Steem Bangladesh কমিউনিটি "আমার প্রিয় শিক্ষক" কে নিয়ে পোস্ট আহ্বান করেছেন। আমি যাঁকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করতে বসেছি তিনি আমাদের বাংলা পড়িয়েছেন, জীবনকে চিনিয়েছেন, ভালো মানুষ হওয়ার শিক্ষা দিয়েছেন।
আমার প্রিয় শিক্ষকের নাম শ্রী দুর্গাপদ দত্ত। "দুর্গা স্যার" বিধাননগর রাষ্ট্রীয় উচ্চ বিদ্যালয়ের বাংলা শিক্ষক।
স্যারের প্রথম ক্লাসে উনি আমাদের কর্ণ-কুন্তী সংবাদ পড়িয়েছিলেন। ৪৫ মিনিটের নির্ধারিত ক্লাস কখন শেষ হয়ে গেছে আমরা বুঝতে পারিনি। ছুটির ঘন্টা কানে ঢোকেনি - আমরা মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনে যাচ্ছি দুর্গা স্যারকে। আমরা বুঝতে পারছি কেউ নায়ক কেউ খলনায়ক নয়, সবাই তার নিজের মতো করে সঠিক। বুঝতে শিখছি কাউকে সমালোচনা বা নিন্দা করার আগে সেই মানুষটা ওই নিন্দিত কাজ করতে বাধ্য হয়েছে কিনা - ভেবে দেখা উচিৎ। কর্ণ, কুন্তী, অর্জুন, সূর্যদেব, কৃষ্ণ, দুর্যোধন - যে যা করেছেন নিজের বাধ্যবাধকতা থেকে করেছেন।
দুর্গা স্যার ছিলেন বহু-ভাষাবিদ্। সংস্কৃত, আরবী এবং ল্যাটিন ভাষার বিভিন্ন উদাহরণ দিয়ে আমাদের শিখিয়েছেন মানুষ কখনো মানুষের শত্রু নয়। এতো বিভিন্নতা সত্ত্বেও কোথাও না কোথাও সবাই এক - সবাই মানুষ। বুঝিয়েছেন সব মানুষের সাথে রয়েছে সব মানুষের আত্মীয়তা।
স্কুলের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ছাত্রছাত্রীদের সকলকে নিয়ে কাজ করার এক অদ্ভুত ক্ষমতা ছিল দুর্গা স্যারের। আমাদের উৎসাহ দিতেন। আমরা সেই সব দায়িত্ব পালন করলে সকলের সামনে প্রশংসা করতেন। ভুল হলে বিরক্ত না হয়ে আবার করে বুঝিয়ে দিতেন। পরে কর্মক্ষেত্রে এসে বুঝেছি - টিম-ওয়ার্ক, লিডারশিপ, রেসপেক্ট ফর অল, মোটিভেশন, রেকগনিশন - ওই ছোটো ছোটো ছেলেমেয়েদের এসব কিছু কতো সহজে শিখিয়ে দিয়েছেন দুর্গা স্যার।
একবার পদার্থবিদ্যা পরীক্ষার প্রস্তুতি ভালো না হওয়ায় কয়েকজন ছাত্র টয়লেটে বই লুকিয়ে রেখে আসে। প্ল্যান ছিল পরীক্ষা চলাকালীন টয়লেট গিয়ে দেখে আসার। কোনও ভাবে বইটি দুর্গা স্যারের চোখে পড়ে। উনি বইটি এনে পরীক্ষা ঘরের টেবিলে রাখেন। আস্তে আস্তে বলেন, "আমি বেরিয়ে যাচ্ছি, পরীক্ষার সময় শেষ হওয়ার ১৫ মিনিট আগে ফিরবো। কেউ যদি দরকার মনে করো এখানে এসে বই খুলে টুকে নিও। মনে রেখো, কেউ অন্য কাউকে ঠকায় না। ঠকায় নিজেকে।"
না, কেউ ওঠেনি বই দেখতে।
আমাদের এক্সকারশনে দুর্গা স্যার সঙ্গে গেছিলেন। বকখালি যাওয়া হয়েছিল। নিজের সন্তানের মতো সকলের খেয়াল রেখেছিলেন। স্যার সারা রাত ইয়ূথ হোস্টেলের বারান্দায় আমাদের সাথে নিয়ে জেগেছিলেন। গল্পে গল্পে জীবনকে চিনিয়ে দিয়েছিলেন সেই রাতে। এখনও চোখ বন্ধ করলেই মনে হয়, আমরা সবাই ওই বারান্দায় বসে। আর স্যার ভরাট গলায় শঙ্খ ঘোষের কবিতা আবৃত্তি করে শোনাচ্ছেন-
"হাতের ওপর হাত রাখা খুব সহজ নয়,
সারা জীবন বইতে পারা সহজ নয়,
কথাটা খুব সহজ,
কিন্তু কে না জানে,
সহজ কথা ঠিক ততটা সহজ নয়"
ওই যে, শুরুতেই বললাম না, দুর্গা স্যারের ক্লাস সেই যে শুরু হয়েছিল - এখনও চলছে ..
স্যারের ছবি স্যারের ফেসবুক প্রোফাইল থেকে প্রাপ্ত