যদিও এটি পুরনো একটি উপন্যাস, শার্লক হোমস চরিত্রটির প্রতি পাঠকের আকর্ষণ হয়তো কখনোই কমবে না। গোয়েন্দা চরিত্র শার্লক হোমসকে নিয়ে লেখা তৃতীয় উপন্যাস এটি। আগেরগুলোর মতো এটিও স্যার আর্থার কোনান ডয়েল এর লেখা, যিনি প্রথমে চিকিৎসা পেশায় থাকলেও পরে লেখালেখিকে পেশা হিসেবে বেছে নেন। তাকে বলা হয়ে থাকে ‘Father of Crime Fiction’। এটি প্রথমে সিরিজ আকারে ১৯০১ সালে দ্য স্ট্র্যান্ড ম্যাগাজিন-এ প্রকাশিত হয়। পরের বছরেই এটি উপন্যাস আকারে ইংল্যান্ডে প্রকাশ করে জর্জ নিউনেস লিমিটেড। পরবর্তী বছরগুলোতে বিভিন্ন প্রকাশনী থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন ভাষায় প্রকাশিত হয় উপন্যাসটি। কথা হচ্ছে ‘দ্যা হাউন্ড অফ বাস্কারভিলস’ নিয়ে, যা ডয়েলের অন্যতম বেস্ট সেলার বই।
কে এই হোমস?
শার্লক হোমস সম্পর্কে শোনেনি এমন লোক বা পাঠক নেই বললেই চলে। তারপরও যারা শোনেননি বা আরেকটু জানতে চান তাদের জন্য সংক্ষেপে লিখছি।
শার্লক হোমস একটি কাল্পনিক চরিত্র, যা একজন রক্ত-মাংসের মানুষ দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে সৃষ্ট। এডেনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিখ্যাত ফরেনসিক সায়েন্টিস্ট ড. জোসেফ বেল-এর তত্ত্বাবধায়নে পড়াশোনা করেছিলেন ডয়েল। তার দ্বারাই অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি সৃষ্টি করেন হোমসকে। ১৮৮৭ সালে পাঠকদের সাথে হোমসকে প্রথম পরিচয় করিয়ে দেন ডয়েল। আর তখন থেকেই হোমসের ভাগ্য নির্ধারিত হয়ে গিয়েছিল বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় গোয়েন্দা চরিত্র হওয়ার। হোমসকে নিয়ে ৪টি উপন্যাস ও ৬৫টি ছোট গল্প লিখেছেন ডয়েল। গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস হোমসকে ইতিহাসের ‘Most Portrayed Literary Human Character In Film & TV’ হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছে। হোমস কোনো রক্ত-মাংসের চরিত্র না হলেও জনপ্রিয়তা এমন তুঙ্গে ওঠে যে, তার অস্তিত্ব পাঠকদের কল্পনাকেও ছাপিয়ে যায়।
উপন্যাসের ভেতর
দক্ষিণ আফ্রিকার বোর যুদ্ধ থেকে ফিরে ডয়েল এ উপন্যাসটি লেখেন। হোমসকে নিয়ে লেখা অন্য উপন্যাসগুলোর মতো এটিরও কথক বা ভাষ্যকার হোমসের বন্ধু-সহযোগী ডা. ওয়াটসন। যদিও এর শুরু ও শেষ ২২১বি বেকার স্ট্রিটে, কিন্তু উপন্যাসটির ঘটনাগুলো ঘটেছে ডেভনশায়ারে। সময়টা দেখানো হয়েছে ১৮৮৯ সালে।
স্যার চার্লস বাস্কারভিলের মৃত্যুর রহস্য নিয়ে শুরু হয় উপন্যাসটি। চার্লসের মৃত্যু হয়েছিল উপন্যাস শুরুর আগেই এবং মানুষের ধারণা বাস্কারভিল বংশে লেগে থাকা এক পুরনো অভিশাপই তার মৃত্যুর কারণ। চার্লসের বন্ধু ডা. মরটিমার কেসটি নিয়ে আসে হোমসের কাছে। তার বিশ্বাস, এ মৃত্যুর সাথে জড়িত একটি হাউন্ড (এক প্রজাতির শিকারী কুকুর), যেটির পায়ের ছাপ পাওয়া গেছে মৃতদেহের কাছে। এছাড়া অভিশাপের ব্যাপারটা তো ছিলোই। চার্লসের মৃত্যুর পর উত্তরাধিকার হিসেবে বাস্কারভিল সম্পদের মালিকানা যায় স্যার হেনরির নামে, যিনি শীঘ্রই ডেভনশায়ার পৌঁছাবেন। ডা. মরটিমার স্যার হেনরির নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত ছিলেন, পাছে এ অভিশাপ তার না লেগে যায় এবং তারও পরিণতি স্যার চার্লসের মতো হয় তাই তিনি হোমসের কাছে আসেন।
স্যার হেনরি লন্ডনে পৌঁছাবার পর থেকেই তার সাথে অদ্ভুত কিছু ঘটনা ঘটতে থাকে। হোমস কিছু আঁচ করতে পেরেছিলেন বলে ওয়াটসনকে বাস্কারভিল হলে পাঠান স্যার হেনরির সাথে তার নিরাপত্তার জন্য। হোমস কিছু কাজ শেষ করতে লন্ডনেই থেকে যান।
উপন্যাসটিতে একটি মজার ব্যাপার হচ্ছে এই প্রথম ওয়াটসনকে একা ছেড়েছেন হোমস। অন্য উপন্যাসগুলোতে ওয়াটসনকে মূলত ভাষ্যকর হিসেবে দেখা গেলেও এটিতে বেশ ভালোই গোয়েন্দাগিরি করতে দেখা যায় তাকে। তিনি বাস্কারভিল হলে পৌঁছেই বেশ কিছু রহস্যজনক ব্যাপার উদঘাটন করেন। বাস্কারভিল হলের আশেপাশে বিস্তীর্ণ ভূমিতে ঘুরে বেড়ানো পলাতক আসামি, ব্যারিমোরের মাঝ রাতে বাতি জ্বালিয়ে সংকেত পাঠানো, মিসেস ব্যারিমোরের প্রায়ই কান্নায় ভেঙে পড়া- কোনো কিছুই এড়ায়নি ওয়াটসনের চোখ। বাস্কারভিল হলে বসে তিনি শুনেছিলেন, দূর থেকে ভেসে আসা দীর্ঘ গোঙানির মতো, নরক থেকে নেমে আসা সেই অতিপ্রাকৃত হাউন্ডের ডাক। স্থানীয়দের কাছ থেকে তিনি ঐ রহস্যময় ডাক সম্পর্কে প্রচলিত ভয়ানক হাউন্ডের উপকথা সম্বন্ধে জানতে পারেন। এর মধ্যে তার পরিচয় হয় প্রতিবেশী স্ট্যাপেলটন ভাই-বোনের সাথে, যাদের ব্যাপারে কিছু একটা অদ্ভুত লেগেছিল ওয়াটসনের।
এদিকে যখন এতকিছু ঘটছে তখন সেখানে নাটকীয় এক আগমন ঘটে হোমসের। যদিও এযাবত গোয়েন্দাগিরি করছিলেন ওয়াটসন, কিন্তু পরবর্তী কর্মকাণ্ডগুলো পরিচালনা করেন হোমস। তাদের সাথে যোগ দেন স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের ইন্সপেক্টর লেসট্রেড। নারকীয় সেই হাউন্ডের অতর্কিত আক্রমণ থেকে স্যার হেনরিকে প্রাণে বাঁচিয়ে এবং অতিপ্রাকৃত হাউন্ডের রহস্য উৎঘাটন করে বাস্কারভিল অধ্যায়ের ইতি টানেন হোমস।
পাঠক যদি উপন্যাস জুড়ে হোমসকে খোঁজেন, তাহলে তাকে একটু অসন্তুষ্টই হতে হবে। কারণ উপন্যাসটির ষষ্ঠ থেকে দ্বাদশ অধ্যায় পর্যন্ত হোমসের কথা নেই বললেই চলে। সেখানে রয়েছে মূলত ওয়াটসনের অনুসন্ধানের কথা আর অন্যান্য চরিত্রের কর্মকাণ্ড। তবে রহস্যে বুঁদ হয়ে থাকা অধিকাংশ পাঠকেরই চোখ এড়িয়ে যায় বিষয়টি।
গল্পের অনুপ্রেরণা
ভিক্টোরিয়ান প্রেক্ষাপটে রচিত ‘দ্য হাউন্ড অব বাস্কারভিলস’ উপন্যাসটির মূল লক্ষ্য একটি গথিক গল্প বলা। উপন্যাসে যে হাউন্ডের কথা বলা হয়েছে সেটি মূলত এক পশ্চিমা গ্রাম্য কিংবদন্তীকে ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। বলা হয়, সেই কিংবদন্তীর সমাধি ঘিরে থাকতো হাউন্ডের দল। ডয়েলের মূল ধারণাটি এসেছিল রিচার্ড ক্যাবেলের কিংবদন্তী থেকে। বাস্কারভিলের নারকীয় হাউন্ড ও অভিশপ্ত জমিদারদের গল্পের মূল অনুপ্রেরণা ছিল এ কিংবদন্তী। বাকফাস্টলিহ এর ডেভনশায়ারে ক্যাবেলের সমাধি এখনও দেখা যায়। এছাড়া ডেভন শহরের লোককথায় ‘Yeth Hound’ নামে এক অতিপ্রাকৃত হাউন্ডের উল্লেখ আছে, যা ডয়েল শুনে থাকতে পারেন। বাদবাকি সবই ছিল তার কল্পনার প্রতিফলন।
সিনেমা, নাটক ও অন্যান্য
উপন্যাসটি এত আলোচিত যে, এটি নিয়ে তৈরি হয়েছে বেশ কিছু সিনেমা ও টিভি সিরিজ। এটি নিয়ে ১৯১৪ সালে প্রথম সিনেমা তৈরি হয় জার্মান সাম্রাজ্যে, যেটি ছিল একটি নির্বাক চলচ্চিত্র। জার্মান সাম্রাজ্যের সাথে সাথে ভাইমারার রিপাবলিকেও পর পর তৈরি হয় কিছু চলচ্চিত্র। যদিও এ উপন্যাসের ঘটনাগুলো ছিল যুক্তরাজ্যভিত্তিক, ১৯২১ সালে সেখানে প্রথম এ উপন্যাসকে কেন্দ্র করে চলচ্চিত্র তৈরি করা হয় এবং নাম দেওয়া হয় উপন্যাসটির নামেই। এছাড়া সোভিয়েত ইউনিয়ন, ইতালি, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র, জাপানে এটি নিয়ে তৈরি হয়েছে সিনেমা ও টিভি সিরিজ। এমনকি পাশ্ববর্তী দেশ ভারতেও তৈরি হয়েছে দুটি সিনেমা যার প্রথমটি ১৯৫১ সালে বাংলায় জিঘাংসা এবং দ্বিতীয়টি ১৯৬২ সালে হিন্দিতে বিস সাল বাদ ।
উপন্যাসটি নিয়ে যে শুধু সিনেমা ও টিভি সিরিজ হয়েছে তা নয়, হয়েছে মঞ্চ নাটক এবং রেডিও নাটকও। বিবিসি রেডিও এটিকে নাটক হিসেবে ১৯৯৮ সালে প্রথম প্রচার করে।
বিশ্ব জুড়ে শার্লক হোমসের বহু ভক্ত রয়েছে। তাদের অনেকের কাছে মনে হয়েছে শার্লক হোমস সিরিজের অন্যান্য গল্প ও উপন্যাস থেকে এটি আলাদা। এর পটভূমি, এক অতিপ্রাকৃত প্রাণীর উপস্থিতি এবং অবশেষে রহস্য উদঘাটন- সব কিছুই ছিল ভিন্ন। অনেকেরই শৈশবের কল্পনার হিরো শার্লক হোমস। এ উপন্যাসটি ছিল রহস্যের সাগরে হোমসের আরেকটি সফল অভিযানের কথা।