শ্যামসুন্দর সিকদার
বর্তমান সময়ে আমাদের সার্বিক জীবনব্যবস্থায় তথ্যপ্রযুক্তি যেন এক বিপ্লব এনে দিয়েছে। তথ্যপ্রযুক্তির ছোঁয়ায় আমরা বিশ্বকে হাতের মুঠোয় পেয়ে গেছি। তথ্যপ্রযুক্তি বিশ্বের সব মানুষকে সংযুক্ত করে রেখেছে। তারা প্রতিনিয়ত একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলছে। তথ্যপ্রযুক্তি আমাদের সার্বিক জীবনব্যবস্থায় নানামুখী প্রভাব ফেলছে। প্রভাব ফেলেছে সাহিত্যে এবং সংস্কৃতিতেও। সাহিত্য সৃষ্টির ক্ষেত্রে এবং তা ব্যবহার ও সংরক্ষণের ক্ষেত্রেও তথ্য প্রযুক্তি দিয়েছে অনেক সহজ-সুলভ পদ্ধতি। আমাদের সংস্কৃতিচর্চার ক্ষেত্রটাও হয়েছে বৈশ্বিক।
তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির বিপ্লব শুরু হয়েছে মূলত ইন্টারনেট ব্যবহার, সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার, ডিজিটাল ডিভাইস ব্যবহার এবং স্যাটেলাইট টেলিভিশনকে কেন্দ্র করে। বিশেষ করে স্মার্ট মোবাইল ফোন সেটের আবিষ্কার যেন মানুষের হাতের মুঠোর মধ্যে এনে দিয়েছে গোটা পৃথিবীকে। গুগল সার্চ ইঞ্জিন যেকোনো অজানা তথ্যকে মুহূর্তের মধ্যে সুলভ করে দেয়। বর্তমানে আমাদের সার্বিক জীবনযাত্রা মোবাইলকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হচ্ছে। যোগাযোগ ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন এনে দিয়েছে মোবাইল ফোন। সুতরাং একটি স্মার্ট মোবাইল হাতে থাকলে এবং ইন্টারনেটে সংযুক্ত থাকলে বলা যায় সারা পৃথিবীর সঙ্গে যুক্ত থাকা যাচ্ছে। সেই সুবাদে সকল বিজ্ঞান, সাহিত্য ও সংস্কৃতি কিংবা সামাজিক ও বৈশ্বিক চলমান জীবনধারার সঙ্গে যুক্ত থাকা সম্ভব হয়। বর্তমান সময়ে ইন্টারনেট পথনির্দেশকের ভূমিকা পালন করছে। কী নেই এখানে! শিক্ষা, বিনোদন, সাহিত্য-সংস্কৃতি, খেলাধুলাসহ এটি সব বিষয়ের এক বিরাট তথ্য ভাণ্ডার। আমাদের এখন কোনো তথ্যের জন্য আর ব্যক্তির ওপর নির্ভর করতে হয় না, ইন্টারনেটে সার্চ দিলেই সব তথ্য পাওয়া যায়। এমনকি গ্লোবাল পজিশনিং সিস্টেম ব্যবহার করে আমরা পথ চিনে যেকোনো স্থানে পৌঁছে যেতে পারি।
স্যাটেলাইট টেলিভিশনের বদৌলতে আমরা গ্রামের মাঝেও শহুরে জীবনের ছোঁয়া পেয়ে যাই। গ্রামের মানুষ তাদের অশিক্ষা, কুসংস্কার, ধর্মান্ধতা থেকে বেরিয়ে আসতে পেরেছে অনেকখানিই। গ্রামের মানুষের দৃষ্টিভঙ্গিরও অনেক উন্নতি হয়েছে। মানুষের মাঝে সাংস্কৃতিক সর্বজনীনতা গড়ে উঠেছে। বিশ্বভ্রাতৃত্ব সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখছে এই স্যাটেলাইট চ্যানেল অর্থাত্ তথ্যপ্রযুক্তি। স্যাটেলাইট চ্যানেলগুলোতে প্রচারিত নাটক, সিনেমা দেখে আমরা গতিশীল জীবনযাত্রার চর্চায় অভ্যস্ত হই। ফলে মানুষ উন্নয়নমুখী হয়ে উঠছে। এই প্রযুক্তি আমাদের খাদ্যাভ্যাসেও পরিবর্তন এনেছে। আগে আমরা যেমন শুধু মাছে-ভাতে বাঙালি ছিলাম, এখন সেখানে চা, নাস্তাসহ অন্যান্য বিষয়ও খাদ্য তালিকায় যুক্ত হয়েছে। চ্যানেলগুলোতে প্রচারিত নাটক, সিনেমা, সিরিয়ালে দেখা জীবনযাত্রা ও খাদ্যাভ্যাস আমাদের সংস্কৃতিতে প্রভাব ফেলেছে। ফলে সাংস্কৃতিক বিনিময় আগের চেয়ে আরও উন্নত হয়েছে। এছাড়া চ্যানেলগুলোতে নানা সচেতনতামূলক বিজ্ঞাপন/শিক্ষামূলক অনুষ্ঠান আমাদের জীবনমানকে উন্নত করেছে। আগেকার দিনের পদ্ধতির সঙ্গে এখনকার তথ্যপ্রযুক্তির যুগের তুলনা করলে মনে পড়ে ছোটবেলায় পড়া সেই বিখ্যাত উক্তি—‘বিজ্ঞান দিয়েছে বেগ, আর কেড়ে নিয়েছে আবেগ’। ভাবুন তো—রবীন্দ্রনাথ কিংবা শরত্চন্দ্রের যুগে তাঁরা লিখতেন দোয়াতের কালিতে ঝরনা-কলম চুবিয়ে চুবিয়ে কাগজের ওপর, আর এখন অনেকেই কাগজ-কালি-কলম ছাড়াই লিখেন কম্পিউটার-ল্যাপটপ-মোবাইলে কিংবা আই প্যাডে। আরো সুবিধা হলো আগেকার দিনে লিখতে গিয়ে ভুল হলে তার চিহ্ন থেকে যেতো কাগজে কাটাকাটি আকারে, আর এখন যতবার খুশি ততবার কৃত ভুল শুদ্ধ করা যায় কিংবা পরিমার্জন করা যায় অথচ এগুলোর কোনোই চিহ্ন কেউ দেখতে পায় না। অধিকন্তু অনেক লেখার মধ্যেই এখন অতি সহজে প্রয়োজনীয় ছবি, উপাত্ত, গ্রাফ বা সারণী কিংবা তুলনামূলক বিবরণী সন্নিবেশিত করা যায় ইন্টারনেটের সহায়তায়। আগে কাগজে লেখা হস্তলিপি অতি যত্নে সংরক্ষণ করতেন লেখক নিজে কিংবা তার অতি বিশ্বস্ত কেউ। আর তা ছাপার অক্ষরে প্রকাশিত হলে তখন পত্র-পত্রিকা কিংবা পুস্তক আকারে সংরক্ষিত হতো অন্যদের কাছে। এখন লেখকরা তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় লেখার কাজ সম্পন্ন করলে তা সংরক্ষিত থাকে ডিজিটাল ডিভাইসে অর্থাত্ মোবাইলে কিংবা আইপ্যাডে বা কম্পিউটারে। তবে কেউ যদি তা সোশ্যাল মিডিয়াতে প্রকাশ করেন, তবে তা মুহূর্তেই বিশ্বময় উন্মুক্ত হয়ে যায়। তখন এগুলোর তথ্যভাণ্ডার হয় ফেসবুক কিংবা গুগল কিংবা অন্য যেকোনো সংশ্লিষ্ট সোশ্যাল মিডিয়া।
আবার সাহিত্যের বিভিন্ন শাখার কিছু ফিনিসড প্রোডাক্ট, যেমন—নাটক, গান, কবিতার আবৃত্তি, গল্প ইত্যাদির অডিও কিংবা ভিডিও এখন সংরক্ষণ করা যায় ইউটিউবে। এখন মোবাইলের রিংটোনেও শোনা যায় অনেক গান কিংবা কবিতার সুরেলা কণ্ঠ। উল্লেখ্য, সিডি কিংবা পেনড্রাইভেও ব্যাকআপ হিসেবে রাখা যায় সবকিছুর সফট কপি। সুতরাং বলা যায় যে, সাহিত্য সৃষ্টির এবং তা সংরক্ষণে তথ্যপ্রযুক্তি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হয়ে উঠেছে।
কাগজে অনেক পুরাতন লেখার পাঠোদ্ধার ও প্রয়োজনে পুনঃসম্পাদনা করে সংরক্ষণের জন্য নতুন প্রযুক্তি হলো ‘ওসিআর’ অর্থাত্ অপটিক্যাল কারেক্টার রিডার সফটওয়্যার। এই সফটওয়্যারের সাহায্যে পুরাতন অনেক মূল্যবান লেখালেখির সমুদয় বিষয়বস্তু স্ক্যান করে তাত্ক্ষণিকভাবে সফট কপি তৈরি করা যায় এবং প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে সংশোধন বা পরিমার্জন করে তা সফট কপি হিসেবে সংরক্ষণ করা সম্ভব। প্রাচীন অনেক বিখ্যাত কবি-সাহিত্যিকের বহু মূল্যবান সৃষ্টিকে এই ডিজিটাল পদ্ধতিতে আমরা ভবিষ্যত্ প্রজন্মের জন্য রেখে যেতে পারি। আনন্দের কথা হলো, বাংলাদেশ সরকার ২০১৫ খ্রিস্টাব্দে আইসিটি ডিভিশন থেকে বাংলা ভাষার জন্য এই ধরনের ওসিআর সফটওয়্যার টুলস তৈরি করেছে। তথ্য প্রযুক্তির একটি উল্লেখযোগ্য সংযোজন হলো অনুবাদক অ্যাপ্লিকেশন অ্যাপস (Translator apps)। মোবাইলে সংযোজিত এই অ্যাপসটির সাহায্যে এক ভাষায় লেখাকে অন্য ভাষায় মুহূর্তেই অনুবাদ করা যায়। সুতরাং অনুবাদ সাহিত্যের বিশ্বায়নে তথ্যপ্রযুক্তির এই আবিষ্কার আমাদের অগ্রযাত্রাকে আরো একধাপ এগিয়ে দিয়েছে।
ডিজিটাল পদ্ধতির আরো দুটি সফটওয়্যার সলিউশনের কথা এখানে প্রাসঙ্গিক বলে তা উল্লেখ করছি। একটি হলোঅ— ‘টেক্সট টু স্পীচ’ এবং আর একটি হলো—‘ডিজিটাল টকিং টেক্সট’ তৈরি। স্পিচ টু টেক্সট সফটওয়্যার হলো উচ্চারিত শব্দসম্ভার টেক্সটে রূপান্তর করা। পক্ষান্তরে টেক্সট টু স্পিচ অ্যাপ্লিকেশন হলো, ডিজিটাল টেক্সটকে উচ্চারিত শব্দে রূপান্তর করা। এই সফটওয়্যারগুলো সাহিত্য সৃষ্টি বা সাহিত্যচর্চার ক্ষেত্র সহজীকরণে যুগান্তকারী সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারে।
তথ্যপ্রযুক্তির কল্যাণে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অনুষঙ্গ হলো: ই-লাইব্রেরি। এখন ইন্টারনেটের সাহায্যে পুরো বিশ্বের বিখ্যাত বইগুলো ঘরে বসেই পড়া যায়। তবে বাংলাদেশের ভেতর অসংখ্য লাইব্রেরি থাকলেও সেগুলোকে আমরা এখনও ই-লাইব্রেরিতে রূপান্তর করতে পারিনি। প্রচেষ্টা চলছে অনেক জায়গাতে সেটা সত্য। অনেকেই জানেন, তথ্যপ্রযুক্তির মাধ্যমে সৃষ্টি হয়েছে বইয়ের এক বিশাল জগত্। তার নাম ই-বুক । ই-বুক হলো অনলাইনে বইয়ের দুনিয়া—যেখান থেকে ইচ্ছেমতো বই ডাউনলোড করে কিংবা অনলাইনেই পড়া যায়। এমন কিছু দরকারি সাইটের ঠিকানা আছে। যেমন—বই ডাউনলোড করার একটি সাইট হলো— http://rashal.com
বাংলা সাহিত্যের জনপ্রিয় অনেক লেখকের বই মিলবে এখানে। ইংরেজি সাহিত্যের জনপ্রিয় বই ডাউনলোডের সুযোগও আছে। ইংরেজি ভাষায় তৈরি সাইটটিতে লেখকের নামের বর্ণনানুক্রমে তালিকা করা হয়েছে। বই ডাউনলোড করার আর একটি সাইট হলো- http://www.banglapapers.com/books.htm
বাংলাদেশ এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গের জনপ্রিয় লেখকবৃন্দের বই পাওয়া যাবে এখানে। এ সময়ের জনপ্রিয় লেখক ছাড়াও প্রয়াত লেখকদের কালজয়ী বইও পাওয়া যাবে এখানে। কাজেই তথ্যপ্রযুক্তি এখন পাঠকদের হাতের কাছে সকল প্রকার বইয়ের জগেক এনে দিয়েছে কত সহজে! উল্লেখ্য, আমাদের বাংলাভাষায় বিজয় ফন্ট ও কীবোর্ড আবিষ্কার এক যুগান্তকারী অধ্যায় বলে বিশ্বে স্বীকৃত। এর আবিষ্কারক মোস্তাফা জব্বার একজন বাঙালি এবং তিনি বাংলাদেশে জন্মগ্রহণ করেছেন। এজন্য তাঁকে নিয়ে আমরা গর্ববোধ করি।
তথ্যপ্রযুক্তির উন্নয়নের পাশাপাশি আমাদের বাংলা ভাষাকে আরো উন্নত ও সহজ প্রক্রিয়ায় তথ্য প্রযুক্তির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করে ব্যবহারের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এজন্য বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে। এই প্রকল্পের নাম Enhancement of Bangla Language in ICT Through Research & Development. মূলত গ্লোবাল প্ল্যাটফরমে অন্যতম ভাষা হিসেবে বাংলা কম্পিউটিং প্রতিষ্ঠা করা এই প্রকল্পের মুখ্য উদ্দেশ্য। তথ্যপ্রযুক্তির মাধ্যমে বাংলা ভাষার ব্যবহার সহজীকরণের নিমিত্ত ১৬টি নতুন আইসিটি টুলস তৈরি করা হবে। ফলে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাংলা ভাষা ব্যবহারের সুযোগ তৈরি হবে। সুতরাং তথ্যপ্রযুক্তি আমাদের সাহিত্য ভাণ্ডারকে নিয়ে যাবে এক অনন্য স্বপ্নের দেশে। আগামী প্রজন্মের জন্য খোলা থাকবে সেই স্বপ্নের দেশের অবারিত দুয়ার— এ প্রত্যাশায় থাকবো আমরা সবাই।
n লেখক :সচিব, ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ
Share2
এই পাতার আরো খবর -
একজন মায়ের জন্য আমেরিকা পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন জায়গা
একজন মায়ের জন্য আমেরিকা পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন জায়গা
তথ্যপ্রযুক্তি খুলে দিচ্ছে অনন্য সম্ভাবনার দ্বার
তথ্যপ্রযুক্তি খুলে দিচ্ছে অনন্য সম্ভাবনার দ্বার
সংস্করণ
উত্তরাঞ্চল সংবাদ জাতীয় সংসদ
আয়োজন দ্বাদশ রাশির পূর্বাভাস
অনুশীলন বিনোদন প্রতিদিন
দৃষ্টিকোন শ্রেণীবদ্ধ বিজ্ঞাপন
সারাদেশ রাজধানী
অন্যান্য সম্পাদকীয়
উপ-সম্পাদকীয় চিঠিপত্র
শিল্প বাণিজ্য খেলার খবর
প্রথম পাতা শেষ পাতা
দ্বিতীয় সংস্করণ
অনলাইন সংস্করণ
জাতীয় রাজনীতি
সারাদেশ বিশ্ব সংবাদ
খেলাধুলা বিনোদন
অর্থনীতি বিজ্ঞান ও টেক
সংস্কৃতি প্রবাস
রাজধানী শিক্ষাঙ্গন
আদালত লাইফস্টাইল
rss goolge-plus twitter facebook
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: তাসমিমা হোসেন।
© প্রকাশক কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত