মধুমঞ্জরী লতা
অন্যান্য নাম : মধুমঞ্জরী লতা, মধুমালতী, মাধুরীলতা, হরগৌরী, লাল চামেলী
ইংরেজি নাম : Chinese honeysuckle, Rangoon creeper
বৈজ্ঞানিক নাম : Quisqualis indica
এই ফুলের নাম নিয়ে অনেক বিভ্রান্তি। এই ফুল একেক জনের কাছে একেক নামে পরিচিত। সবচেয়ে প্রচলিত ভুলটি হচ্ছে আমরা একে মাধবীলতা নামে ডাকি। আসলে মানুষের মুখে মুখে মাধুরী লতা হয়ে গেছে মাধবী লতা। আসলে এর কোনো বাংলা নাম ছিলো না। শেষ পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথ এর নামকরণ করেন মধুমঞ্জরী লতা। তাঁর নিজের কথায় –
“এ লতার কোনো-একটা বিদেশী নাম নিশ্চয় আছে-- জানি নে, জানার দরকারও নেই। আমাদের দেশের মন্দিরে এই লতার ফুলের ব্যবহার চলে না, কিন্তু মন্দিরের বাহিরে যে দেবতা মুক্তস্বরূপে আছেন তাঁর প্রচুর প্রসন্নতা এর মধ্যে বিকশিত। কাব্যসরস্বতী কোনো মন্দিরের বন্দিনী দেবতা নন, তাঁর ব্যবহারে এই ফুলকে লাগাব ঠিক করেছি, তাই নতুন করে নাম দিতে হল। রূপে রসে এর মধ্যে বিদেশী কিছুই নেই, এদেশের হাওয়ায় মাটিতে এর একটুও বিতৃষ্ণা দেখা যায় না, তাই দিশী নামে একে আপন করে নিলেম।
প্রত্যাশী হয়ে ছিনু এতকাল ধরি,
বসন্তে আজ দুয়ারে, আ মরি মরি,
ফুলমাধুরীর অঞ্জলি দিল ভরি
মধুমঞ্জরিলতা।
কতদিন আমি দেখিতে এসেছি প্রাতে
কচি ডালগুলি ভরি নিয়ে কচি পাতে
আপন ভাষায় যেন আলোকের সাথে
কহিতে চেয়েছে কথা।
কতদিন আমি দেখেছি গোধূলিকালে
সোনালি ছায়ার পরশ লেগেছে ডালে,
সন্ধ্যাবায়ুর মৃদু-কাঁপনের তালে
কী যেন ছন্দ শোনে।
গহন নিশীথে ঝিল্লি যখন ডাকে,
দেখেছি চাহিয়া জড়িত ডালের ফাঁকে
কালপুরুষের ইঙ্গিত যেন কাকে
দূর দিগন্তকোণে।
শ্রাবণে সঘন ধারা ঝরে ঝরঝর
পাতায় পাতায় কেঁপে ওঠে থরথর,
মনে হয় ওর হিয়া যেন ভরভর
বিশ্বের বেদনাতে।
কতবার ওর মর্মে গিয়েছি চলি,
বুঝিতে পেরেছি কেন উঠে চঞ্চলি,
শরৎশিশিরে যখন সে ঝলমলি
শিহরায় পাতে পাতে।
ভুবনে ভুবনে যে প্রাণ সীমানাহারা
গগনে গগনে সিঞ্চিল গ্রহতারা
পল্লবপুটে ধরি লয় তারি ধারা,
মজ্জায় লহে ভরি।
কী নিবিড় যোগ এই বাতাসের সনে,
যেন সে পরশ পায় জননীর স্তনে,
সে পুলকখানি কত-যে, সে মোর মনে
বুঝিব কেমন করি।
বাতাসে আকাশে আলোকের মাঝখানে--
ঋতুর হাতের মায়ামন্ত্রের টানে
কী-যে বাণী আছে প্রাণে প্রাণে ওই জানে,
মন তা জানিবে কিসে।
যে ইন্দ্রজাল দ্যুলোকে ভূলোকে ছাওয়া,
বুকের ভিতর লাগে ওর তারি হাওয়া--
বুঝিতে যে চাই কেমন সে ওর পাওয়া,
চেয়ে থাকি অনিমেষে।
ফুলের গুচ্ছে আজি ও উচ্ছ্বসিত,
নিখিলবাণীর রসের পরশামৃত
গোপনে গোপনে পেয়েছে অপরিমিত
ধরিতে না পারে তারে।
ছন্দে গন্ধে রূপ-আনন্দে ভরা,
ধরণীর ধন গগণের মন-হরা,
শ্যামলের বীণা বাজিল মধুস্বরা
ঝংকারে ঝংকারে।
আমার দুয়ারে এসেছিল নাম ভুলি
পাতা-ঝলমল অঙ্কুরখানি তুলি
মোর আঁখিপানে চেয়েছিল দুলি দুলি
করুণ প্রশ্নরতা।
তার পরে কবে দাঁড়াল যেদিন ভোরে
ফুলে ফুলে তার পরিচয়লিপি ধরে
নাম দিয়ে আমি নিলাম আপন ক'রে--
মধুমঞ্জরিলতা।
তার পরে যবে চলে যাব অবশেষে
সকল ঋতুর অতীত নীরব দেশে,
তখনো জাগাবে বসন্ত ফিরে এসে
ফুল-ফোটাবার ব্যথা।
বরষে বরষে সেদিনও তো বারে বারে
এমনি করিয়া শূন্য ঘরের দ্বারে
এই লতা মোর আনিবে কুসুমভারে
ফাগুনের আকুলতা।
তব পানে মোর ছিল যে প্রাণের প্রীতি
ওর কিশলয়ে রূপ নেবে সেই স্মৃতি,
মধুর গন্ধে আভাসিবে নিতি নিতি
সে মোর গোপন কথা।
অনেক কাহিনী যাবে যে সেদিন ভূলে,
স্মরণচিহ্ন কত যাবে উন্মূলে;
মোর দেওয়া নাম লেখা থাক্ ওর ফুলে
মধুমঞ্জরিলতা”।
মধুমঞ্জরীর আদি নিবাস মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া। যদিও মধুমঞ্জরী প্রায় সারাদেশেই সহজলভ্য। বাড়ির ফটক বা ঘরের উপর বেশ ঘনভাবে ছড়িয়ে যায়। প্রায় ৭০ ফুট পর্যন্ত বেয়ে উঠতে পারে। উদ্ভিদটি কাষ্ঠল, পত্রমোচী, আরোহী উদ্ভিদ। লতা খুব শক্ত, কয়েক বছর হয়ে গেলে মোটা হয়। তখন হয় মোচড়ানো, ধূসর রঙের। গর্ভকাষ্ঠ বা মাঝখানে ছিদ্র হয়।
পাতা একক, অখণ্ড, আয়তাকার-ভল্লাকার ও আগা সরু; কিনারা হালকা ঢেউ খেলানো এবং একটু খসখসে।, ৬-৯ সেমি লম্বা, বিন্যাস বিপ্রতীপ। শীতে পাতা কমে যায়।
ঘন সবুজ পাতার মাঝখানে ঝুলন্ত মধুমঞ্জরীর সাদা-গোলাপী-লাল ফুল সহজেই দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ডালের আগায় সন্ধ্যায় বড় বড় ঝুলন্ত থোকায় ফুল ফোটে আর হালকা সুবাস ছড়ায়। তাজা ও বাসি ফুলে রঙের ভিন্নতাও এর অন্যতম বৈশিষ্ট্য। তাজা ফুলের রঙ সাদা ক্রমশ তা গোলাপী থেকে লাল হয়ে শেষ পর্যন্ত মেরুন রঙে পরিণত হয়। বসন্ত, গ্রীষ্ম ও বর্ষায় প্রচুর ফুল ফোটে। যদিও সারা বছর কিছু দিন পরপর ফুল ফোটে। এজন্যে একে বারমাসী ফুল বলা হয়। দলনল প্রায় ৫ সেমি লম্বা, পাপড়ির সংখ্যা ৫, ফুলের বোঁটা লম্বা।
খুব ক্বচিৎ ফল হয়। ফল দেখতে অনেকটা কামরাঙ্গার মত, ৫ শিরা যুক্ত, লম্বায় ৫ সেমি। সাধারনত কাটিং করে বা গোড়া এবং শেকড় থেকে যে লতা গজায় তা কেটে মাটিতে পুঁতলেও চারা হয়।
মধুমঞ্জরী শুধু আমাদের সৌন্দর্যই দেয় না অনেক রোগের থেকে মুক্তিও দেয়। মধুমঞ্জরীর বহুবিধ ভেষজ গুণও রয়েছে। এর পাতা চর্মরোগে ও মাথার যন্ত্রনার ওষুধ হিসেবে ব্যবহৃত হয় এবং পুরনো বাত ও হাঁপানীর উপশমে লাগে। বীজ কৃমি, ডায়ারিয়া ও জ্বর নিরাময়ে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। কান্ড সর্দি, কাশি এবং ঠান্ডা লাগায় ব্যবহার করা হয়।
বৈজ্ঞানিক শ্রেণীবিন্যাস
Kingdom - Plantae
Subkingdom - Tracheobionta
Superdivision - Spermatophyta
Division - Magnoliophyta
Class - Magnoliopsida
Subclass - Rosidae
Order - Myrtales
Family - Combretaceae
Genus - Quisqualis
Species - Quisqualis indica