আমার জীবনের কিছু প্যারানরমাল অভিজ্ঞতা : ঘটনা ০৩

in life •  3 years ago 

২০১৪ সালের জুনের ঘটনা এটি । আমার মায়ের মা, অর্থাৎ আমার দিদিমা-কে নিয়ে এই ঘটনাটি । আমার দিদিমা গ্রামে আমার মামার বাড়িতেই থাকতো । কোনোদিনই তাকে গ্রাম ছাড়া করে শহরে আমাদের কাছে আনা যায়নি । গ্রাম ছেড়ে কোত্থাও যেতোও না । শুধুমাত্র একই গ্রামে নিজের বাপের বাড়িতে মাঝে মাঝে যেত । বয়স তখন নব্বই পার করে ফেলেছে । তাও দিদিমার বাপের বাড়ি মানে আমার মায়ের মামাবাড়ির প্রতি ছিল অসম্ভব টান ।

দিদিমা বয়সের তুলনায় যথেষ্ঠ কর্মক্ষম ছিলো । একা একাই ঘরের কাজ করতো সব । বাসন মাজা, কাপড় কাঁচা, গোয়ালে গরু বাছুরের পরিচর্যা এবং রান্না বান্না । বাড়িতে রান্নার জন্য একজন মহিলা আর বাইরের কাজের জন্য একজন চাকর রাখা হয়েছিল । কিন্তু, বুড়ির আর কারো কাজ পছন্দ হতো না ।

আমার দিদিমা ছিল আমাদের তিন ভাইয়ের প্রাণ । দিদিমার একটিই মেয়ে । আমার মা । আমার মামা কিশোর বয়সে এক দিনের জ্বরে মারা যান । অন্য শরিকে মামাতো ভাই-বোনেরা আছে আমাদের । তারাই বুড়িকে দেখা শোনা করতো । যেমন এক জনের কথা না বললেই নয় । তার নাম হলো শিশির বোস । আমার এক মামাতো ভাই । মামাবাড়িতে আমার এই ভাই-ই দেখাশোনা করে সব কিছু । মামাবাড়িতে মায়ের প্রচুর জমিজমা আছে । সেগুলোও আমার এই মামাতো ভাই শিশির কুমার বোস ওরফে মদনদা দেখাশোনা করে থাকে ।

তো, এবার আসা যাক মূল ঘটনায় ।

২০১৪ সালের জুনের ১৩ তারিখে আমার দিদিমা ৯৪ বছর বয়সে হঠাৎ ব্রেন স্ট্রোক করে । ডাক্তার কন্ফার্ম করেন যে খুব লো ব্লাড প্রেশারের কারণে এই স্ট্রোক । আসলে, দিদিমার খাওয়া দাওয়াতে বেজায় অনিয়ম ছিল । আর খেতো শুধু ভাত, আলু ভর্তা আর তেঁতুল-কাঁচা লঙ্কা । মাছ, মাংস, দুধ, ডিম, সবজি কিছুই খেতে চাইতো না । মাঝে মাঝে একটু ডাল খেতো শুধু ।

তো গ্রামের বাড়ি থেকে ফোন করে আমাদের জানালো যে দিদিমা স্ট্রোক করেছে হঠাৎ । তবে, এখন ভালো আছে । বাঁ সাইড কিছুটা প্যারালাইজড । কিন্তু, কথা বলতে পারছে আর ভাত চিবিয়েও খেতে পারছে । শুনে, বেশ কিছুটা স্বস্তি পেলাম মনে । বাবা আর গেলো না, কিন্তু মা গেলো মামাবাড়িতে ।

ধীরে ধীরে দিন যেতে লাগলো । এন্টি-স্ট্রোকের ওষুধ নিয়মিত খাচ্ছিলো দিদিমা, ম্যাসাজ আর খাবারে আস্তে আস্তে বেশ সুস্থ হয়ে উঠলো । একদিন কথাও হলো ফোনে আমাদের সাথে । কথা তখনও ছিলো কিছুটা জড়ানো । হাউ মাউ করে কাঁদছিলো বুড়ি । তার প্রাণের নাতিদের দেখার জন্য । দাদা সব কাজ ফেলে মামাবাড়িতে গেলো । দাদা নিজেই একজন ডাক্তার । তো দিদিমাকে পরীক্ষা করে আমাদের জানালো যে যদি আর স্ট্রোক না করে মাস খানেকের মধ্যে তাহলে আর ভয়ের কিছু নেই । কিন্তু, বয়সটা আর অপুষ্টি বিষয়টি ভাবাচ্ছে খুব । এত বয়স ! ৯৪ বছর । এই বয়সে স্ট্রোকের ধকল সহ্য করা বড় সহজ কথা নয় ।

১৯ তারিখে রাতে যথারীতি খেয়েদেয়ে শুতে গেলাম সকাল সকাল । কেন জানি মনটা সেদিন খুব একটা ভালো ছিল না । শেষ রাতে এক অদ্ভুত স্বপ্ন দেখলাম । দেখলাম আমি মামাবাড়ির উঠোনে দাঁড়িয়ে রয়েছি । দিদিমাকে জোরে জোরে ডাকছি । কিন্তু দিদিমা আসছে না । একটু পরে মা বেরিয়ে এলো । দেখি মা কাঁদছে । এরপরে দাদা, তারপরে আমার ভাই । দেখি সবাই খুব কাঁদছে । আমি বলছি - "কী হয়েছে ? তোমরা কাঁদছো কেন ?"

কিন্তু, কেউ কোনো উত্তর দিচ্ছে না । সব কিছু কেমন ধোঁয়া ধোঁয়া ধূসর লাগছে । এমন সময় নিজেকে আবিষ্কার করলাম মামাবাড়ির দক্ষিণ দিকের পুকুর পাড়ে । দেখি দিদিমা বাসন মাজছে । আমাকে দেখে বাসন মাজা ফেলে আস্তে আস্তে কুঁজো হয়ে লাঠি ভর দিয়ে ঠুক ঠুক করে আমার কাছে এলো । দেখি দিদিমাও কাঁদছে ।

আমি বললাম - "কি হলো ? তোমরা সবাই কাঁদছো কেন ?"

দিদিমা বললো - "ভাইদা, আমি মরে গিয়েছি । মরার আগে তোকে কত দেখতে ইচ্ছে করছিলো । তুই এলি না । বড় ভাইদা এলো দেখতে । তুই এলি না ।"

এখানে বলে রাখি দিদিমা তার তিন নাতির মধ্যে আমাকে বেশি ভালোবাসতো । সেই আমিই পাঁচ বছরে এক বারও মামাবাড়ি যাইনি । কারণ, ব্যস্ততা । বুড়ি তাই খুব কাঁদতো । যখনি ফোন করতো আসতে বলতো তার কাছে ।

স্বপ্নটা এই পর্যন্ত দেখেই প্রচন্ড কষ্টে বুক শুকিয়ে গেলো । ধড়মড়িয়ে জেগে উঠলাম । দেখি কেবল ভোর হচ্ছে । বেসিনে গিয়ে চোখে মুখে জল দিলাম । তারপরে বেশ কিছুক্ষন থম মেরে বসে থাকলাম । এ কী বাজে স্বপ্ন দেখলাম আমি । ইচ্ছে করছিলো তখনি মা'কে ফোন দেই । পাঁচটা বাজে । তাই ভাবলাম এখন থাক । আরেকটু বেলার দিকে ফোন দেব ।

সকাল আটটায় আমি ফোন দেয়ার আগেই মদনদা ফোন দিলো । আমি সবার আগে দিদিমার কথা জিজ্ঞেস করলাম । মদনদা জানালো সব ঠিকঠাক আছে । দিদিমা ঘুম থেকে উঠে এখন দুধ-মুড়ি খাচ্ছে ।

শুনে কি যে স্বস্তি পেলাম মনে তা বলে বোঝাতে পারবো না । দশটার দিকে আমি মা'কে ফোন দিলাম । শুনলাম দিদিমা ভাত খেয়ে এখন পান চিবুচ্ছে । বুড়ির খুব পানের নেশা ছিল । স্ট্রোক করার ৭ দিন পরে আজ প্রথম পান খাচ্ছে । কথা টথাও নাকি আগের থেকে অনেক ক্লিয়ার বলছে । শুনে একেবারেই মনটা ফুরফুরে হয়ে গেলো ।

এরপরে নিজের কাজে ডুবে গেলাম । ঠিক দুপুর ২ টোর দিকে দাদা ফোন দিলো আমাকে । ফোন দিয়েই শুধু বলতে পারলো - "দিদিমা ! ......" এরপরে হাউ মাউ করে কান্না ।

আমি জমে একদম পাথর হয়ে গেলাম । দেড়টার একটু পরে দ্বিতীয় স্ট্রোকটা হয় । ডাক্তার ডাকা হয়েছিলো । কিন্তু, তিনি এসে আর নাড়ি খুঁজে পাননি ।

পরে, মায়ের মুখে শুনেছিলাম বুড়ি চলে যাওয়ার আগে তার প্রাণাধিক তিন নাতিকে উদ্ভ্রান্তের মতো চারিদিক খুঁজেছিলো । আর শেষ মুহূর্তে হাত তুলে আমাদের তিন ভাইকে আশীর্বাদ করে গিয়েছিলো ।

Authors get paid when people like you upvote their post.
If you enjoyed what you read here, create your account today and start earning FREE STEEM!