নৈতিকতা শব্দটি মূলত ইংরেজি: "Morality" এর প্রতিশব্দ যার উদ্ভব হয়েছে ল্যাটিন শব্দ "মোরালিটাস" থেকে । আর মোরালিটাস শব্দের আভিধানিক অর্থ হলো চরিত্র, ভদ্রতা, সঠিক আচরণ । মানুষের মাঝে বন্ধূত্ব এবং আস্থা অর্জনের মানবিক গুনাবলি কে বলা হয় নৈতিকতা । আর এই নৈতিকার কারনেই মানুষকে বলা হয় আশরাফুল মাখলুকাত বা শ্রেষ্ঠ জীব ।
নৈতিকতাকে একটি আদর্শিক মানদন্ড বলা যায় যা অঞ্চল ভিত্তিক সামাজিকতা, ঐতিহ্য, সংষ্কৃতি, ধর্ম প্রভৃতির মানদন্ডের উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে, আবার সামগ্রিকভাবে সমগ্র পৃথিবীর জন্য কল্যাণকর বিষয়সমূহকেও নৈতিকতার সংজ্ঞা হিসাবে ধরা যায় ।
আবার নৈতিকতা বলতে কোনও ব্যক্তি বা একদল লোকের মনের অবস্থাকে বুঝায় যা সাধারণত কোনও লক্ষ্য অর্জনের জন্য দক্ষতার প্রতি উত্সাহ বা আত্মবিশ্বাসের ইতিবাচক অর্থের সাথে ব্যবহৃত হয়, যদিও এটির নেতিবাচক অর্থও হতে পারে, উদাহরণস্বরূপ, নিম্ন মনোবল।
নৈতিকতার বিশেষ্য হলো নীতি আর নীতি হলো মানুষেল ন্যায়- অন্যায় ও ভালো-মন্দের ধারণা। নীতি আপেক্ষিক, বরং বলা যায় ব্যক্তিক। নীতি থেকে উদ্ভূত বলে নৈতিকতা -- জগৎ ও জীবন সম্পর্কে ভালো-মন্দ, সত্য-মিথ্যা, ন্যায়-অন্যায়ের বোধও আপেক্ষিক।
বিশেষণ হিসাবে , নৈতিকতার অর্থ হল যে কোনও কিছু সামাজিক পর্যায়ে ভাল বলে বিবেচিত হয় তার সাথে সম্পর্কিত বা তার সাথে সম্পর্কিত।
যুগ যুগ ধরেই অনেক বিজ্ঞাণী অনেক জ্ঞানী ব্যাক্তিরা নৈতিকতার সংজ্ঞা খুঁজেছেন। বিশেষ করে মিশেল মেয়ার, ম্যানুয়ল ভেলেশকূ্য, ক্লেরে এণ্ড্রে ও টমাস শ্যঙ্কস নৈতিকতা নিয়ে এমন একটি গবেষণা কে সংশোধন করেছেন। তাঁরা দেখালেন গুরুত্ববহ মাত্র দুটি বিষয়কে যার পরিধি সুদূর প্রসারী। আর এ দুটি বিষয় নৈতিকতার সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত কিন্তু প্রক্রিয়াটি দীর্ঘ হলেও তা সাধারণ নয়।
নৈতিকতার বিবর্তন:
নৈতিকতার বিবর্তন বলতে মূলত মানুষের ক্রম পর্যায়ে আচার আচরণের সার্বিক পরিবর্তন কেই বুঝায়। কারন এক সময় মানুষ পশুর মত ছিলো, তার কোন সামাজিক দ্বায়বদ্ধতা ছিলো না, ক্রমান্বয়ে মানুষ বুঝতে শিখলো, অন্যের প্রতি তার কর্তব্যবোধ সম্পর্কে সচেতন হলো যার মাধ্যমে বুঝলো কোনটা সঠিক আর কোনটা অন্যায় আচরণ। অন্যান্য জীবে সামাজিক এই নৈতিকতা সবসময় গুরুত্ববহন না করলেও, প্রাত্যহিক জীবনে মানুষের আচার-আচরণের সাথে এর গভীর সংযোগ আছে। বিবর্তনীয় জীববিজ্ঞান এবং সমাজতাত্ত্বিক জীববিজ্ঞান যদিও এর সাথে একমত নয়। তাদের মতে যদিও মানুষের সামাজিক আচরণ জটিল, তথাপি এধরনের অনেক আচরণ এখন অনেক সামাজিক প্রাণীর মধ্যে দেখা যায়।
শারীরতত্ববিদ ম্যাট জে. রোজানো এর মতে, নৈতিকতার পরে এবং নৈতিকতার উপর ভিত্তি করেই ধর্মের উৎপত্তি হয়েছে। ধর্মে ঐশ্বরিক ব্যক্তিত্ব, আত্মা এবং স্রষ্টাকে প্রবেশ করানোর পরে মানুষ বুঝতে পারে, এই ধর্মের ভয় দেখিয়ে ব্যক্তিতে-ব্যক্তিতে স্বার্থপরতা, দলবদ্ধভাবে বাস করতে কি কি ধরনের সহযোগিতা থাকবে কিভাবে নিজকে টিকিয়ে রাখতে পারবে। ধর্মের উৎপত্তি এবং সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে তার পরিবর্তন সমাজবদ্ধ মানুষের টিকে থাকার সূযোগ হয়েছে।
আবার শুধু ধর্মের সাথে নৈতিকতাকে মিলিয়ে ফেলা যায়না। যদিও সব ধর্ম ঊচ্চমাণ এর নৈতিকতার মান নির্ধারণ করে থাকে। ধর্মের সাথে নৈতিকতাকে এজন্য সীমাবদ্ধ করে ফেলা যায়না যে নাস্তিক বা আস্তিক দুজন মানুষের আচরণ এ নৈতিকতার প্রয়োগ থাকে। তবে সত্য এবং সন্দেহাতীত যে , ধর্ম ঊচ্চমাণ এর নৈতিকতার মান নির্ধারণ করে। তবে দুটি বিষয়কে এক করা চলেনা।
সকল ধর্মের মূল্যবোধ এক ও অভিন্ন নয়। সেহেতু মূল্যবোধের ভিন্নতার কারণে ভিন্ন ভিন্ন ধর্মীয় অনুসারীদের নৈতিকতা ভিন্ন প্রকৃতির। তবে মানুষের জীবনে ধর্মীয় মুলবোধ তার নৈতিকতাকে সমাজ ও রাষ্ট্রিয় জীবনে প্রতিষ্ঠিত করে। পাশ্চাত্য সভ্যতায় তারা মনে করেন ধর্ম মানুষের একান্ত ব্যক্তিগত ব্যাপার। সমাজ, সভ্যতা ও সংস্কৃতিতে এর প্রভাব প্রতিফলন করা বিকশিত সমাজ পরিপন্থী। উনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে আমেরিকায় যে নৈতিক আন্দোলন (Moral Movement) শুরু হয়েছিল তাতে স্পষ্ট করে বলা হয়েছিল— “মানব জীবনের যাবতীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে তা ব্যক্তিগত, সামগ্রিক, জাতীয় অথবা আন্তর্জাতিক পর্যায়ের হোক না কেন ধর্মীয় বিশ্বাস অথবা অতিপ্রাকৃত ((Super Natural) ধারণাকে সম্পূর্ণরূপে বাদ দিয়ে নৈতিকতার অপরিসীম গুরুত্বের ওপর জোর দিতে হবে।” পরবর্তীতে ব্রিটেনে Union of Ethical Societies প্রতিষ্ঠিত হয়। এতে নৈতিকতা সম্পর্কে আরেকটু বিস্তারিত বিবরণ দেয়া হয়। তাতে বলা হয়, মানবসেবা এবং মানবিক সাহায্য-সহযোগিতার জন্য এমন একটি পদ্ধতি ও নীতি প্রতিষ্ঠিত হবে- প্রথমত, ধর্মের প্রধান উদ্দেশ্য হল সম্প্রীতি। দ্বিতীয়ত, নৈতিক ধারণা ও নৈতিক জীবনের জন্য পার্থিব তাৎপর্য এবং পরকালীন জীবন সম্পর্কে কোনো আকীদা বিশ্বাসের প্রয়োজন নেই। তৃতীয়ত, কেবলমাত্র মানবিক ও প্রাকৃতিক উপায়-উপাদানের মাধ্যমে মানুষকে জীবনের যাবতীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে সত্যপ্রীতি, সত্যকে জানা এবং সত্যের জন্য কাজ করে যাওয়ার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকা।
নৈতিকতার অবক্ষয়:
নৈতিকতার অবক্ষয়ের মূলে রয়েছে ধর্মহীনতা, অসহিষ্ণুতা ও পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের অভাব আর রয়েছে অশ্লীলতার অবাদ ছড়াছড়ি। পারিবারিক ভাবে যে শিক্ষা দরকার তা আমরা পাচ্ছি না। কারন আমরা যখন পড়তে যাই তখন আমাদের উপর নির্দ্দেশনা থাকে ফাস্ট বয় হতে হবে কিন্তু বলা হয় ভালো হয় ভালো ছাত্র হওয়ার । জীবনে বড় চাকরি করতে হবে ডাক্তার , ইঞ্জিনিয়ার হতে হবে ভালো মানুষ হওয়ার জন্য বলা হয় না। তাই একজন ছাত্র তার প্রথম টার্গেট থাকে যেভাবেই হউক প্রথম হতে হবে, ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে হবে, ভালো চাকরী পেতে হবে। এই যে তার এ প্রত্যাশা তার টার্গেট এটা যে করেই হউক অর্জি ত হলেই হবে।
আমরা যদি এভাবে আমাদের ছেলেমেয়েদের শিক্ষা দেই যে যা শেখানো হয় তা তোমােকে শিখতেই হবে, অন্যদের সহযোগী হতে শত্রু নয়. তাহলে অবশ্যই তারা শিখবে আর শিখলে ভালো ফলাফল অবিশম্ভাবী তখন কি দরকার পড়বে একটা অসম প্রতিযোগীতার। যা সৃষ্টি করে মানুষের মাঝে বিভেদ, তৈরি করে অসাদু হওয়ার মনোবৃত্তি ।
যেমন আমাদের দেশে মুসলমান রা নামাজ পড়েন ধর্মীয় নির্দ্দেশনার কারনে, আর জান্নাত পাওয়ার প্রত্যাশায় কারন পবিত্র ধর্মগ্রন্থ কোরআনে আল্লাহু বলেছেন নামাজ বেহেশ্ত এর চাবিকাঠি যারফলে সবাই যে যা করুক নামাজ পড়ার চেষ্টা করেন ।
আচ্ছা বলুন তো বেহেশ্ত পেলেই তো বেহেশ্ত এর চাবি দরকার তাই না আর বেহেশ্ত পেতে হলে আপনাকে তাকাওয়া অর্জ ন করতে হবে আর তাকাওয়া হলো নিজকে অন্যের ক্ষতি করা থেকে বিরত রাখতে হবে। তাহলে আমাদের নৈতিকতা এভাবে সৃষ্টি হতো যে বেহেশ্ত এর চাবি নয় আগে বেহেশ্ত অর্জন করা দরকার। আর তার জন্য দরকার একটা সুন্দর নৈতিকতার যেখানে থাকবেনা অন্যের সম্পদ লুন্ঠন, অন্যকে জিম্মি করে ক্ষমতা গ্রহন । সামাজিক এই অবক্ষয় গুলো সৃষ্টি হচ্ছে আমাদের নৈতিক মূল্যবোধের অভাবে।
সুতরাং আমাদের সন্তানদের ক্লাসে প্রথম হওয়ার, ভালো চাকরির লোভ নয় তাদের নৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত করে আদর্শবান নাগরিক হিসাবে গড়ে তুলতে হবে। তাহলেই দুর হবে নৈতিক অবক্ষয়ের । সমাজ হয়ে উঠবে সাবলিল আর সুন্দর।