে বাধ্য হব। আর সিজার করতে যেয়ে যদি কোনো সমস্যা হয় তবে এর জন্য হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। কাগজে সই করে দাও একটা।"
ডাক্তার তরিকুল আমার সামনে একটি এগ্রিমেন্ট পেপার এগিয়ে দিলেন। পেপারটির সারসংক্ষেপ ছিল যে, যদি সিজার করানো হয়, তবে যে কোন অশুভ ঘটনার জন্য ডাক্তার কিংবা হাসপাতাল দায়ী থাকবে না। আমি সজ্ঞানে এই এগ্রিমেন্টে সই করলাম। পেপার ডাক্তারের হাতে দিতেই তিনি আমার কাঁধে হাত রাখলেন। বাবার বন্ধু হওয়ায় তার সাথে সম্পর্কটা আমার অন্যরকম। তিনি আমাকে অনেকটা সন্তানের মতোই স্নেহ করেন।
"রাতুল এই হাত দিয়ে শতশত অপারেশন করেছি আমি। তাই রিল্যাক্স থাকো। আমি ঠিক এইরকম একটা সই তোমার বাবার থেকেও নিয়েছিলাম। তাই এইসব দেওয়া মানেই যে সবকিছু শেষ তা নয়। হয়তোবা নতুন কিছু শুরু হবে! আর হয়তোবা সেটা তোমার সন্তানের জীবন। রিল্যাক্স।"
ডাক্তার তরিকুল যাওয়ার পরই আমার ভেতরটা কেমন যেন অস্থির লাগছিল। মনে হচ্ছিল বুক ফেটে এখনই কান্না বের হবে। মনের অজান্তেই চোখ দিয়ে অঝোরে পানি পড়তে লাগল আমার। কী যেন একটা হারিয়ে ফেলতে চলেছি আমি। বুঝতে পারছি না। আমার এতটা অস্বস্তি আর কখনো লাগেনি। বুকের মধ্যে প্রচন্ড ব্যথা অনুভব হতে লাগলো আমার। অনেক কষ্টে বুকে হাত দিয়ে ডাক্তারের রুম থেকে অপারেশন থিয়েটারে সামনের চেয়ারগুলোতে এসে ধপাস করে বসলাম। আমি মাথার যন্ত্রণায় জোরে জোরে চিৎকার দিয়ে কাঁদতে ইচ্ছা করছিলো। আমার আমার পাশে কেউ নেই যার হাতটি আমার মাথায় পড়ে আমাকে শান্ত হতে বলবে। কোন কিছু ভেবে ওঠার আগেই আমি চোখে মুখে হাত দিয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লাম। আমার কাছে মনে হচ্ছে দুনিয়াটা মিথ্যা। কীসের মধ্যে টিকে আছি আমি? আমি একটু আগে কী সাইন করে এলাম!
আমার নীলা এবং আমার অনাগত সন্তানের ভবিষ্যৎ কোথায় ফেলে দিয়ে এলাম আমি। চোখের পানি যেন আমার নীল শার্টটাকে ভিজিয়ে ফেলেছে। আমার আশেপাশে মানুষজন জড়ো হয়ে গিয়েছে আমার কান্না দেখে। জানিনা এই কান্না কেন। কেউ তো মারা যায়নি, তবুও আমার হৃদয়টা চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যাচ্ছে কেন?
হঠাৎই রহিম চাচার কথা মনে পড়ল। আমি নীলার এবং আমার সন্তানের খবর এখনো জানিনা। না জেনেই এই অবস্থা, আর আমি যখন শ্বাস নিচ্ছিলাম না তখন না জানি বাবা কতটা কষ্ট পেয়েছে। আমারতো এখনি বুকটা ফেটে যাচ্ছে। না জানি বাবার সেদিন কেমন লেগেছিলো। আমার আমি তো এখনই কান্না করে লোকজন জড়ো করে ফেলেছি। না জানি বাবা সেদিন কী করেছিলো। মাথা নিচু করে নীরবে অশ্রুপাত করতে লাগলাম আমি। বাবাকে আজ বড্ড মনে পড়ছে। মুখ দিয়ে অজান্তেই বেড়িয়ে এলো, "বাবা আমায় ক্ষমা করে দাও।"
কান্না করতে করতে চোখ বুজতেই আমার মাথার মধ্যে এক উষ্ণ হাতের স্পর্শ পেলাম। হাতটা আমার চুলগুলো এলোমেলো করে দিচ্ছিল আর মস্তিষ্কে অদ্ভুত এক শান্তির বাতাস বইয়ে দিচ্ছিল। চোখ খুলে ডান দিকে তাকাতেই আমি আমার বাবাকে দেখতে পেলাম। ওপাশে রহিম চাচা দাঁড়িয়ে হাসছিলো।
"কিরে হতচ্ছাড়া, তোর নাকি সন্তান হবে? এই বুড়াটাকে কি একবারও ডাকা যায় না? দুইটা ঈদ তো সেই বৃদ্ধাশ্রমে কাটিয়ে দিয়েছি। একটিবারও কি ডাকতে পারিসনি আমায়?"
আমার আর কোন কিছু বলার ক্ষমতা রইল না। আমি দুর্বল, আমি ক্ষমতাহীন, আমি ভালবাসার কাঙ্গাল। বাবার সামনে কিছু বলার ক্ষমতা থাকেনা কোন সন্তানের। বেশি কিছু না ভেবেই জড়িয়ে ধরলাম বাবাকে। চোখের পানির ফোটাটা ছিটকে পড়ল হাসপাতালের সেই ফ্লোরে। হাউ মাউ করে কান্না করতে লাগলাম বাচ্চাদের মত। ঠিক যেমন আমি তার কোলে সেই ছোট্ট রাতুল। ছোটবেলাতেও যেভাবে কান্না করেছি দশ মিনিট পর, আজ বাস্তব জীবনেও কান্না করলাম ছয় মাস পর।
(সমাপ্ত)
গল্পঃ ছয় মাস পর
লেখকঃ মেহেদী হাসান রাব্বি
You have been upvoted by @toufiq777 A Country Representative, we are voting with the Steemit Community Curator @steemcurator07 account to support the newcomers coming into steemit.
Follow @steemitblog for the latest update. You can also check out this link which provides the name of the existing community according to specialized subject
There are also various contest is going on in steemit, You just have to enter in this link and then you will find all the contest link, I hope you will also get some interest,
For general information about what is happening on Steem follow @steemitblog.
Downvoting a post can decrease pending rewards and make it less visible. Common reasons:
Submit