আমার প্রথম সন্তান মাশিয়া

in life •  6 years ago 

আমার প্রথম সন্তান মাশিয়ার যখন জন্ম, তখন আমি এবং আমার স্ত্রী দুইজনই ফিফথ ইয়ারে। মাশিয়ার জন্ম ছিল একটি মেডিকেল মির‍্যাকল।

আমার স্ত্রীর কিছু সমস্যা ছিল যার কারণে ওর মা হতে পারার কথা ছিল না। ব্যাপারটা আমি বিয়ের আগে থেকেই জানতাম। নিজেকে বুঝালাম - পুরো পৃথিবীকে না, আমার আসলে শুধুমাত্র একজন মানুষের কাছে নিজের মনুষ্যত্বের পরীক্ষাটা দিতে হবে। আমি চাইলেই তাকে হতাশার সাগরে একা ছেড়ে দিতে পারি, আবার সারাজীবনের জন্যে তার পাশেও দাঁড়াতে পারি। তাই পছন্দের মানুষটা কখনো মা হতে পারবেনা এটা জানার পরেও থার্ড ইয়ারে থাকা অবস্থাতেই, মানসিক সুস্থতার জন্যে হলেও, ওর সব দায়িত্ব নেয়া আমার কাছে জরুরী বলে মনে হয়। সব জেনে-বুঝে ঠান্ডা মাথায় পরিবারকে বুঝাই। ২০০৭ সালের মে মাসে আমাদের বিয়ে হয়ে যায়।

ইনফার্টিলিটির চিকিৎসা ছিল আমাদের কাছে এক ভয়াবহ মানসিক যুদ্ধের নাম। অনেক চেষ্টার পরে, বিয়ের প্রায় তিন বছর পর,পৃথিবী আলো করে আমাদের প্রথম সন্তানের জন্ম হয়। ডাক্তার মেয়েটাকে কোলে দিয়ে বলেছিলেন - "ও তোমাদের বিস্ময় শিশু! আগলে রেখ।”

আমাদের ফাইনাল প্রফের আর ৫ মাস বাকি তখন। আমার স্ত্রী ছিলেন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের ছাত্রী। তাই অনেক ঠিক-ভুলের হিসেব মেলানো বাকি রেখে ওকে একা চট্টগ্রাম ফেরত পাঠালাম। কথা দিলাম শুধু ৫টা মাস,আরেকটু কষ্ট যেন করে। এরপর আমরা তিন জন সারাজীবন একসাথে থাকব। সিজারের মাত্র ২১ দিনের মাথায় সন্তানকে ছেড়ে ও হোস্টেলে ফিরে যায়। কথা দিলাম,মেয়েকে আমি দেখে রাখব।

42280382_10212724368854556_5045139890375753728_n.jpg

ফাইনাল প্রফের প্রচন্ড চাপের মধ্যে অপরিপক্ক হাতে মেয়েকে পালতে পারব কি পারব না সেসব নিয়ে ভাবিনি। হাতে বই আর কাঁধে মেয়ে- এভাবেই প্রফের প্রস্তুতি নিতে থাকি। কিন্তু সত্যিটা হল, এর মধ্যেই আমাদের বন্ধুত্বটা ভীষণ জমে গেল। তখন আমি একই সাথে তার বাবা ও মা।

কিন্তু প্রফের পরেও সমস্যা একটা রয়েই গেল। কিছুতেই আমার স্ত্রীর ইন্টার্নশিপ ঢাকায় ট্রান্সফার করা গেলনা। মেয়েও চিটাগাং যেয়ে খাপ খাওয়াতে পারছিল না। ফলে মেয়ে আমার কাছেই রয়ে গেল। মোট দু বছর প্রায় একা ওকে কোলে পিঠে করে বড় করি। সবাই আমাকে ডাকত কুশল ভাই, দেখাদেখি মেয়েও আমাকে ডাকতে শুরু করলো, “কুতল ভাই”। নিঃসন্দেহে আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় ছিল ওটা।

এই ভাঙা পরিবারটা নিয়েই আমরা সুখী ছিলাম। কিন্তু জন্মের কয়েক মাসের মাঝেই আমাদের মেয়েটার Coronal Craniosynostosis ধরা পড়ে। আমাদের পুরো পৃথিবী থমকে যায়। আমার সুস্থ মেয়েটা আস্তে আস্তে মেন্টালি রিটার্ডেড হয়ে যেতে পারে ভাবতেই দম বন্ধ হয়ে আসত। ডাক্তার দুই বছর সময় বেঁধে দেন। আমি শুধুমাত্র সৃষ্টিকর্তার কাছে দু' হাত পেতেছি যাতে আমাদের মেয়েটাকে তিনি সুস্থ করে দেন। খুব বাঁশি বাজাতে ভালবাসতাম, তবলা বাজাতেও ভাল লাগত। ওর সুস্থতার আশায় প্রয়োজনে এগুলো ছেড়ে দেব বলেও মন ঠিক করে ফেললাম।

সৃষ্টিকর্তা আমাকে ফেরান নি, একজন পিতার দোয়া তিনি কবুল করেছেন। মাশিয়া কে তিনি সুস্থ রেখেছেন। আমাদের মেয়েটা হাতেগোনা কয়েকজন Coronal Craniosynostosis সারভাইভারদের একজন। আমি সবাইকে বলি যে, আমি হচ্ছি একজন অতি ভাগ্যবান বাবা এবং আমার 'বিস্ময় কন্যা' আসলেই এক বিস্ময়। কারণ সবগুলো ফন্টান্যালি প্রিম্যাচিওরলি ফিউজড হলেও সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছায় ওর বিন্দুমাত্র কোন বিপদ হয়নি। ওর এবার সাত বছর হলো। সেই বিপদটা কেটেছে আজ প্রায় ৫ বছর হতে চলছে। ও এখন একদম ঝুঁকিমুক্ত।

ইন্টার্নশীপ শেষে আর্মি মেডিক্যাল কোরে ক্যাপ্টেন হিসেবে চাকরির সুযোগ পাই। জাপানে পেলাম পিএইচডি করার জন্য মনবুশো স্কলারশিপ। কিন্তু সাইকায়াট্রির প্রতি ভালবাসা পিছিয়ে দিল। বিএসএমএমইউ তে এমডি রেসিডেন্সিতে চান্স পেয়ে যাই। একদিন বড় সাইকায়াট্রিস্ট হয়ে মানুষের উপকারে আসব সেই অপেক্ষাটা করতে পারিনি। নিজের স্বপ্নগুলোকে বাস্তবে দেখতে ইচ্ছে হত। সেই লক্ষ্যেই আস্তে আস্তে কাজ করতে শুরু করি।

লাইফস্প্রিং নামে একটি মেন্টাল হেলথ ইন্সটিটিউট শুরু করি। মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে অনেক কিছু করার স্বপ্ন দেখি। 'হোপ অটিজম স্কুল' এর চেয়ারম্যান হিসেবে অটিস্টিক শিশুদের সাথে যুক্ত হয়েছি। কাজ করতে চাই সব স্পেশাল বাচ্চাদের জন্যেও। নিজের মেয়েকে নিয়ে সেই দু:সহ দিনগুলো থেকেই এই সামাজিক দায়বদ্ধতার জন্ম।

গত ৫ বছরে শুধু ঢাকা মেডিকেলেরই অনেক স্টুডেন্ট এর কাউন্সিলিং করেছি ব্যক্তিগতভাবে। তাদের প্রত্যেকের গল্প আমি যত্ন নিয়ে নিজের কাছে জমিয়ে রেখেছি। ওদেরকে জীবনে বেঁচে থাকার উদ্দেশ্য বোঝানোর চেষ্টা করেছি।

স্বপ্নজয়ীদের মিছিলে সবাই চাইলেই মিশে যেতে পারে না। তাই আমরা যেন এদেরকে আগে থেকে চিনতে ভুল না করি,ভালবেসে জড়িয়ে ধরতে ভুল না করি, বলতে ভুলে না যাই যে - চড়াই উতরাই পেরিয়ে সাফল্য আসবেই। নিজের জীবনকে ভালবাসতে না পারাটাই মানুষ হিসেবে আমাদের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা। জীবনের হিসাব যেন 'জীবনে কী পেলাম না' সেটা দিয়ে না মেলাই, কী পেয়েছি বরং সেটা দিয়ে মেলাই।

Authors get paid when people like you upvote their post.
If you enjoyed what you read here, create your account today and start earning FREE STEEM!
Sort Order:  
  ·  6 years ago Reveal Comment

You just received a 32.26% upvote from @honestbot, courtesy of @ariyan003!
WaveSmall.gif

You got a 4.18% upvote from @joeparys! Thank you for your support of our services. To continue your support, please follow and delegate Steem power to @joeparys for daily steem and steem dollar payouts!

This post has received a $50.00 % upvote from @siditech thanks to: @ariyan003.
Here's a banana! banana-small.png

This post has received a 50.00% upvote from @aksdwi thanks to: @ariyan003.

You have been defended with a 19.30% upvote!
I was summoned by @ariyan003.

Congratulations @ariyan003! You have completed the following achievement on the Steem blockchain and have been rewarded with new badge(s) :

You got your First payout

Click on the badge to view your Board of Honor.
If you no longer want to receive notifications, reply to this comment with the word STOP

Do not miss the last post from @steemitboard:

Presentamos el Ranking de SteemitBoard

Support SteemitBoard's project! Vote for its witness and get one more award!

Congratulations @ariyan003! You received a personal award!

Happy Birthday! - You are on the Steem blockchain for 1 year!

You can view your badges on your Steem Board and compare to others on the Steem Ranking

Vote for @Steemitboard as a witness to get one more award and increased upvotes!